নবীদের কাহিনী ২৫. হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাক্কী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি
ক্বোবায় অবতরণ ও মসজিদ স্থাপন (نزول قباء وبناء المسجد فيها)

একটানা আটদিন চলার পর ১৪ নববী বর্ষের ৮ই রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে সেপ্টেম্বর সোমবার দুপুরে ক্বোবা উপশহরে শ্বেত-শুভ্র বসনে তাঁরা অবতরণ করেন।[1] প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকলেও এদিন দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে না পাওয়ায় এবং সূর্য অধিক গরম হওয়ায় মুসলমানগণ স্ব স্ব বাড়ীতে ফিরে যান। এমন সময় জনৈক ইহূদী কোন কাজে একটি টিলার মাথায় উঠলে তাঁদের দেখতে পায় এবং সবাইকে খবর দেয় (বুখারী হা/৩৯০৬)। ক্বোবায় মানুষের ঢল নামে। হাযারো মানুষের অভ্যর্থনার মধ্যেও রাসূল (ছাঃ) ছিলেন চুপচাপ। তাঁর উপরে হযরত আবুবকর (রাঃ) চাদর দিয়ে ছায়া করলে লোকেরা রাসূল (ছাঃ)-কে চিনতে পারে। এ সময় তাঁর উপরে ‘অহি’ নাযিল হয়-فَإِنَّ اللهَ هُوَ مَوْلاَهُ وَجِبْرِيْلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمَلاَئِكَةُ بَعْدَ ذَلِكَ ظَهِيْرٌ ‘জেনে রেখ, আল্লাহ, জিব্রীল ও সৎকর্মশীল মুমিনগণ তার সহায়। উপরন্তু ফেরেশতাগণও তার সাহায্যকারী’।[2]

ক্বোবায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বনু আমর বিন ‘আওফ গোত্রের কুলছূম বিন হিদমের (كُلْثُومُ بْنُ هِدْم) বাড়ীতে অবস্থান করেন।[3] এদিকে হযরত আলীও মক্কায় তিনদিন অবস্থান করে গচ্ছিত আমানত সমূহ স্ব স্ব মালিককে ফেরত দানের পর মদীনায় চলে আসেন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সাথেই অবস্থান করতে থাকেন। ক্বোবাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১৪ দিন অবস্থান করেন (বুখারী হা/৪২৮)। এতে মতভেদ থাকলেও এ ব্যাপারে সকলে একমত যে, তিনি সোমবারে ক্বোবায় অবতরণ করেন এবং শুক্রবারে সেখান থেকে ইয়াছরিবের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এ সময়ে তিনি সেখানে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন ও সেখানে ছালাত আদায় করেন। এই মসজিদ সম্পর্কেই সূরা তওবা ১০৮ আয়াতেلَمَسْجِدٌ أُسِّسَ عَلَى التَّقْوَى ‘তাক্বওয়ার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মসজিদ’ বলে প্রশংসা করা হয়েছে। এটাই ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মসজিদ। যার প্রথম উদ্যোগী ছিলেন ‘আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ)। তিনিই রাসূল (ছাঃ)-কে এদিকে ইঙ্গিত দেন। অতঃপর পাথরসমূহ জমা করেন। অতঃপর প্রথমে রাসূল (ছাঃ) ক্বিবলার দিকে একটি পাথর রাখেন। অতঃপর আবুবকর (রাঃ) একটি রাখেন। অতঃপর বাকী কাজ ‘আম্মারের নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়’ (ইবনু হিশাম ১/৪৯৪, ৪৯৮- টীকাসহ)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইয়াছরিবে তাঁর দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিবের মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জারকে সংবাদ দেন। বনু নাজ্জার ছিল খাযরাজ গোত্রভুক্ত। তারা এসে সশস্ত্র প্রহরায় তাঁকে সাথে নিয়ে ইয়াছরিবের পথে যাত্রা করেন। ক্বোবা থেকে ইয়াছরিবের মসজিদে নববীর দূরত্ব হ’ল ১ ফারসাখ (ফাৎহুল বারী হা/৩৯০৬-এর আলোচনা) তথা ৩ মাইল বা ৫ কি.মি.।

বনু নাজ্জারকে রাসূল (ছাঃ)-এর মাতৃকুল বলার কারণ এই যে, রাসূল (ছাঃ)-এর প্রপিতামহ হাশেম বিন ‘আব্দে মানাফ এই গোত্রে বিবাহ করেছিলেন। সেকারণ মদীনাবাসীগণ মক্কার বনু হাশেমকে তাদের ‘ভাগিনার গোষ্ঠী’ (إِبْنُ أُخْتِنَا) বলে অভিহিত করতেন (ইবনু হিশাম ১/১৩৭ টীকা -২)

[1]. আর-রাহীক্ব পৃঃ ১৭০; ইবনু হিশাম ১২ই রবীউল আউয়াল সোমবার বলেছেন। টীকাকার সুহায়লী বলেন, বলা হয়েছে যে, এটি ছিল ৮ই রবীউল আউয়াল। যেমন বলা হয়েছে, তিনি গুহা থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন ১লা রবীউল আউয়াল সোমবার (ইবনু হিশাম ১/৪৯২, টীকা-৪)। ছহীহ মুসলিমে ‘রাত্রি’র (فَقَدِمْنَا الْمَدِينَةَ لَيْلاً) কথা এসেছে (মুসলিম হা/২০০৯)। এর ব্যাখ্যায় ইবনু হাজার বলেন, তাঁরা রাত্রি শেষে অবতরণ করেন এবং দিনে শহরে প্রবেশ করেন (ফাৎহুল বারী হা/৩৯০৬-এর আলোচনা)। অর্থাৎ তিনি মক্কার ছওর গিরিগুহা থেকে সোমবারে প্রত্যুষে রওয়ানা দিয়ে পরবর্তী সোমবার দুপুরে ক্বোবায় পৌঁছেন মোট ৮ দিনে।

[2]. আর-রাহীক্ব পৃঃ ১৭১; তাহরীম ৬৬/৪, যাদুল মা‘আদ ৩/৫২।

[3]. ত্বাবারাণী হা/৯৯২২; ইবনু হিশাম ১/৪৯৩। সুহায়লী বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর মদীনা আগমনের অল্প কিছু দিনের মধ্যেই কুলছূম বিন হিদম মৃত্যুবরণ করেন। তিনি আনছার ছাহাবীদের মধ্যে প্রথম মৃত্যু বরণকারী। তাঁর মৃত্যুর কয়েক দিন পরে মৃত্যুবরণ করেন আস‘আদ বিন যুরারাহ (ইবনু হিশাম ১/৪৯৩ টীকা-১); আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৭৪৪৯।