নবীদের কাহিনী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাদানী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি

মুসলিম বাহিনীর দুর্ধর্ষ আক্রমণে পর্যুদস্ত মুশরিক বাহিনী প্রাণভয়ে পালাতে থাকল। এ দৃশ্য দেখে তাদের ধরে রাখার জন্য আবু জাহল তার লোকদের উদ্দেশ্যে জোরালো ভাষণ দিয়ে বলেন, সোরাক্বার পলায়নে তোমরা ভেঙ্গে পড়ো না। সে আগে থেকেই মুহাম্মাদের চর ছিল। ওৎবা, শায়বা ও অলীদের মৃত্যুতেও ভীত হওয়ার কারণ নেই। কেননা তাড়াহুড়োর মধ্যে তারা মারা পড়েছেন। লাত ও ‘উযযার শপথ করে বলছি, ওদেরকে শক্ত করে রশি দিয়ে বেঁধে না ফেলা পর্যন্ত আমরা ফিরে যাব না। অতএব তোমরা ওদেরকে মেরো না। বরং ধরো এবং বেঁধে ফেল’।

কিন্তু আবু জাহলের এই তর্জন-গর্জন অসার প্রমাণিত হ’ল। বর্ষিয়ান ছাহাবী আব্দুর রহমান বিন ‘আওফকে আনছারদের বনু সালামাহ গোত্রের কিশোর দু’ভাই মু‘আয ও মু‘আউভিয বিন ‘আফরা পৃথকভাবে এসে জিজ্ঞেস করল يَا عَمِّ أَرِنِى أَبَا جَهْلٍ! أُخْبِرْتُ أَنَّهُ يَسُبُّ رَسُوْلَ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘চাচাজী! আবু জাহল-কে দেখিয়ে দিন। সে নাকি আমাদের রাসূলকে গালি দেয়’? তারা প্রত্যেকে পৃথকভাবে গোপনে এসে চাচাজীর কানে কানে একই কথা বলল। আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ বলেন, আমি ওদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা। ফলে বাধ্য হয়ে দেখিয়ে দিলাম। তখন ওরা দু’জন তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং মু‘আয প্রথম আঘাতেই আবু জাহলের পা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। এ সময় তার কাঁধে ইকরিমা বিন আবু জাহলের তরবারির আঘাতে মু‘আযের একটি হাত কেটে ঝুলতে থাকলে সে নিজের পা দিয়ে চেপে ধরে হেঁচকা টানে সেটাকে নিজ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। তারপর ছোট ভাই মু‘আউভিযের আঘাতে আবু জাহল ধরাশায়ী হ’লে তারা উভয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসে গর্বভরে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আবু জাহলকে আমি হত্যা করেছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমাদের তরবারি মুছে ফেলেছ কি? তারা বলল, না। তারপর উভয়ের তরবারি পরীক্ষা করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, كِلاَكُمَا قَتَلَهُ ‘তোমরা উভয়ে তাকে হত্যা করেছ’।[1] অবশ্য এই যুদ্ধে মু‘আউভিয বিন ‘আফরা পরে শহীদ হন এবং মু‘আয বিন ‘আফরা হযরত ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকাল (২৩-৩৫ হি.) পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।[2]

পরে আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ গিয়ে দেখেন যে, আবু জাহলের তখনও নিঃশ্বাস চলছে। তিনি তার দাড়ি ধরে মাথা কেটে নেবার জন্য ঘাড়ে পা রাখলে সে বলে ওঠে,وَهَلْ فَوْقَ رَجُلٍ قَتَلْتُمُوهُ ‘তোমরা কি এই ব্যক্তির চাইতে বড় কোন ব্যক্তিকে হত্যা করতে পেরেছ?’فَلَوْ غَيْرَ أَكَّارٍ قَتَلَنِيْ ‘ওহ্! আমাকে যদি (মদীনার) ঐ চাষাদের বদলে অন্য কেউ হত্যা করতো’![3] উল্লেখ্য যে, ইবনু মাসঊদ (রাঃ) মক্কায় ওক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বের বকরীর রাখাল ছিলেন (আল-বিদায়াহ ৬/১০২)। অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, ইবনু মাসঊদ তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,أَخْزَاكَ اللهُ يَا عَدُوَّ الله ‘আল্লাহ তোকে লাঞ্ছিত করুন রে আল্লাহর দুশমন!’ জবাবে আবু জাহল বলে ওঠে,وَبِمَاذَا أَخْزَانِي؟ هَلْ أَعْمَدُ مِنْ رَجُلٍ قَتَلْتُمُوهُ ‘কেন তিনি আমাকে লাঞ্ছিত করবেন? আমার চাইতে শ্রেষ্ঠ কোন ব্যক্তিকে তোমরা হত্যা করেছ কি?’[4] এখন বল, لِمَنِ الدّائِرَةُ الْيَوْمَ ‘আজ কারা জিতলো’। ইবনু মাসঊদ বললেন, للَّه وَلِرَسُولِهِ ‘আজকের জয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-এর জন্য’। বলেই তার মাথাটা কেটে নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে হাযির হ’লেন এবং বললেন, يَا رَسُولَ اللهِ، هَذَا رَأْسُ عَدُوِّ اللهِ أَبِي جَهْلٍ ‘হে আল্লাহর রাসূল! এটা হ’ল আল্লাহর দুশমন আবু জাহলের মাথা। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে ওঠেন, آلله الَّذِي لاَ إلَهَ غَيْرُهُ ‘আল্লাহর কসম? যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’। আমি বললাম, হ্যাঁ। আল্লাহর কসম! যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’। অতঃপর আমি তাঁর সামনে মাথাটি রেখে দিলাম তখন তিনি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললেন।[5] এভাবে মক্কার বড় ত্বাগূতটা শেষ হয়।


