যা ইতিপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে, তা হল হকের উপর নির্বিচল থাকা।

মহান আল্লাহ বলেছেন,

الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِم بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَن يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ ۗ وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا ۗ وَلَيَنصُرَنَّ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ

“তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ী হতে অন্যায়ভাবে বহিস্কৃত করা হয়েছে। শুধু এ কারণে যে, তারা বলে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। আল্লাহ যদি মানব জাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে বিধ্বস্ত হয়ে যেত খ্রিষ্টান সংসার-বিরাগীদের উপাসনা স্থান, গীর্জা, ইয়াহুদীদের উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ; যাতে অধিক স্মরণ করা হয় আল্লাহর নাম। আর আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য করেন যে তাকে (তার ধর্মকে) সাহায্য করে। আল্লাহ নিশ্চয়ই মহাশক্তিমান, চরম পরাক্রমশালী।” (হাজ্জঃ ৪০)।

يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ

“যারা বিশ্বাসী তাদেরকে আল্লাহ শাশ্বত বাণী দ্বারা ইহজীবনে ও পরজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখেন।” (ইব্রাহীমঃ ২৭)।

হুযাইফা (রাঃ) বলেছেন, প্রকৃত ভ্রষ্টতা হল, তুমি সেটাকে ভালো জানছ, যেটাকে আপত্তিকর জানতে এবং সেটাকে আপত্তিকর জানছ, যেটাকে ভালো জানতে! সাবধান! মহান আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে রঙ বদল করা (বহুরূপী হওয়া) থেকে দূরে থেকো। যেহেতু আল্লাহর দ্বীন এক।[১]

প্রিয় পাঠকমন্ডলী! আল্লাহ আপনাদের হিফাযত করুন। সম্ভবতঃ আপনাদের মনে পড়ে আহলুস সুন্নাহর ইমাম আহমাদের অবস্থান। যাকে মহান আল্লাহর পথে নির্যাতন করা হয়েছে। কিন্তু তিনি অটল থেকেছেন। তাকে বেত্রাঘাত করা হয়েছে। (রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ওয়া আরয়াহ) আল্লাহর পথে কষ্ট দেওয়া হয়েছে, তবুও তিনি হক কথা বলা থেকে পিছপা হননি।

আর ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) এর উপরেও আল্লাহর পথে নির্যাতন করা হয়েছে, তিনিও অবিচল থেকেছেন। (রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ওয়া আরয্বাহ।)

বলা বাহুল্য, হকের উপর অটল থাকা এই মানহাজের একটি আলামত। আর তাদেরও আলামত, যারা এ মানহাজে সত্যনিষ্ঠ বিজ্ঞ। আল্লাহর কসম! যে ব্যক্তি তাদের জীবন-কথা পাঠ করবে এবং সলফে সালেহর জীবন-চরিত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে, তার নিকট উক্ত বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাবে। আপনি ইমাম মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন সাহল রামলী (রাহিমাহুল্লাহ)র জীবন-কথা পড়ে দেখুন। এই আদর্শ ইমাম (রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু ওয়া আরহ)এর উপরে ভীষণভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে।

হাফেয যাহাবী ‘আসিয়ার’ গ্রন্থে তাঁর জীবন-কথায় উল্লেখ করেছেন, হাফেয আবু যার বলেছেন, 'বানী উবাইদ তাকে কারারুদ্ধ করে এবং সুন্নাহর ব্যাপারে তাঁকে শূলবিদ্ধ করে। আমি শুনেছি, দারাকুত্বনী তার কথা উল্লেখ করে কেঁদেছেন ও বলেছেন, ইমাম মুহাম্মাদ বিন আহমাদের যখন চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছিল, তখন তিনি বলছিলেন,

كان ذلك في الكتاب مسطورا

“এটা তো কিতাবে লিপিবদ্ধ ছিল।” আমি বলি, তার বারবার উক্ত আয়াতখন্ড পাঠ করা এ কথার দলীল যে, তিনি আল্লাহর ফায়সালা ও তকদীরে বিশ্বাসী (ও সন্তুষ্ট) ছিলেন।

ইবনুল আকফানী তার দেহের চামড়া ছাড়ানোর কাহিনী উল্লেখ করার পর বলেছেন, তার দেহের চামড়া যে ছাড়িয়েছে, সে ছিল। একজন ইয়াহুদী। এই ইয়াহুদী কসাইও তার এই কষ্টে কষ্ট পেয়ে তার প্রতি সদয় হয়েছিল এবং দয়া করেই তাঁর হৃৎপিন্ডে খঞ্জরাঘাত করে তাকে হত্যা করেছিল। তিনি বলেন, সুতরাং তার দেহের চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে তাতে জাব (গম-যবের কাঁচকি বা বিচালিচূর্ণ) ভর্তি করে শূলে চড়ানো হয়েছিল।[২]

তাকে শূলবিদ্ধ করা হয়েছিল সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার দোষে! যে জিনিসের জন্য তিনি ধৈর্যধারণ করতে পেরেছেন, কে পারবে তার মতো? (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।)।

