উলামা আম্বিয়ার উত্তরাধিকারী। সকল নবী (সা.) প্রথম যে কথার প্রতি আহবান করেন তা হল তওহীদ। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

অর্থাৎ, অবশ্যই আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রসূল প্রেরণ করেছি এই নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহরই ইবাদত কর এবং তাগুত বর্জন কর। (সূরা নাহল ৩৬ আয়াত)

(তাগুত বলা হয় প্রত্যেক সেই ব্যক্তিকে, যাকে আল্লাহর পরিবর্তে পূজা ও মান্য করা হয় এবং সে উক্ত পূজায় সম্মত ও সন্তুষ্ট থাকে।)

এই জন্যই আলেম সমাজের উচিত তাই দিয়ে দাওয়াত শুরু করা; যা দিয়ে রসূলগণ করেছিলেন। অতএব দাওয়াতের প্রারম্ভে মানুষকে সকল প্রকার ইবাদতে বিশেষ করে দুআ ও প্রার্থনা করাতে আল্লাহর তওহীদের (আল্লাহকে একক উপাস্য মানার) প্রতি আহবান করা কর্তব্য। যেহেতু দুআ সম্পর্কে আল্লাহর রসূল (সা.) বলেন, “দুআই তো ইবাদত।” (তিরিমযী এবং তিনি এটিকে হাসান বলছেন)।

বর্তমানযুগে অধিকাংশ মুসলমান শির্ক এবং গায়রুল্লাহকে ডাকাতে এবং তাদের নিকট প্রার্থনা ও আবেদন করাতে অভ্যাসী হয়ে পড়েছে। যা তাদের এবং পূর্ববর্তী জাতির দুর্দশার মূল কারণ। যে সব জাতি সমূহকে আল্লাহর পরিবর্তে আওলিয়াগণকে ডাকার কারণে তিনি ধ্বংস করে দিয়েছেন।

তওহীদ প্রতিষ্ঠা এবং শির্ক উচ্ছেদকরণের প্রতি উলামাগণের বিভিন্ন প্রকার ভূমিকা পরিদৃষ্ট হয়ঃ

১। প্রথম প্রকার উলামা যারা তওহীদ, তার গুরুত্ব ও প্রকারভেদ উপলদ্ধি করেছেন, শির্ক ও তার প্রকারভেদ জেনেছেন। অতঃপর তারা তাদের কর্তব্য পালনে সক্রিয় হয়েছেন। তওহীদ ও শির্ক মানুষের নিকট খোলাখুলি ও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। যাদের দলীল কুরআন কারীম এবং সহীহ সুন্নাহ (হাদীস)। এই শ্রেণীর উলামাগণ মিথ্যা অপবাদের সম্মুখীন হয়েছেন যেমন আম্বিয়াগণ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা পশ্চাৎপদ না হয়ে ধৈর্যের সাথে স্বকর্তব্য পালন করেছেন। তাঁদের আদর্শ নীতিবাক্য হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার বাণী,

وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا يَقُولُونَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيلًا

অর্থাৎ, লোকে যা বলে, তাতে তুমি ধৈর্য ধারণ কর এবং সৌজন্য সহকারে ওদেরকে উপেক্ষা করে চল। (সূরা মুযযাম্মিল ১০ আয়াত)

প্রাচীনকালে লুকমান হাকীম তাঁর পুত্রকে অসিয়ত করে বলেছিলেন,

يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا أَصَابَكَ ۖ إِنَّ ذَٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ

অর্থাৎ, হে বৎস! যথাযথভাবে নামায পড়বে, সৎকাজের নির্দেশ দেবে, অসৎকাজে বাধা দান করবে এবং বিপদে ও কষ্টে ধৈর্য ধারণ করবে। নিশ্চয় এসব দৃঢ় সংকল্পের কাজ। (সূরা লুকমানঃ ১৭ আয়াত)

২। দ্বিতীয় প্রকার উলামা যারা তওহীদের প্রতি দাওয়াতকে উপেক্ষা ও অবহেলা করেছেন, যে তওহীদ হল ইসলামের মূল বুনিয়াদ। ফলে তারা মুসলিমদের আকীদাহ ও বিশ্বাস সংশোধন না করে তাদেরকে নামাযে যত্নবান হতে, আল্লাহর বিধান রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা (কল্পে সংগঠন) করতে এবং তাঁর পথে জিহাদ করতে আহ্বান করেছেন। (অর্থাৎ বিনা ভিত্তিতে ইমারত গড়ার প্রচেষ্টা করেছেন। যেন তাঁরা আল্লাহ তাআলার এই বাণী শ্রবণ করেননি,

وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ

অর্থাৎ, ওরা যদি শির্ক করত, তবে ওদের সকল কৃতকর্ম পন্ড হয়ে যেত। (সূরা আনআম ৮৮ আয়াত)

অথচ তারা যদি রসূলগণের মত অন্যান্য আমলের পুর্বে তওহীদকে অগ্রণী করতেন তাহলে তাদের দাওয়াত সাফল্যমন্ডিত হত এবং আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতেন যেমন নবী ও রসূলগণকে তিনি সাহায্য করেছেন। তিনি বলেন,

وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَىٰ لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّن بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا ۚ يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا ۚ وَمَن كَفَرَ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ

অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে আল্লাহ তাদেরকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি অবশ্যই পৃথিবীতে তাদেরকে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন যেমন তিনি তাদের পূর্ববর্তীদেরকে প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন। তিনি অবশ্যই তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে -যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন সুদৃঢ় করবেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার উপাসনা করবে, আর আমার সহিত কিছুকে অংশী স্থাপন করবে না। অতঃপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারাই সত্যত্যাগী (ফাসেক)। (সূরা নূর ৫৫ আয়াত)

সুতরাং বিজয়ের বুনিয়াদী শর্ত হল তওহীদ প্রতিষ্ঠাকরণ।

৩। তৃতীয় প্রকার উলামা ও দাওয়াত পেশকারী, যারা লোকেদের আক্রমণের ভয়ে অথবা নিজ চাকুরী, পদ বা গদি যাবার ভয়ে তওহীদের প্রতিষ্ঠা ও শির্ক উমুলনকল্পে দাওয়াত ত্যাগ করে বসেছেন। আর এতে তারা সেই ইলম (জ্ঞান) গুপ্ত করেছেন যা মানুষের মাঝে প্রচার করতে আদিষ্ট ছিলেন। ফলে আল্লাহর এই বাণী তাদের জন্য নিরূপিত হয়েছে,

إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَىٰ مِن بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ ۙ أُولَٰئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ

অর্থাৎ, আমি যেসব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথ-নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, মানুষের জন্য খোলাখুলিভাবে কিতাবে আমার ব্যক্ত করার পরও যারা ঐ সকল গোপন রাখে। আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ দেন এবং অভিশাপদাতারাও তাদেরকে অভিশাপ দেয়। (সূরা বাক্বারাহ ১৫৯ আয়াত)

যারা দ্বীনের দাওয়াত দেন তাদের বাঞ্ছনীয় গুণ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,

الَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالَاتِ اللَّهِ وَيَخْشَوْنَهُ وَلَا يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلَّا اللَّهَ

অর্থাৎ, যারা আল্লাহর বাণী প্রচার করে, তাকে ভয় করে এবং আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে ও ভয় করে না। (সূরা আহযাব ৩৯ আয়াত)

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন ইলম (জ্ঞান) গোপন করে আল্লাহ তার মুখে আগুনের লাগাম দেবেন।” (সহীহ মুসনাদে আহমদ)

৪। চতুর্থ প্রকার উলামা ও পীরের দল; যারা তওহীদের প্রতি দাওয়াত, একমাত্র আল্লাকেই ডাকা এবং তিনি ছাড়া অন্য কোন নবী (সা.), ওলী বা মৃতকে না ডাকার নীতির বিরোধিতা করেন। কারণ এঁদের নিকট নবী (সা.)-ওলীকে ডাকা (অসীলা করা) বৈধ তাই। যে আয়াতে গায়রুল্লাহকে ডাকতে নিষিদ্ধ ও সাবধান করা হয়েছে সেই আয়াতকে এঁরা কেবল (অমুলিম) মুশরিকদের জন্য নিরূপিত করেন এবং মনে করেন যে, মুসলমানদের মধ্যে মুশরিকদের পর্যায়ভুক্ত কেউ নেই! যেন তাঁরা আল্লাহ তাআলার এই বাণী শ্রবণ করেননি,

الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ أُولَٰئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُونَ

অর্থাৎ, যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে কোন যুম দ্বারা কলুষিত করেনি তাদের জন্যই রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই সৎপথপ্রাপ্ত। (সূরা আনআম ৮২ আয়াত)

