(১) বিদআত কুফরের ডাকঘর। বিদআতীদের বহু ফির্কা তাদের বিদআতের মাধ্যমে কুফরে পৌছে কাফের হয়ে গেছে; যদিও বা তারা নিজেদের পরিচয় মুসলিম বলেই দিয়ে থাকে। যেমন ‘কামেল পীর বা দরবেশদের উপর থেকে শরয়ী বন্ধন তুলে নেওয়া, তাদেরকে আল্লাহর কিছু বৈশিষ্ট্যে (যেমন, গায়েব জানা, মসীবত দুর করা, সন্তান দান করা প্রভৃতির ব্যাপারে) শরীক করা, তাদের কবর সিজদা করা, বা তওয়াফ করা। কাবীরাহ গোনাহকারী মুসলিমকে কাফের জ্ঞান করা ইত্যাদি। যারা কিছু আমল ও ইবাদত তো করে কিন্তু ঐরূপ বিদআতের পাশে কোনই মূল্য নেই। আল্লাহ পাক বলেন,

وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَعْمَالُهُمْ كَسَرَابٍ بِقِيعَةٍ يَحْسَبُهُ الظَّمْآنُ مَاءً حَتَّىٰ إِذَا جَاءَهُ لَمْ يَجِدْهُ شَيْئًا

অর্থাৎ, যারা কুফরী করে (সত্য প্রত্যাখ্যান করে) তাদের কর্ম মরুভূমির মরীচিকার ন্যায়, পিপাসার্থ যাকে পানি মনে করে; কিন্তু সে ওর নিকট উপস্থিত হলে দেখে তা কিছুই নয়। (সূরা নুর ৩৯ আয়াত)

(২) বিদআতীরা আল্লাহর উপর বিনা ইলমে অনুমান-প্রসূত কথা বলে। সাধারণতঃ বাতেনী দাবীদাররা এই রোগের রোগী। যারা কলবে জ্ঞানার্জন করে থাকে, কুরআন হাদীস ও তফসীরের ইলমে কোন প্রকারের অনুরাগ প্রকাশ করে না, সলফের পথ জানার কোন ইচ্ছা রাখে না। বরং মনগড়া বাতেনী ইলম দ্বারা স্বপ্ন ও পরিকল্পিত কাশফ দ্বারা এবং ত্রিশ এর অধিক পারা কুরআন (?) দ্বারা ভক্তদের মনোরঞ্জন করে থাকে। শরীয়তের উর্ধ্বে থেকে মারেফতীর দাবী করে সবকাজে ফুর্তি মারে। আর এ সবের মাধ্যমে প্রকৃত ইলম ছাড়াই আল্লাহ ও তদীয় রসূলের উপর হলাহল মিথ্যা বলে। যা বান্দার জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। (সূরা আ'রাফ ৩৩ আয়াত)। মহান আল্লাহ নিজ নবীর জন্য বলেন,

وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ (44) لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ (45) ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ (46) فَمَا مِنكُم مِّنْ أَحَدٍ عَنْهُ حَاجِزِينَ (47) وَإِنَّهُ لَتَذْكِرَةٌ لِّلْمُتَّقِينَ (48) وَإِنَّا لَنَعْلَمُ أَنَّ مِنكُم مُّكَذِّبِينَ (49)

অর্থাৎ, সে যদি কিছু রচনা করে আমার নামে চালাতে চেষ্টা করত, তবে আমি তাকে কঠোর হস্তে দমন করতাম এবং তার কণ্ঠশিরা কেটে দিতাম, তখন। তোমাদের কেউই তাকে রক্ষা করতে পারত না। (সূরা হাক্কাহ ৪৪-৪৯ আয়াত)।

আল্লাহর রসুল (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকত আমার উপর মিথ্যা বলে, সে যেন। নিজের ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়।” (বুখারী ও মুসলিম)। অনুরূপভাবে শির্ক ও কুফরীর মূলও আল্লাহর নামে মিথ্যা রচনা। যেহেতু মুশরিক অজ্ঞভাবেই মনে করে যে, সে যার পুজা করে সেই মা'বুদ তাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করবে, তাঁর সামীপ্য দান করবে, তাঁর নিকট সুপারিশ করবে এবং অসীলা বা মাধ্যম হয়ে তাঁর নিকট থেকে তার প্রয়োজন মিটাবে। এ সব অমূলক ধারণা তার কল্পনাপ্রসূত। তাই প্রত্যেক মুশরিক আল্লাহর উপর মিথ্যা ধারণা ও রচনা করে থাকে। আর এইরূপ ধারণা ও অনুমানই বিদআতীকে বিদআতে উৎসাহিত করে। (মাদারেজুস সালেকীন)।

আর “যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে কিংবা তাঁর নিদর্শনসমূহকে প্রত্যাখ্যান করে তার অপেক্ষা বড় অত্যাচারী আর কে?” (সূরা আ'রাফ ৩৭ আয়াত)।

