নবীদের কাহিনী ২৫. হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) - মাক্কী জীবন ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ১ টি

উক্ত গারানীক্ব কাহিনী পুরাপুরি মিথ্যা ও বানোয়াট। এর মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে মিথ্যা তোহমত চাপানো হয়েছে মাত্র। কেননা আল্লাহর ‘অহি’ ব্যতীত তিনি কুরআনের কোন কিছুই বর্ণনা করেননি (নাজম ৫৩/৩-৪)। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এরূপ মিথ্যা বর্ণনা থেকে তিনি সর্বদা নিরাপদ ও মা‘ছূম (হামীম সাজদাহ ৪১/৪১)। অতএব উক্ত বিষয়ে তাঁর নামে প্রচলিত কাহিনী পবিত্র কুরআন ও ইসলামের তাওহীদী আক্বীদার বিরোধী হওয়ায় পরিত্যক্ত। ছহীহ হাদীছ সমূহে এসবের কোনই ভিত্তি নেই।

দ্বিতীয় বিষয়টি এই যে, মুবারকপুরীর বক্তব্য অনুযায়ী ৫ম হিজরীর রামাযান মাসে (আর-রাহীক্ব ৯৩ পৃঃ) এই ঘটনা কিভাবে সম্ভব? অথচ পঠিত সূরা নাজম ১৩-১৮ আয়াতে মে‘রাজের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। যা হিজরতের কিছুদিন পূর্বে ১৩ নববী বর্ষে সংঘটিত হয় বলে সর্বাধিক বিশুদ্ধ মতে প্রমাণিত।

বস্ত্ততঃ শয়তানের এ ধোঁকাবাজি মক্কা ও মদীনায় সর্বদা চালু ছিল। যেমন মাদানী সূরা হাজ্জ-এর ৫২ আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُوْلٍ وَلاَ نَبِيٍّ إِلاَّ إِذَا تَمَنَّ أَلْقَى الشَّيْطَانُ فِي أُمْنِيَّتِهِ فَيَنْسَخُ اللهُ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ ثُمَّ يُحْكِمُ اللهُ آيَاتِهِ وَاللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ ‘আমরা তোমার পূর্বে যেসব রাসূল ও নবী প্রেরণ করেছি, তারা যখনই লোকদের নিকট আল্লাহর পক্ষ হ’তে কিছু পাঠ করেছে, তখনই শয়তান তার পাঠে নতুন কিছু নিক্ষেপ করেছে। অতঃপর শয়তান যা নিক্ষেপ করে আল্লাহ তা বিদূরিত করেন। অতঃপর আল্লাহ তার আয়াতসমূহকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (হাজ্জ ২২/৫২)।

অনেক মুফাসসির গারানীক্ব কাহিনীকে সূরা হজ্জ ৫২ আয়াতের শানে নুযূল হিসাবে বর্ণনা করেছেন, যা ঠিক নয়। কেননা উক্ত কাহিনী ছিল মক্কার এবং অত্র আয়াত নাযিল হয়েছে মদীনায়। জিন শয়তান সরাসরি অথবা তাদের দোসর মানুষ শয়তান এগুলি করে থাকে। তারা সর্বদা ইলাহী বিধানের বিরুদ্ধে তাদের চাকচিক্যময় কথার মাধ্যমে সন্দেহবাদ আরোপ করে ও মানুষকে আল্লাহর দাসত্ব থেকে বের করে শয়তানের তথা নিজেদের দাসত্বে ফিরিয়ে নেয়। এ বিষয়ে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে মক্কাতেই সাবধান করেছেন। যেমন মাক্কী সূরা আন‘আমের ১১২ আয়াতে আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِيْنَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوْحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُوْرًا وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ مَا فَعَلُوْهُ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُوْنَ ‘এভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য মানুষ ও জিনের মধ্য থেকে বহু শয়তানকে শত্রুরূপে নিযুক্ত করেছি। তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে একে অপরকে চাকচিক্যপূর্ণ কথা দ্বারা প্ররোচনা দেয়। যদি তোমার প্রভু চাইতেন, তাহ’লে তারা এটা করতে পারতো না। অতএব তুমি ওদেরকে ও ওদের মিথ্যা অপবাদসমূহকে ছেড়ে চল’ (আন‘আম ৬/১১২)। আজও ইসলামের সত্যিকারের খাদেমদেরকে উক্ত নীতি মেনে চলতে হবে এবং বাতিল হ’তে দূরে থেকে দ্বীনী দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। কেননা বাতিলের সঙ্গে মিশে থেকে বা আপোষ করে কখনো হক পালন বা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।[1]

[1]. প্রাচ্যবিদ স্টেনলি লেনপুল (১৮৫৪-১৯৩১) তাঁর গ্রন্থে উক্ত কাহিনী বর্ণনা শেষে মন্তব্য করেন, What wonder that a momentary thought crossed his mind to end the conflict by making a slight concession to the bigotry of his enemies ‘অর্থাৎ শত্রুপক্ষের সাথে সংঘর্ষ নিবৃত্ত করার উদ্দেশ্যে তাদের গোঁড়ামীর প্রতি কিছুটা রেয়াত দেওয়ার চিন্তা যদি সাময়িকভাবে তাঁর মনে এসেও থাকে তাতে বিস্ময়ের কি আছে’? অধিকন্তু তিনি বলেছেন, এটি সদুদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। আর এটি ছিল মুহাম্মাদের জীবনের একমাত্র পদস্খলন’। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ যদি জীবনে একবার মাত্র insincere বা কপট হয়ে থাকেন; আর কে-ই বা তা হন না; ... তারপর তিনি এজন্য যথেষ্ট অনুতাপ করেছিলেন’ (The Spirit of Islam P. 32)। আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) বলেন, (শী‘আ লেখক) মি. আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৮) নিজের সমর্থনের জন্য একথাগুলি যে কিভাবে উদ্ধৃত করলেন, তা আমরা ভেবে পাই না। তিনি উক্ত বক্তব্যটি কোনরূপ প্রতিবাদ ছাড়াই তাঁর বইয়ে উল্লেখ করায় অধিক ক্ষতি হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস’। এমনকি (হানাফী লেখক) শিবলী নোমানী (১৮৫৭-১৯১৪) তাঁর ‘সীরাতুন্নবী’ (১/১৭৬-৭৭ পৃঃ)-এর মধ্যে উক্ত বিষয়টি ‘হয়ে থাকবে’ ‘করে থাকবে’ ‘প্রকৃত কথা এই যে’ ইত্যাকারভাবে সংক্ষেপে আলোচনাটির পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন’ (মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মোস্তফা চরিত ৩৭৮-৭৯ পৃঃ)। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, খ্রিষ্টান লেখকের ইচ্ছাকৃত প্রগলভতার প্রতিবাদ না করে শী‘আ ও হানাফী লেখকদ্বয় কিভাবে দুর্বল হয়ে গেলেন? এগুলির মাধ্যমে মূল সত্যকে আড়াল করা হয়েছে মাত্র। ধন্যবাদ মাওলানা আকরম খাঁ-কে বৃটিশ শাসনামলে তাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের সাহসী লেখনীর জন্য।-লেখক।