আল্লাহ বিশ্বজগৎ রচনা করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য। বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য যুগে যুগে রসূল পাঠিয়েছেন। রসূলের প্রতি ঐশীগ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন, যাতে হক ও ন্যায়ের সাথে মানুষের মাঝে বিচার ও ফায়সালা হয়। যে বিচার-সংবিধান আল্লাহর বাণী ও রসূল (সা.)-এর উক্তিরূপে আমাদের নিকট মজুদ রয়েছে, যে বিধান ইবাদত, ব্যবহার, বিশ্বাস, ধর্মনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি মানুষের অন্যান্য কর্ম ও বিষয়ে পরিব্যাপ্ত।।

১- আকীদাহ বা বিশ্বাসের বিধানঃ রসূলগণ প্রথম যে বিষয় দ্বারা তাদের দাওয়াত আরম্ভ করেন, তা হল আকীদার সংশুদ্ধি এবং তওহীদ (একত্ববাদ)এর প্রতি মানুষকে আহ্বান। সুতরাং ইউসুফ ৭৫° কারাগারে তার দুই সঙ্গীকে তওহীদের প্রতি আহবান করলেন; যখন তারা তাদের স্বপ্নবৃত্তান্ত সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তখন বৃত্তান্ত বলার পূর্বে তিনি বললেন,

يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَأَرْبَابٌ مُّتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ * مَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنتُمْ وَآبَاؤُكُم مَّا أَنزَلَ اللَّهُ بِهَا مِن سُلْطَانٍ ۚ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

অর্থাৎ, হে কারা-সঙ্গীদ্বয়! ভিন্ন ভিন্ন বহু প্রতিপালক শ্রেয়, না এক পরাক্রমশালী আল্লাহ তাঁকে ছেড়ে তোমরা যাদের উপাসনা করছ, তা তো কতকগুলি নাম মাত্র, যা তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষরা রেখে নিয়েছে, যার কোন প্রমাণ আল্লাহ পাঠান নি। বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লাহরই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত আর কারো তোমরা উপাসনা করো না। এটিই সরল দ্বীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এ বিষয়ে অবগত নয়। (সূরা ইউসুফ ৩৯-৪০ আয়াত)

২ – ইবাদত সমূহে বিধানঃ নামায, যাকাত, রোযা, হজ্জ প্রভৃতি ইবাদতের যাবতীয় বিধান কুরআন ও সহীহ হাদীস হতে গ্রহণ করা আমাদের জন্য ওয়াজেব ও জরুরী। যেহেতু নবী (সা.) বলেন, “তোমরা সেই রূপে নামায পড় যে রূপে আমাকে পড়তে দেখেছ।” (বুখারী ও মুসলিম) “তোমরা আমার নিকট হতে হজ্জের বিধান গ্রহণ কর। (শিখে নাও।)”

আর সকল আয়েম্মায়ে মুজতাহেদীনগণ বলে গেছেন, হাদীস সহীহ হলে সেটাই আমার মযহাব।”

সুতরাং ইমামগণ কোন এক বিষয়ে পরস্পর মতভেদ করলে আমরা কারো উক্তির অন্ধ পক্ষপাতিত্ব করব না। বরং উদারচিত্তে তারই কথা ও মতের পক্ষপাতিত্ব করব যার কথার প্রমাণে কিতাব ও সুন্নাহ হতে সহীহ দলীল দেখব।*

৩। ক্রয়-বিক্রয়, লেন-দেন, ঋণ ও ভাড়া দেওয়া-নেওয়া প্রভৃতি ব্যবহারিক জীবনের বিধানও একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অধীনে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

অর্থাৎ, না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! ওরা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা ওদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-ভার তোমার উপর অর্পণ না করে, অতঃপর তোমার বিচারে ওদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে। তা মেনে নেয়। (সূরা নিসা ৬৫ আয়াত)

ব্যাখ্যাতাগণ এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ উল্লেখ করে বলেন যে, জমির সেচ নিয়ে দুই ব্যক্তি আপোসে কলহ-বিবাদ করে। এদের মধ্যে একজন ছিলেন নবী (সা.) -এর ফুফুতো ভাই যুবাইর। তারা রসূল (সা.) এর নিকট বিচারপ্রার্থী হলে তার বিচার যুবাইরের অনুকুলে হল। তিনি তাকেই তার প্রতিপক্ষের পুর্বে সেচের অধিকার দিলেন। অপর লোকটির প্রতিকূলে বিচার হলে সে তাকে বলল, 'ও আপনার ফুফুতো ভাই কিনা, তাই ওর সপক্ষে আপনি বিচার করলেন! এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হল। (বুখারী)। ৪। দন্ডবিধি ও সমপ্রতিশোধ দন্ডের বিধানও আল্লাহর। তিনি বলেন,

وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنفَ بِالْأَنفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ ۚ فَمَن تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَّهُ ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ

অর্থাৎ, আর আমি তাদের জন্য ওতে বিধান দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদল প্রাণ, চক্ষুর বদল চক্ষু, নাসিকার বদল নাসিকা, কর্ণের বদল কর্ণ, দন্তের বদল দন্ত এবং জখমের বদল অনুরূপ জখম। অতঃপর কেউ তা ক্ষমা করলে ওতে তারই পাপ মোচন হবে। আর আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই অত্যাচারী। (সূরা মায়েদাহ ৪৫ আয়াত)।

৫ - দ্বীন ও ধর্মনীতির বিধান দেবার সকল অধিকারও আল্লাহর। তিনি বলেন,

شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ

অর্থাৎ, তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন এমন দ্বীন যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি--- (সূরা শুরা ১৩ আয়াত)

মুশরিকরা দ্বীনি-বিধান রচনা করার ক্ষমতা গায়রুল্লাহকে দিয়েছিল, তাই আল্লাহ তাদের প্রতিবাদ করে বলেন,

أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُم مِّنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَن بِهِ اللَّهُ

অর্থাৎ, ওদের কি কতকগুলি অংশীদার (আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য উপাস্য) আছে যারা ওদের জন্য বিধান দিয়েছে এমন দ্বীনের, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? (সূরা শুরা ২১ আয়াত)

সারকথাঃ

সার কথা এই যে, কিতাব ও সহীহ সুন্নাহ দ্বারা জীবনের সকল সমস্যার সমাধান করা, তদনুসারে জীবন পরিচালনা করা এবং উভয়ের নিকট বিচারপ্রার্থী হওয়া সমস্ত মুসলিমের জন্য ওয়াজেব। যেহেতু আল্লাহর নির্দেশ,

وَأَنِ احْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ

অর্থাৎ, এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তুমি তদনুযায়ী ওদের মধ্যে বিচার-নিষ্পত্তি কর। (সূরা মায়েদাহ ৪৯ আয়াত)

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “--এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের নেতারা (শাসক গোষ্ঠী ও ইমামগণ) আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী বিধান (ও ফায়সালা) না দেয় এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা বরণ না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাদের মাঝে গৃহদ্বন্দ্ব বহাল রাখেন।” (হাসান ইবনে মাজাহ প্রভৃতি বর্ণনা করেছেন।

মুসলিমদের জন্য এও ওয়াজেব যে, তারা যেন নিজেদের দেশ ও রাষ্ট্র থেকে বিদেশী আইন যেমন ইউরোপীয়, ফরাসী প্রভৃতি কানুন - যা ইসলামী কানুনের পরিপন্থী তা বাতিল করে এবং সেই সমস্ত বিচারালয়ে বিচারপ্রার্থী না হয়। যেখানে ইসলামী আইনের পরিপন্থী আইন দ্বারা বিচার-মীমাংসা করা হয়। বরং আস্থাভাজন উলামাদের নিকট ইসলামী সংবিধানের কাছে নিজেদের বিবাদবিসম্বাদের বিচার প্রার্থনা করবে। আর এটাই তাদের জন্য শ্রেয়। কারণ ইসলাম তাদের মাঝে ন্যায্য বিচার করে প্রত্যেকের ন্যায্য প্রাপ্য প্রদান করবে।

আর এতে তাদের বহু অর্থ ও সময় বাচবে; যা রাষ্ট্রীয় আদালত সমূহে অনর্থক কোন উল্লেখযোগ্য উপকার ছাড়াই বিনষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া মানুষের মনগড়া কানুনের নিকট বিচারপ্রার্থী হওয়াতে কিয়ামতে বড় শাস্তি তো আছেই। কারণ তারা আল্লাহর ন্যায়পরায়ণ আইন ও বিচার হতে বৈমুখ্য প্রকাশ করে যালেম সৃষ্টির গড়া আইন ও বিচারের আশ্রয় নেয়।

* প্রকাশ যে, চার মযহাবের একটার তকলীদ (অন্ধানুকরণ) করা ওয়াজেব’-কথাটি ভিত্তিহীন। ইমামগণ নিজেরাই এর খন্ডন করে গেছেন। রাহেমাহুমুল্লহু আজমাঈন। এ বিষয়টি সাদিসম্মতও নয়। বরং এটা ছিল বিবাদ ও ফিতনা এড়াবার মানসে Principle of excluded middle- এর নীতি। -অনুবাদক।