শির্ক আকবর (বড় শির্ক) তখন হবে যখন আপনি কাউকে আল্লাহর সমতুল্য বা সমকক্ষ (শরীক) স্থাপন করবেন। তাকে আপনি ডাকবেন; যেমন আল্লাহকে ডাকেন অথবা কোন প্রকার ইবাদত -যেমন বিপদে সাহায্য প্রার্থনা, যবেহ, ন্যর-নিয়াজ প্রভৃতি তার জন্য নিবেদন করবেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে ইবনে মসউদ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (সা.) -কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, কোন পাপ সর্বপেক্ষা বড়?” উত্তরে তিনি বললেন, “তোমার আল্লাহর সমকক্ষ স্থাপন করা অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” (সমকক্ষ অর্থাৎ সমতুল্য ও অংশীদার)।

শির্কে আকবরের প্রকারভেদ

১ দুআয় (প্রার্থনা ও ডাকার) শির্কঃ- রুজী অনুসন্ধান, রোগ নিরাময় প্রভৃতির উদ্দেশ্যে আম্বিয়া, আওলিয়া ইত্যাদি গায়রুল্লাহকে ডাকলে বা প্রার্থনা করলে এই শির্ক হয়। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تَدْعُ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ ۖ فَإِن فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِّنَ الظَّالِمِينَ

অর্থাৎ, তুমি আল্লাহ ব্যতীত এমন কাউকে আহবান করো না যে তোমার কোন উপকার করে না এবং অপকারও করে না। যদি তা কর, তাহলে তুমি যালেম (মুশরিক)দের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা ইউনুস ১০৬ আয়াত)

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে কোন শরীক (উপাস্য) কে ডাকা অবস্থায় মারা যায় সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (বুখারী)

আল্লাহ ব্যতীত মৃত বা জীবিতদেরকে (বিপদে) ডাকা বা তাদের নিকট কিছু প্রার্থনা করা (যা তাদের দেবার সাধ্য নেই) শির্ক। এ কথার দলীল আল্লাহ তাআলার এই বাণী,

وَالَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِهِ مَا يَمْلِكُونَ مِن قِطْمِيرٍ * إِن تَدْعُوهُمْ لَا يَسْمَعُوا دُعَاءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوا مَا اسْتَجَابُوا لَكُمْ ۖ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُونَ بِشِرْكِكُمْ ۚ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيرٍ

অর্থাৎ, এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা অতি তুচ্ছ। (খেজুরের আঁটির উপর পাতলা আবরণেরও) মালিক নয়। তোমরা তাদেরকে আহবান করলে তোমাদের আহবান তারা শুনবে না, আর শুনলেও তোমাদেরকে সাড়া দেবে না। তোমাদেরকে কিছুও দান করতে পারে না)। কিয়ামতের দিন তোমাদের ঐ শির্ককে তারা অস্বীকার করবে। সর্বজ্ঞ। (আল্লাহর) ন্যায় তোমাকে কেউই অবহিত করতে পারবে না। (সূরা ফাতির ১৩-১৪ আয়াত)

২। আল্লাহর গুণাবলীতে শিকঃযেমন এই বিশ্বাস যে, আম্বিয়া ও আওলিয়াগণ গায়েব (অদৃশ্যের খবর) জানেন। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ

অর্থাৎ- তাঁর নিকটেই গায়েবের চাবি। তিনি ব্যতীত তা আর কেউ জানে। না। (সূরা আনআম ৫৯ আয়াত)

৩। মহব্বতের শির্কঃ তা হল, আওলিয়া প্রভৃতিকে এমন ভালোবাসা ও ভক্তি করা যেমন আল্লাহকে ভালোবাসা ও ভক্তি করা হয়। এর দলীল আল্লাহ তাআলার এই বাণী,

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللَّهِ أَندَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ ۖ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِّلَّهِ

অর্থাৎ, কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর পরিবতে (তার) বিভিন্ন সমকক্ষ স্থির করে তাদেরকে এমন ভালোবাসে; যেমন আল্লাহকে বাসা হয়। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহর ভালোবাসায় সুদৃঢ়। (সূরা বাক্বারাহ ১৬৫ আয়াত)

৪৷ আনুগত্যের শির্কঃ

তা হল বৈধ মনে করে আল্লাহর অবাধ্যাচরণে (নাফরমানী করে) উলামা (ইমাম) ও পীর-বুযুর্গদের আনুগত্য করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ

অর্থাৎ, তারা আল্লাহর পরিবর্তে ওদের পন্ডিত (পাদরী) ও সংসার বিরাগীদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে। (সূরা তাওবাহ ৩১ আয়াত)

ওরা ওদের এক প্রকার উপাসনা করত। যে উপাসনার ব্যাখ্যা হল, আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা হালাল করে এবং তিনি যা হালাল করেছেন তা হারাম করে পাপ কাজে তাদের আনুগত্য করা।

মহানবী (সা.) বলেন, “স্রষ্টার অবাধ্যাচরণ করে কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই।” (সহীহ মুসনাদে আহমদ)

৫। সর্বেশ্বরবাদের শির্কঃ

অর্থাৎ এই বিশ্বাস যে, আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিতে আবির্ভূত। এই বিশ্বাস দেমাঙ্কে সমাধিস্থ সুফী ইবনে আরাবীর। এমনকি সে বলেছে,

প্রভু তো দাস, আর দাস হল প্রভু,

হায় যদি আমি জানতে পারতাম, ‘মুকাল্লাফ’

(শরীয়তের আজ্ঞাপ্রাপ্ত) কে ?!’

