নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
গণীমত বণ্টনে অসন্তুষ্ট ব্যক্তিগণ (الساخطون فى قسمة الغنائم)

(১) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, এ সময় বনু তামীম গোত্রের নওমুসলিম বেদুঈন হুরকূছ বিন যুহায়ের যুল-খুইয়াইছিরাহ(حُرقُوصُ بنُ زُهَيْر ذُو الْخُوَيْصِرَةِ) নামক জনৈক ন্যাড়ামুন্ড ঘন দাড়িওয়ালা ব্যক্তি বলে উঠে, يَا مُحَمَّدُ اعْدِلْ. قَالَ: وَيْلَكَ وَمَنْ يَعْدِلُ إِذَا لَمْ أَكُنْ أَعْدِلُ، لَقَدْ خِبْتَ وَخَسِرْتَ إِنْ لَمْ أَكُنْ أَعْدِلُ ‘হে মুহাম্মাদ! ন্যায় বিচার করুন! জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমার ধ্বংস হৌক! যদি আমি ন্যায় বিচার না করি, তবে কে ন্যায় বিচার করবে? যদি আমি ন্যায় বিচার না করি, তাহ’লে তুমি নিরাশ হবে ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে’। তখন ওমর (রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন,دَعْنِى يَا رَسُولَ اللهِ فَأَقْتُلَ هَذَا الْمُنَافِقَ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ছেড়ে দিন, এই মুনাফিকটার গর্দান উড়িয়ে দিই। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,مَعَاذَ اللهِ أَنْ يَتَحَدَّثَ النَّاسُ أَنِّى أَقْتُلُ أَصْحَابِى إِنَّ هَذَا وَأَصْحَابَهُ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ يَمْرُقُونَ مِنْهُ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ ‘আল্লাহর নিকট পানাহ চাই! লোকেরা বলবে, আমি আমার সাথীদের হত্যা করছি। নিশ্চয় এই ব্যক্তি ও তার সাথীরা কুরআন তেলাওয়াত করে। যা তাদের কণ্ঠনালি অতিক্রম করে না। তারা সেখান থেকে বেরিয়ে যায়, যেমন ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে যায়’ (মুসলিম হা/১০৬৩ (১৪২)

ইবনু হাজার বলেন, ঐ ব্যক্তি দু’বার এরূপ কথা বলে। একবার হোনায়েনের গণীমত বণ্টনের সময়। দ্বিতীয়বার হোনায়েনের পর ইয়ামন থেকে আলী (রাঃ) প্রেরিত স্বর্ণ বণ্টনের সময়’।[1]

(২) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, ইয়ামন থেকে আলী (রাঃ) প্রেরিত অপরিশোধিত স্বর্ণ টুকরাটি রাসূল (ছাঃ) নাজদের চার নেতার মধ্যে ভাগ করে দেন। তারা হ’লেন, আক্বরা‘ বিন হাবেস আল-হানযালী, উয়ায়না বিন হিছন আল-ফাযারী, আলক্বামা বিন উলাছাহ আল-‘আমেরী এবং যায়েদ আল-খায়ের আত-ত্বাঈ। এতে কুরায়েশরা ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, আপনি নাজদের নেতাদের দিচ্ছেন, আর আমাদের বঞ্চিত করছেন। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,إِنِّى إِنَّمَا فَعَلْتُ ذَلِكَ لِأَتَأَلَّفَهُمْ ‘আমি এটা করছি তাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য’। এসময় একজন ন্যাড়ামুন্ডু ঘন দাড়িওয়ালা ব্যক্তি এসে বলল,اِتَّقِ اللهَ يَا مُحَمَّدُ ‘হে মুহাম্মাদ! আল্লাহকে ভয় কর’।... রাসূল (ছাঃ) বললেন,إِنَّ مِنْ ضِئْضِئِ هَذَا قَوْمًا يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ يَقْتُلُونَ أَهْلَ الإِسْلاَمِ وَيَدَعُونَ أَهْلَ الأَوْثَانِ يَمْرُقُونَ مِنَ الإِسْلاَمِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ لَئِنْ أَدْرَكْتُهُمْ لأَقْتُلَنَّهُمْ قَتْلَ عَادٍ ‘এ ব্যক্তির ঔরস থেকে একদল লোক বের হবে, যারা কুরআন তেলাওয়াত করবে। যা তাদের কণ্ঠনালি অতিক্রম করবে না। তারা মুসলমানদের হত্যা করবে এবং মূর্তিপূজারীদের ছেড়ে দিবে। তারা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে এমনভাবে, যেমন ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে যায়। যদি আমি তাদের পাই, তাহ’লে আমি অবশ্যই তাদের হত্যা করব, ‘আদ কওমকে হত্যা করার ন্যায়’ (মুসলিম হা/১০৬৪)। একই রাবী থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে,يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ رَطْبًا،... لَئِنْ أَدْرَكْتُهُمْ لأَقْتُلَنَّهُمْ قَتْلَ ثَمُودَ ‘যারা সুন্দরভাবে কুরআন তেলাওয়াত করবে।... যদি আমি তাদের পাই, তাহ’লে আমি অবশ্যই তাদের হত্যা করব, ছামূদ কওমকে হত্যা করার ন্যায়’ (বুখারী হা/৪৩৫১)

ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, আক্বরা বিন হাবেস ও অন্যান্য নেতাদের বেশী বেশী উট দেওয়ায় আনছারের জনৈক (মুনাফিক) ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে ইঙ্গিত করে বলে,مَا أَرَادَ بِهَا وَجْهَ اللهِ ‘এর দ্বারা তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করেননি’। একথা জানতে পেরে রাসূল (ছাঃ) অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। যাতে তাঁর চেহারা পরিবর্তিত হয়ে যায়। অতঃপর তিনি বলেন,رَحِمَ اللهُ مُوسَى قَدْ أُوذِىَ بِأَكْثَرَ مِنْ هَذَا فَصَبَرَ ‘আল্লাহ মূসার প্রতি রহম করুন! এর চাইতে তাঁকে বেশী কষ্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরেও তিনি ছবর করেছিলেন’ (বুখারী হা/৩১৫০, ৪৩৩৫)

(৩) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) আরও বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে,يَخْرُجُ فِى هَذِهِ الأُمَّةِ- وَلَمْ يَقُلْ مِنْهَا- قَوْمٌ تَحْقِرُونَ صَلاَتَكُمْ مَعَ صَلاَتِهِمْ، و فى رواية : يَحْقِرُ أَحَدُكُمْ صَلاَتَهُ مَعَ صَلاَتِهِمْ وَصِيَامَهُ مَعَ صِيَامِهِمْ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ يَمْرُقُونَ مِنَ الْإِسْلاَمِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ ‘এই উম্মতের মধ্যে (তিনি বলেননি, মধ্য হ’তে। অর্থাৎ তারা মুসলিম নামেই থাকবে) এমন এক দল লোক বের হবে, তাদের ছালাতের সাথে তোমরা নিজেদের ছালাতকে হীন মনে করবে। ‘তোমাদের কেউ নিজেদের ছালাতকে তাদের ছালাতের সঙ্গে এবং তোমাদের ছিয়ামকে তাদের ছিয়ামের সঙ্গে তুলনা করলে তোমাদের নিজেদের ছিয়াম ও ছালাতকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে। তারা কুরআন তেলাওয়াত করবে। কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা ইসলাম থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে, যেমন ধনুক হ’তে তীর বের হয়ে যায়’ (মুসলিম হা/১০৬৪ (১৪৭-৪৮)

(৪) আলী (রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন,سَيَخْرُجُ فِى آخِرِ الزَّمَانِ قَوْمٌ أَحْدَاثُ الْأَسْنَانِ سُفَهَاءُ الْأَحْلاَمِ يَقُولُونَ مِنْ خَيْرِ قَوْلِ الْبَرِيَّةِ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ، يَمْرُقُونَ مِنَ الدِّينِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ فَإِذَا لَقِيتُمُوهُمْ فَاقْتُلُوهُمْ فَإِنَّ فِى قَتْلِهِمْ أَجْرًا لِمَنْ قَتَلَهُمْ عِنْدَ اللهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘আখেরী যামানায় একদল তরুণ বয়সী বোকা লোক বের হবে, যারা পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর কথা বলবে। তারা কুরআন তেলাওয়াত করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা কুরআন তেলাওয়াত করবে। কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা দ্বীন থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাবে, যেমন ধনুক হ’তে তীর বের হয়ে যায়। যখন তোমরা তাদের পাবে, তখন তাদের হত্যা করবে। কেননা এদের হত্যাকারীর জন্য আল্লাহর নিকটে ক্বিয়ামতের দিন বিশেষ পুরস্কার রয়েছে’ (মুসলিম হা/১০৬৬ (১৫৪)। এই হত্যা সরকারী আদালতের মাধ্যমে হ’তে হবে (ঐ, শরহ নববী, মর্মার্থ)

যুল-খুইয়াইছিরাকে পরবর্তীতে আলী (রাঃ)-এর খেলাফতকালে (৩৫-৪১ হিঃ) সৃষ্ট চরমপন্থী দল ‘খারেজীদের মূল’(أَصْلُ الْخَوَارِجِ) বলা হয় (কুরতুবী, সূরা তওবা ৫৮ আয়াতের ব্যাখ্যা)

এসব মুনাফিকদের সম্পর্কে নাযিল হয়,وَمِنْهُمْ مَنْ يَلْمِزُكَ فِي الصَّدَقَاتِ فَإِنْ أُعْطُوا مِنْهَا رَضُوا وَإِنْ لَمْ يُعْطَوْا مِنْهَا إِذَا هُمْ يَسْخَطُونَ- وَلَوْ أَنَّهُمْ رَضُوا مَا آتَاهُمُ اللهُ وَرَسُولُهُ وَقَالُوا حَسْبُنَا اللهُ سَيُؤْتِينَا اللهُ مِنْ فَضْلِهِ وَرَسُولُهُ إِنَّا إِلَى اللهِ رَاغِبُونَ ‘আর তাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা ছাদাক্বা বণ্টনের ব্যাপারে তোমার প্রতি দোষারোপ করে। যদি তাদেরকে ছাদাক্বা থেকে কিছু দেওয়া হয়, তাহলে খুশী হয়। আর যদি না দেওয়া হয়, তাহ’লে তারা ক্রুদ্ধ হয়’। ‘কতই না ভাল হ’ত যদি তারা সন্তুষ্ট হ’ত আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাদেরকে যা দিয়েছেন তার উপরে এবং বলত, আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট। সত্বর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ থেকে দান করবেন। আর আমরা আমাদের পালনকর্তার প্রতি নিরত হলাম’।[2] যুগে যুগে ইসলামের নামে সরকার বিরোধী যত সশস্ত্র চরমপন্থী দলের উদ্ভব ঘটেছে, সবগুলিই হ’ল সেদিনকার রাসূল বিরোধী ও পরে আলী বিরোধী চরমপন্থীদের উত্তরসূরী।

[1]. ফাৎহুল বারী হা/৪৩৫১-এর আলোচনা; সীরাহ ছহীহাহ ২/৫১৪-টীকা।

[2]. তওবা ৯/৫৮-৫৯; কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর উক্ত আয়াত।