ইমাম আবুল মুযাফফার সামআনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘আহলে হাদীস যে হকপন্থী, তার অন্যতম প্রমাণ এই যে, তুমি যদি তাঁদের গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন কর, যা তাদের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, প্রাচীন থেকে নব্য পর্যন্ত, তাদের দেশ ও কাল ভিন্ন-ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও, তাদের মাঝে দেশের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও, তাদের প্রত্যেকের ভিন্নভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করা সত্ত্বেও, তাঁদের লিখিত গ্রন্থসমূহ যদি অধ্যয়ন কর, তাহলে দেখবে, তাদের আকীদার বিবরণ-পদ্ধতি এক, ধরন অভিন্ন। তারা তাতে একই পন্থায় চলমান থাকেন, তার থেকে চত হন না এবং ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন না। তাতে তাদের বক্তব্য এক। তাদের কর্ম এক। তুমি তাদের মাঝে না কোন প্রকারের মতানৈক্য দেখতে পাবে, আর না সামান্য পরিমাণও কোন বিষয়ে বিভক্তি। বরং যদি তুমি তাদের জবানি ও তাঁদের সলফ থেকে উদ্ধৃত সকল বক্তব্য একত্রিত কর, তাহলে দেখতে পাবে, তার সবটাই যেন একই হৃদয়। থেকে আগত হয়েছে। একই জিহবা থেকে নিঃসৃত হয়েছে।

বলা বাহুল্য, হকের সপক্ষে এর থেকে স্পষ্ট কোন দলীল থাকতে পারে কি? মহান আল্লাহ বলেছেন,

أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ ۚ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِندِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا

“তারা কি কুরআন সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করে না? এ (কুরআন) যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো তরফ থেকে (অবতীর্ণ) হত, তাহলে নিশ্চয় তারা তাতে অনেক পরস্পর-বিরোধী কথা পেত।” (নিসাঃ ৮২)

তিনি আরো বলেছেন,

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا

“তোমরা সকলে আল্লাহর রশি (দ্বীন বা কুরআন)কে শক্ত করে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর; তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করলেন। ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে গেলে।” (আলে ইমরান : ১০৩)[৩]

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, 'তুমি দেখবে আহলুল কালাম (ফির্কা)র লোকেরা সবার চাইতে বেশি এক কথা থেকে অন্য কথায় ফিরে যায়। এক জায়গায় কোন কথা নিশ্চিতরূপে বলে অতঃপর অন্য জায়গায় তার বিপরীত কথা নিশ্চিতরূপে বলে এবং তার বক্তাকে কাফের আখ্যায়িত করে। আর এ হল নিশ্চিত বিশ্বাস না থাকার দলীল। যেহেতু ঈমান হল তাই, যা কাইসার বলেছিলেন, যখন আবু সুফিয়ানকে নবী (সা.)-এর সাথে ইসলামে দীক্ষিত মুসলিমদের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ কি দ্বীনে প্রবেশ করার পর তা অপছন্দ করে (মুর্তাদ হয়ে) ফিরে যায়?’ আবু সুফিয়ান বলেছিলেন, না, বাদশা বলেছিলেন, ‘অনুরূপ ঈমান। যখন তার প্রফুল্লতা হৃদয়ের সাথে মিশে যায়, তখন কেউ তা অপছন্দ করে না। (বুখারী ৭নং)

এই জন্য কিছু সলফ উমার বিন আব্দুল আযীয বা অন্য কেউ বলেছেন, 'যে ব্যক্তি নিজের দ্বীনকে তর্ক-বিতর্কের লক্ষ্যবস্তু বানাবে, তার দল-বদল বেশি হবে।

পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাহ ও আহলুল হাদীস, তাদের উলামা অথবা নেক জনসাধারণের ব্যাপারে কেউ জানে না যে, তিনি নিজ উক্তি অথবা আকীদা থেকে রুজু করেছেন। বরং এ বিষয়ে সকল মানুষের চাইতে তারাই বেশি ধৈর্যধারণ করে থাকেন; যদিও তাদেরকে নানা কষ্ট দিয়ে পরীক্ষায় ফেলা হয় এবং বিভিন্ন ফিতনায় ফেলে নিপীড়িত করা হয়। আর এ হল পূর্ববর্তী আম্বিয়া ও তাদের অনুগামিগণের অবস্থা; যেমন আসহাবুল উখদূদ এবং অনুরূপ আরো অন্যান্যদের অবস্থা। যেমন এই উম্মতের সলফ সাহাবা, তাবেঈন ও ইমামগণের অবস্থা।

মোটের উপর কথা, আহলুল কালাম ও ফালসাফা-ওয়ালা (দার্শনিক)দের চাইতে আহলুল হাদীস ও আহলুস সুন্নাহর অবিচলতা ও স্থিরতা অনেক গুণে বেশি।”[৪]

[১]. আবুল কাসেম বাগাবী ‘আল-জাদিয়াত ২/৩২০২নং, বাইহাক্বীর কুবরা ১০/৪২, লালকাঈ শারহু উসুলি ইতিক্বাদি আহলিস সুন্নাহ ১/১২০নং, হারেষ বিন আবু উসামাহ ‘আল-মুসনাদ’ ১/৪৭০নং

[২]. সিয়ারু আ'লামিন নুবালা’ ১৬/ ১৪৮

[৩]. তাঁর এ কথাগুলিকে তাঁর নিকট থেকে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ ‘স্বওনুল মান্ত্বিক ওয়াল-কালাম’ (১৬৫পৃষ্ঠা)তে উদ্ধৃত করেছেন।

[৪]. মাজমুউ ফাতাওয়া শাইখিল ইসলাম ৪/৫০