[1]. বুখারী হা/৩১৪১; মুসলিম হা/১৭৫২; মিশকাত হা/৪০২৮।

[2]. উল্লেখ্য যে, মু‘আয ও মু‘আউভিয উভয়ে তাদের বীরমাতা বনু নাজ্জারের ‘আফরা’ বিনতে ওবায়েদ বিন ছা‘লাবাহ-র দিকে সম্বন্ধিত হয়ে ইবনু ‘আফরা (ابْنَا عَفْرَاء) নামে পরিচিত ছিলেন (ইবনু হিশাম ১/৬৩৫ টীকা-৫)। পিতা ছিলেন বনু নাজ্জার-এর হারেছ বিন রিফা‘আহ বিন সাওয়াদ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৮১৬৮)। ‘আফরা-র মোট ৭ ছেলের প্রত্যেকে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং সবাই তাদের মায়ের নামে ইবনু ‘আফরা (ابن عفراء) নামে পরিচিত ছিলেন। ‘আফরার প্রথম স্বামী হারেছ-এর ঔরসে মু‘আয ও মু‘আউভিয জন্ম গ্রহণ করেন। অতঃপর তালাকপ্রাপ্তা হয়ে তিনি মক্কায় গমন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি বুকায়ের বিন ‘আব্দে ইয়ালীল লায়ছী-এর সাথে বিবাহিতা হন। তার ঔরসে ৪ পুত্র খালেদ, ইয়াস, ‘আক্বেল ও ‘আমের জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তালাকপ্রাপ্তা হ’লে তিনি মদীনায় ফিরে আসেন এবং পুনরায় পূর্ব স্বামী হারেছ-এর সাথে বিবাহিতা হন। তার ঔরসে ‘আওফ জন্মগ্রহণ করেন। এইভাবে তিনি মোট ৭টি পুত্র সন্তানের মা হন। যারা প্রত্যেকেই ছিলেন অত্যন্ত বীর ও বদরী ছাহাবী (ইবনু সা‘দ, আল-ইছাবাহ, উসদুল গাবাহ)। মু‘আয বিন ‘আফরার পিতা প্রখ্যাত আনছার নেতা ল্যাংড়া ছাহাবী ‘আমর ইবনুল জামূহ ছিলেন (আল-ইছাবাহ মু‘আয ক্রমিক ৮০৫৭; ইবনু হিশাম ১/৬৩৪, ৭১০) কথাটি সঠিক নয়। কেননা ঐ নামে বীর মাতা ‘আফরা বিনতে উবায়েদ-এর কোন স্বামী ছিলেন না (আল-ইছাবাহ ‘আফরা ক্রমিক ১১৪৮১)। সুহায়লী বলেন, এ ব্যাপারে সর্বাধিক বিশুদ্ধ হ’ল এই যে, তারা উভয়ে ছিলেন ‘আফরার পুত্র। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন, قَدْ ضَرَبَهُ ابْنَا عَفْرَاءَ ‘আফরার পুত্রদ্বয় তাকে হত্যা করেছে’ (মুসলিম হা/১৮০০; ইবনু হিশাম ১/৬৩৫ টীকা-৫)।

[3]. বুখারী হা/৪০২০; মুসলিম হা/১৮০০; মিশকাত হা/৪০২৯ ‘জিহাদ’ অধ্যায় ৭ অনুচ্ছেদ।

[4]. ইবনু হিশাম ১/৬৩৫; বুখারী হা/৩৯৬১; মুসলিম হা/১৮০০।

[5]. ইবনু হিশাম ১/৬৩৫-৩৬।

উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার মৃতদেহ দেখার পর বলেন,يَرْحَمُ اللهُ ابْنَيْ عَفْرَاءَ، فَهُمَا شُرَكَاءُ فِي قَتْلِ فِرْعَوْنَ هَذِهِ الْأُمَّةِ ‘আল্লাহ আফরার দুই পুত্রের উপর রহম করুন! তারা এই উম্মতের ফেরাঊনকে হত্যায় অংশীদার ছিল। আর ছিল ফেরেশতা এবং ইবনু মাসঊদ’ (আল-বিদায়াহ ৩/২৮৯)। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ। একইভাবে এ সময় রাসূল (ছাঃ) খুশীতে দু’রাক‘আত শুকরিয়ার ছালাত আদায় করেছিলেন মর্মে বর্ণিত হাদীছটিও যঈফ (ইবনু মাজাহ হা/১৩৯১)। ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, সিজদায়ে শুক্র ওয়াজিব নয় এবং মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারেও কথা রয়েছে’ (মজমূ‘ ফাতাওয়া ২১/২৯৩; মা শা-‘আ ১১৩-১৪ পৃঃ)।