নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
৩. বনু ‘আমের বিন ছা‘ছা‘আহর প্রতিনিধি দল (وفد بني عامر بن صعصعة)

নাজদ হ’তে আগত এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন আল্লাহর শত্রু ‘আমের বিন তোফায়েল, যার ইঙ্গিতে ও চক্রান্তে ৪র্থ হিজরীর ছফর মাসে বি’রে মা‘ঊনায় ৭০ জন ছাহাবীর মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনা ঘটে। আরও ছিলেন বিখ্যাত কবি হযরত লাবীদ বিন রাবী‘আহ (রাঃ)-এর বৈপিত্রেয় সহোদর ভাই আরবাদ বিন ক্বায়েস এবং খালেদ বিন জা‘ফর ও জাববার বিন আসলাম। এরা সবাই ছিলেন স্ব স্ব সম্প্রদায়ের নেতা এবং শয়তানের শিখন্ডী।

মুত্বার্রিফ বিন আব্দুল্লাহ স্বীয় পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যখন আমি বনু ‘আমের প্রতিনিধি দলের সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হই, তখন আমরা তাঁকে বলিأَنْتَ سَيِّدُنَا وَأَفْضَلُنَا فَضْلاً وَأَعْظَمُنَا طَوْلاً ‘আপনি আমাদের নেতা। আপনি আমাদের চাইতে অনুগ্রহে মহান ও ক্ষমতায় শ্রেষ্ঠ’। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,السَّيِّدُ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى ‘আল্লাহ হ’লেন নেতা। তিনি মহান ও সর্বোচ্চ। এ ব্যাপারে তোমরা শয়তানকে সাথী করোনা’ (আবুদাঊদ হা/৪৮০৬)। খাত্ত্বাবী বলেন, ‘আল্লাহ নেতা’ অর্থ নেতৃত্বের উৎস হ’লেন আল্লাহ। আর সকল সৃষ্টি হ’ল তাঁর দাস (যাদুল মা‘আদ ৩/৫২৭-টীকা)

এখানে বর্ণিত হয়েছে যে, মদীনায় আসার আগে সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের নেতা ‘আমের বিন তুফায়েলকে বলে, হে ‘আমের! লোকেরা সব ইসলাম কবুল করেছে। তুমিও ইসলাম কবুল কর। জবাবে ‘আমের বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমি শপথ করেছি যে, আমি কখনই বিরত হব না, যতক্ষণ না পুরা আরব আমার পিছনে না আসবে। আমি কি কুরায়েশের এই যুবকের অনুসারী হ’তে পারি? অতঃপর সে আরবাদকে বলল, যখন আমরা এই লোকটির কাছে যাব, তখন আমি লোকটিকে তোমার থেকে ফিরিয়ে রাখব। আর তখন তুমি তাকে তরবারি দিয়ে হত্যা করবে’।

অতঃপর যখন তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে পৌছল, তখন ‘আমের বিন তোফায়েল বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আমার সাথে আপনি একাকী নিরিবিলি কথা বলুন’। জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! সেটা কখনই নয়। যতক্ষণ না তুমি এক আল্লাহর উপরে ঈমান আনবে’। তখন সে কথা বলতে শুরু করে এবং অপেক্ষায় থাকে আরবাদ কি করে। কিন্তু যখন সে দেখল যে, আরবাদ কিছুই করতে পারল না, তখন সে পুনরায় আগের মত বলল। জবাবে রাসূল (ছাঃ)ও আগের মত বললেন। এভাবে মোট তিনবার একাকী হওয়ার আবেদন জানিয়েও ব্যর্থ হয়ে সে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় সে হুমকি দিয়ে বলে, ‘আল্লাহর কসম! আমি আপনার বিরুদ্ধে অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী দিয়ে মদীনা ভরে ফেলব’। তখন রাসূল (ছাঃ) দো‘আ করেন, ‘হে আল্লাহ! ‘আমের বিন তুফায়েল থেকে তুমি আমার জন্য যথেষ্ট হও’।

