নবীদের কাহিনী ২৫. হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাক্কী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি

ত্বায়েফ থেকে ফেরার পথে জিনেরা কুরআন শুনে ইসলাম কবুল করে। জিনেরা দু’বার রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ১০ম নববী বর্ষে ত্বায়েফ সফর থেকে ফেরার পথে তিনি ওকায বাজারের দিকে যাত্রাকালে নাখলা উপত্যকায় ফজরের ছালাতে কুরআন পাঠ করছিলেন। তখন জিনেরা সেই কুরআন শুনে ইসলাম কবুল করল এবং তাদের জাতির কাছে ফিরে এসে বলল, হে আমাদের জাতি! إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآنًا عَجَبًا يَهْدِى إِلَى الرُّشْدِ فَآمَنَّا بِهِ، وَلَنْ نُشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَدًا ‘আমরা এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি, যা সঠিক পথ প্রদর্শন করে। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনো আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক করব না’ (জিন ৭২/১-২)।[1]

দ্বিতীয় বারের বিষয়ে ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘আমরা সবাই মক্কার বাইরে রাত্রিকালে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। কিন্তু এক সময় তিনি হারিয়ে গেলেন। আমরা ভয় পেলাম তাঁকে জিনে উড়িয়ে নিয়ে গেল, নাকি কেউ অপহরণ করল। আমরা চারদিকে খুঁজতে থাকলাম। কিন্তু না পেয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় রাত কাটালাম। রাতটি ছিল আমাদের জন্য খুবই ‘মন্দ রাত্রি’ (شَرُّ لَيْلَة)। সকালে তাঁকে আমরা হেরা পাহাড়ের দিক থেকে আসতে দেখলাম। অতঃপর তিনি আমাদের বললেন, জিনদের একজন প্রতিনিধি আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। আমি গিয়ে তাদেরকে কুরআন শুনালাম’। অতঃপর তিনি আমাদেরকে সাথে করে নিয়ে গেলেন এবং জিনদের নমুনা ও তাদের আগুনের চিহ্নসমূহ দেখালেন। অতঃপর বললেন, তোমরা শুকনা হাড্ডি ও গোবর ইস্তিঞ্জাকালে ব্যবহার করো না। এগুলি তোমাদের ভাই জিনদের খাদ্য’ (মুসলিম হা/৪৫০)। উল্লেখ্য যে, ইবনু মাসঊদ কর্তৃক আবুদাঊদে বর্ণিত হাদীছে কয়লার কথাও বলা হয়েছে (আবুদাঊদ হা/৩৯)।

ত্বায়েফ সফরের ঘটনাবলীতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব করলেন এবং সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে পুনরায় পথ চলতে শুরু করলেন। অতঃপর ‘নাখলা’ উপত্যকায় পৌঁছে সেখানকার জনপদে কয়েকদিন অবস্থান করলেন। এখানেই জিনদের প্রথম ইসলাম গ্রহণের ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। যা সূরা আহক্বাফ ২৯, ৩০ ও ৩১ আয়াতে এবং সূরা জিন ১-১৫ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তবে জিনদের কুরআন শ্রবণ ও ইসলাম গ্রহণের কথা তিনি তখনই জানতে পারেননি। বরং পরে সূরা জিন নাযিলের পর জানতে পারেন। অতঃপর সূরা আহক্বাফ ৩২ আয়াত নাযিল করে আল্লাহ তাকে নিশ্চিত করেছিলেন যে, কোন শক্তিই তার দাওয়াতকে বন্ধ করতে পারবে না। যেখানে আল্লাহ বলেন, وَمَن لاَّ يُجِبْ دَاعِيَ اللهِ فَلَيْسَ بِمُعْجِزٍ فِي الْأَرْضِ وَلَيْسَ لَهُ مِنْ دُوْنِهِ أَوْلِيَاءَ أُوْلَئِكَ فِيْ ضَلاَلٍ مُّبِيْنٍ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেয় না, সে ব্যক্তি এ পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাজিত করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত সে কাউকে সাহায্যকারীও পাবে না। বস্ত্ততঃ তারাই হ’ল স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত’ (আহক্বাফ ৪৬/৩২)। এতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মনের মধ্যে আরও শক্তি অনুভব করেন।

নাখলা উপত্যকায় ফজরের ছালাতে রাসূল (ছাঃ)-এর কুরআন পাঠ শুনে নাছীবাইন (نصيبين) এলাকার নেতৃস্থানীয় জিনদের ৭ বা ৯জনের অনুসন্ধানী দলটি তাদের সম্প্রদায়ের নিকটে গিয়ে যে রিপোর্ট দেয়, সেখানে বক্তব্যের শুরুতে তারা কুরআনের অলৌকিকত্বের কথা বলে। যেমন إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآناً عَجَباً- يَهْدِيْ إِلَى الرُّشْدِ فَآمَنَّا بِهِ وَلَن نُّشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَداً ‘আমরা বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি’। ‘যা সঠিক পথ প্রদর্শন করে। অতঃপর আমরা তার উপরে ঈমান এনেছি এবং আমরা আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে কখনোই শরীক করব না’ (জিন ৭২/১-২)। অতঃপর তারা বলে, وَأَنَّا ظَنَنَّا أَنْ لَّنْ نُّعْجِزَ اللهَ فِي الْأَرْضِ وَلَن نُّعْجِزَهُ هَرَبًا ‘আমরা নিশ্চিত যে, পৃথিবীতে আমরা আল্লাহকে পরাজিত করতে পারব না এবং তাঁর থেকে পালিয়েও বাঁচতে পারব না’ (জিন ৭২/১২)। সুহায়লী তাফসীরবিদগণের বরাতে বলেন, এই জিনগুলি ইহূদী ছিল। অতঃপর মুসলমান হয়’। এদের বক্তব্য এসেছে সূরা আহক্বাফ ২৯, ৩০ ও ৩১ আয়াতে’।[2]

উপরোক্ত ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) জিন ও ইনসানের নবী ছিলেন। বরং তিনি সকল সৃষ্ট জীবের নবী ছিলেন। যেমন তিনি বলেন, وَأُرْسِلْتُ إِلَى الْخَلْقِ كَافَّةً، وَخُتِمَ بِيَ النَّبِيُّوْنَ ‘আমি সকল সৃষ্ট জীবের প্রতি প্রেরিত হয়েছি এবং আমাকে দিয়ে নবীদের সিলসিলা সমাপ্ত করা হয়েছে’।[3] অন্য হাদীছে সূরা সাবা ২৮ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, فَأَرْسَلَهُ إِلَى الْجِنِّ وَالْإِنْسِ ‘অতঃপর আল্লাহ তাকে জিন ও ইনসানের প্রতি প্রেরণ করেছেন’।[4]

[1]. ইবনু হিশাম ১/৪২১-২২; বুখারী ফাৎহসহ হা/৪৯২১; মুসলিম হা/৪৪৯।

[2]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা আহক্বাফ ২৯, হা/৫৫০৪-০৫; ইবনু কাছীর, তাফসীর উক্ত আয়াত; মুসলিম হা/৪৪৯; ইবনু হিশাম ১/৪২২; আর-রউযুল উনুফ ১/৩৫৪।

[3]. মুসলিম হা/৫২৩; মিশকাত হা/৫৭৪৮ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ১ অনুচ্ছেদ।

[4]. দারেমী হা/৪৬; মিশকাত হা/৫৭৭৩ সনদ ছহীহ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় ১ অনুচ্ছেদ।