উক্ত আয়াতে যুলমের অর্থ হল শির্ক। এর দলীল আল্লাহর এই বাণী,

إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ

অর্থাৎ, অবশ্যই শির্ক মহা যুলম। (সূরা লুকমান ১৩ আয়াত)

সুতরাং উল্লেখিত আয়াতে একথাই সুস্পষ্ট হয় যে, মুসলিম এবং মু'মিনও শির্কে আপতিত হয়; যেমন বহু মুসলিম বিশ্বের মুসলিমদের বর্তমান পরিস্থিতি। পক্ষান্তরে ওঁরা, যারা নবী (সা.)-ওলীকে বিপদে ডাকা বা অসীলা মানা বৈধ বলে মানুষকে ফতোয়া দেন, মসজিদের ভিতর মৃত সমাধিস্ত করা, কোন ওলীর কবরের তওয়াফ করা, আওলিয়াদের নামে নর-নিয়ায পেশ করা প্রভৃতি বিদআত ও শরীয়ত-বিরোধী আচরণকে বৈধ ও সমীচীন বলে ঘোষণা করেন - তাদের ব্যাপারে রসূল ধ্রুকু মুসলিমকে সাবধান ও সতর্ক করেছেন; তিনি বলেন, “আমি আমার উম্মতের উপর ভ্ৰষ্টকারী ইমাম (আলেম ও নেতা প্রভৃতি)র দলকেই ভয় করি।” (সহীহ তিরমিযী) আযহারের এক প্রয়াত ওস্তাদকে কবরের প্রতি সম্মুখ করে নামায বৈধতার প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'কবরের প্রতি সম্মুখ করে নামায বৈধ হবে না কেন? এই দ্যাখেন না, রসুলুল্লাহর কবর মসজিদের ভিতরেই এবং লোকেরা তাঁর কবরের প্রতি মুখ করে নামায পড়ে থাকে?

অথচ রসূল (সা.) এর দাফন মসজিদের ভিতর হয়নি বরং আয়েশা (রাঃ) এর। হুজরায় তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। পরন্তু তিনি কবরের প্রতি সম্মুখ করে নামায পড়তে নিষেধ করে গেছেন। রসূল (সা.) দুআ করতেন,

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لاَ يَنْفَعُ

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমি সেই ইম হতে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যা কোন লাভ দেয় না। (মুসলিম) (অর্থাৎ এমন ইলম হতে পানাহ চাচ্ছি যা আমি অপরকে শিখাই না, যার উপর আমল করি না এবং যার দ্বারা আমার চরিত্রও পরিবর্তিত হয় না।)

৫। যারা আপন মুরশিদ ও হুজুরদের কথাই অন্ধভাবে মান্য করে থাকে এবং আল্লাহর অবাধ্যাচরণ করে তাদের আনুগত্য ও অনুকরণ করে বস্তুতঃ তারা। রসূল (সা.) এর এই বাণীর বিরুদ্ধাচরণ করে। তিনি বলেন, “স্রষ্টার অবাধ্যতা করে কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই।” (সহীহ, মুসনাদে আহমদ)

অবশ্যই এই আনুগত্যের দরুন তারা কিয়ামতে লাঞ্ছিত হবে। আর তখন লাঞ্ছনা কোন উপকার দেবে না। কাফেরদল ও তাদের পথ অনুসরণকারীদের শাস্তি বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন,

يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا * وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا * رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا

অর্থাৎ, যেদিন অগ্নিতে ওদের মুখমণ্ডল উল্টে-পাল্টে দগ্ধ করা হবে সেদিন ওরা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করতাম।” তারা আরো বলবে, হে আমাদের প্রভু! আমরা আমাদের নেতা ও বুযুর্গদের আনুগত্য করেছিলাম এবং ওরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল ; হে আমাদের। প্রতিপালক! ওদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং মহা-অভিসম্পাত করুন। (সূরা আহযাব ৬৬-৬৮ আয়াত)

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে কাসীর বলেন, “অর্থাৎ, আমরা আমাদের আমীর (নেতা) এবং উলামা ও পীর-বুযুর্গদের অনুকরণ, আর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলাম। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম যে, ওদের নিকট কিছু আছে এবং ওরা কিছুর উপর প্রতিষ্ঠিত আছে। (অর্থাৎ প্রকৃত সত্য ওদের নিকটেই আছে এবং ওব্রা প্রকৃত সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আজ দেখছি,) ওরা কিছুরই উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না।”