সর্বেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ভিন্ন এক সুফী কবি বলেছে,

‘কুকুর-শুকরও আমাদের উপাস্যই,

আল্লাহ তো গীর্জায় অবস্থানকারী পাদরীও!’(*)

৬ - নিয়ন্ত্রণকর্মের শির্কঃ এই বিশ্বাস যে, কিছু আওলিয়ার বিশ্ব-নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আছে, যারা বিশ্বকর্ম পরিচালনা করে থাকেন! যাঁদেরকে ‘কুতুব’ বলা হয়।

অথচ আল্লাহ তাআলা প্রাচীন মুশরিকদেরকে এই বলে প্রশ্ন করেন,

وَمَن يُدَبِّرُ الْأَمْرَ ۚ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ

অর্থাৎ,---এবং কে সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে?’ তখন তারা বলবে, ‘আল্লাহ।' (সূরা ইউনুস ৩১আয়াত)।

৭- ভয়ের শির্কঃ

এই বিশ্বাস যে, কিছু মৃত অথবা অনুপস্থিত আওলিয়ার প্রভাব ও অনিষ্ট করার ক্ষমতা আছে যা ঐ বিশ্বাসীর মনে ভয় সঞ্চার করে ফলে ওদেরকে ভয় করে। এই বিশ্বাস ছিল মুশরিকদের। এর প্রতি সতর্ক করে কুরআন বলে,

أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ ۖ وَيُخَوِّفُونَكَ بِالَّذِينَ مِن دُونِهِ

অর্থাৎ, আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন? অথচ তারা তোমাদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে অন্যের ভয় দেখায়। (সূরা যুমার ৩৬ আয়াত)

অবশ্য হিংস্র জন্তু এবং জীবিত কোন অত্যাচারী ব্যক্তি হতে প্রকৃতিগত ভয় শির্কের পর্যায়ভুক্ত নয়।

৮ - বিধান রচনার শির্কঃ

(৮) এই মতবাদে বিশ্বাসী জনৈক কবি এক জলাশয়ের প্রান্তে বসে থেকে দেখল যে,পদাপাতার উপর একটি ব্যাঙ বসে আছে। ইতিমধ্যে একটি সাপ তাকে আক্রমণ করতে চাইলে সে পানির মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। এ দৃশ্য দেখে সে গায়,

‘হরির উপরে হরি হরি শোভা পায়,

হরিকে দেখিয়া হরি হরিতে লুকায়!’-অনুবাদক

যে ব্যক্তি ইসলাম-পরিপন্থী বিধান প্রণয়ন ও প্রচলন করে মানুষের মনগড়া কানুনকে মানা বৈধ মনে করে অথবা ইসলামী সংবিধানকে অচল ভাবে তার এই শির্ক হয়। এতে শাসক ও শাসনাধীন ব্যক্তি এবং বিচারক ও বিচারাধীন ব্যক্তি সকলেই এই শির্কের পর্যায়ভুক্ত হবে, যদি বিচারাধীন ব্যক্তি ঐ কানুনে বিশ্বাসী ও ঐ বিচারে সন্তুষ্ট হয় তবে।

৯ - শির্কে আকবর আমল বিধংস করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

অর্থাৎ, অবশ্যই তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে যে, যদি তুমি শির্ক কর তাহলে নিশ্চয় তোমার আমল (সৎকর্ম) নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা যুমার ৬৫ আয়াত)

১০। সম্পূর্ণরূপে শির্ক ত্যাগ করে তওবা না করা পর্যন্ত আল্লাহ শির্কে আকবরের পাপ ক্ষমা করবেন না। তিনি বলেন,

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ ۚ وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا

অর্থাৎ, নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সহিত শির্ক করার পাপ ক্ষমা করেন না, এ ছাড়া অন্যান্য পাপ যার জন্য ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে দেন। আর যে আল্লাহর সহিত শির্ক করে, সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়। (সূরা নিসা ১১৬ আয়াত)।

১১। শির্ক বহু প্রকারের। যার কিছু শির্কে আকবর এবং কিছু আসগর; যা থেকে সতর্ক থাকা ওয়াজেব। রসূল ঐ আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, আমরা যেন এই দুআ করি,

اللهم إنا نعوذ بك من أن نشرك بك شيئا نعلمه و نستغفرك لما لا تعلم

উচ্চারণঃ- আল্লাহুম্মা ইন্না নাউযু বিকা মিন আন নুশরিকা বিকা শাইআন না’লামুহ, অনাস্তাগফিরুকা লিমা লা নালাম।

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমরা তোমার সহিত আমাদের কোন জানা বিষয়ে শরীক করা হতে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং অজানা বিষয়ে শির্কের পাপ হতে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। (ইমাম আহমাদ হাদীসটিকে হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন।)