বেরিয়ে আসার পর ‘আমের আরবাদকে বলল, তোমার ধ্বংস হৌক! তোমাকে যে কাজের নির্দেশ দিয়েছিলাম, তা করলে না কেন? জবাবে আরবাদ বলল, আল্লাহর কসম! আমি আপনাকে ব্যতীত আর কাউকে দেখতে পাইনি। তাহ’লে আমি কি আপনাকে হত্যা করব?।[1] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আরবাদ বলল, ‘আমি বারবার তরবারি বের করতে চেষ্টা করেও পারিনি। কারণ তা বাঁটের সাথে আটকে যাচ্ছিল’।[2]

ছহীহ বুখারীতে এসেছে যে, ‘আমের বিন তোফায়েল আল্লাহর রাসূলকে তিনটি বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল। (১) আপনার পরে আমি আপনার স্থলাভিষিক্ত (খলীফা) হব। (২) আপনার জন্য থাকবে উপত্যকার লোকজন এবং আমার জন্য থাকবে লোকালয়ের জনপদ। (৩) না মানলে আমি আপনার বিরুদ্ধে দু’হাযার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে গাত্বফানে যুদ্ধ করব’ (বুখারী হা/৪০৯১)

সমস্ত আরব নেতৃবর্গ ও রোম সম্রাট যে রাসূল ও তাঁর ইসলামী বাহিনীর নামে ভয়ে কম্পমান, সেখানে তাঁর সামনে এসে খোদ রাজধানী মদীনায় বসে এ ধরনের হুমকি দিয়ে কথা বলা ও তাঁকে হত্যা প্রচেষ্টার মধ্যে হাস্যকর বোকামী ও অদূরদর্শিতার পরাকাষ্ঠা যাই-ই থাক না কেন, আরবরা যে প্রকৃত অর্থেই নির্ভীক ও দুর্দান্ত সাহসী তার বাস্তব প্রমাণ মেলে।

অতঃপর তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে বেরিয়ে চলে যায় এবং পথিমধ্যে বজ্রপাতে আরবাদ নিহত হয়। ‘আমের বিন তোফায়েল এক সালূলিয়া মহিলার বাড়ীতে আশ্রয় নেয়। সেখানে তার ঘাড়ে হঠাৎ এক ফোঁড়া ওঠে এবং তাতেই সে ঐ রাতে মৃত্যু বরণ করে। মৃত্যুকালে সে আরেক আল্লাহর শত্রু আবু জাহলের মত অহংকার দেখিয়ে বলে ওঠে,غُدَّةٌ كَغُدَّةِ الْبَعِيرِ فِى بَيْتِ امْرَأَةٍ مِنْ بَنِى فُلاَنٍ ‘উটের ফোঁড়ার ন্যায় ফোঁড়া? তা আবার অমুক বংশের মহিলার ঘরে’? এটাকে সে তার বীরত্বের জন্য অপমানজনক ভেবে তখনই তার ঘোড়া আনতে বলে। অতঃপর সে তার পিঠে উঠে বসে ও সেই অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে’ (আহমাদ হা/১৩২১৮, সনদ ছহীহ)। এভাবেই তাদের দু’জনের উপরে রাসূল (ছাঃ)-এর বদ দো‘আ হাতে-নাতে কার্যকর হয়।

[শিক্ষণীয় : হতভাগা হয়ে যারা জন্মগ্রহণ করে, উপদেশ, উদারতা, ভয়-ভীতি কোন কিছুই তাদের সুপথে আনতে পারে না। ধ্বংসই তাদের একমাত্র পরিণতি হয়।]

[1]. ইবনু হিশাম ২/৫৬৮; যাদুল মা‘আদ ৩/৫২৭-২৮। বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৯৪৩-৪৪)।

[2]. আর-রাহীক্ব ৪৫৩ পৃঃ; ইবনু সা‘দ ১/২৩৬; হায়ছামী, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১১০৯১, সনদ যঈফ।