(২) বিদআতীরা সুন্নাহ ও আহলে সুন্নাহর প্রতি নিতান্ত বিদ্বেষ ও ঘৃণা পোষণ করে। উল্টোভাবে নিজেদেরকে আহলে সুন্নাহ’ এবং প্রকৃত আহলে সুন্নাহকে ‘কাফের’, ‘ওয়াহাবী ইত্যাদি বলে। অন্ধকার বলে, আলো তুমি নহ ভালো!” বিদআতীরা আহলে সুন্নাহকে বিভিন্নভাবে অপবাদ দিয়ে মন্দ নামে অভিহিত করেছে। যেমন মক্কার মুশরেকীনরা প্রিয় নবী (সা.)-কে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে কেউ বলেছিল, 'যাদুকর’, কেউ বলেছিল, গণক, কেউ বলেছিল, ‘কবি’, কেউ বলেছিল ‘পাগল’, কেউ বলেছিল ‘বিকার গ্রস্ত’, আবার কেউ বলেছিল, 'মিথ্যারচনাকারী মিথ্যক’ ইত্যাদি। অথচ তিনি এ সব অপবাদ থেকে পবিত্র ছিলেন। আল্লাহ বলেছিলেন,

انظُرْ كَيْفَ ضَرَبُوا لَكَ الْأَمْثَالَ فَضَلُّوا فَلَا يَسْتَطِيعُونَ سَبِيلًا

অর্থাৎ, দেখ ওরা তোমার জন্য কি উপমা দেয় ফলে ওরা পথ ভ্রষ্ট হয়ে গেছে এবং ওব্রা পথ পাবে না। (সূরা ইসরা ৪৮ আয়াত)

তদনুরূপ আহলে সুন্নাহ বা সালাফীগণও যাবতীয় অপবাদ থেকে পবিত্র। যেহেতু তারা উজ্জ্বল সুন্নাহ, সন্তোষজন চরিত্র, সরল পথ এবং শক্ত, চুড়ান্ত ও অকাট্য দলীলের ধারক ও বাহক। আল্লাহ আয্যা অজাল্ল যাদেরকে তাঁর কিতাব ও অহীবাণীর অনুসরণ এবং তাঁর রসুলের চরিতাদর্শের অনুকরণ করার তওফীক ও প্রেরণা দান করেছেন। যারা তাঁর অনুকরণে মানুষকে সৎকথা ও কাজের নির্দেশ এবং অসৎ কথা ও কাজে বাধা দান করে থাকে এবং জীবনের প্রতি মুহূর্তে তাঁরই চরিত ও সুন্নাহর অনুসারী থাকে। যাদের বক্ষ তাঁর প্রেমে এবং তাঁর শরীয়তের ইমামগণ ও তাঁর উম্মতের উলামাগণের মহব্বতে সদা প্রশস্ত। আর যারা যে জাতিকে ভালোবাসে তারা কিয়ামতে তাদেরই সঙ্গী হবে। (ই’তিকাদু আহলিল হাদীস)।

(৪) পুর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, বিআতীদের আমল রহিত, যেহেতু দ্বীন পুর্ণাঙ্গ এবং যে কাজে কিতাব বা সুন্নাহর কোন নির্দেশ নেই তা করা ভ্রষ্টতা এবং এর পরিণাম জাহান্নাম। বিদআতীদের নিরর্থক মেহনত এবং বেকার কর্মকান্ডের কোন পারিশ্রমিক, প্রতিদান ও সুফল নেই। আল্লাহ জাল্লা শানুহ বলেন,

قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُم بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا (103) الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا

অর্থাৎ, বল আমি কি তোমাদেরকে তাদের সংবাদ দেব, যারা কর্মে (আমলে)। বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত? ওরাই তারা, পার্থিব জীবনে যাদের প্রচেষ্টা পন্ড হয়, যদিও তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করছে। (সূরা কাহফ ১০৩-১০৪ আয়াত)

(৫) বিদআতীদের সমঝ বিপরীত মুখী হয়ে যায়। জলাতঙ্ক রোগের মত কুপ্রবৃত্তি তাদের শিরা-উপশিরায় স্থানাধিকার করে বসে। ফলে ভালোকে মন্দ এবং মন্দকে ভালো রূপে দেখে থাকে। বিদআতকে সুন্নাত এবং সুন্নাতকে বিদআত জ্ঞান করে থাকে। বিদআতীকে ওলী এবং সুন্নীকে কাফের’ ভেবে থাকে। বাউলিয়াকে আওলিয়া এবং মুত্তাকীন আওলিয়াকে (ইলমের) দেউলিয়া মনে করে। যাদের নিকট কোন হুজ্জত ও দলীল ফলপ্রসু হয় না। নবীর আদেশ মানতে এবং প্রকৃত আওলিয়াদের ও দলীল পথ অনুসরণ করতে বললে বলে, তোমাদের নবী ও আওলিয়াদের পথ অনুসরণ করতে বললে বলে, তোমাদের নবী ও আওলিয়াদের প্রতি কোন আদব ও মহব্বতর্ক নেই। হাদীস ও আয়াত দ্বারা কুরআনের তফসীর করতে গেলে বলে, তোমরা কুরআন বুঝ না, কুরআন মান না। প্রায় সব ব্যাপারেই উল্টা বুঝিল রাম।

(৬) যে বিদআত করলে মানুষ কাফের হয়ে যায় সেই বিদআতের বিদআতী এবং তার প্রতি আহবানকারী বিদআতীর রেওয়ায়াত (হাদীসের বর্ণনা) গ্রহণ যোগ্য নয়। যেমন, তার সাক্ষিও অগ্রহণযোগ্য।

(৭) অধিকাংশ ফিতনার পশ্চাতে কোন না কোন বিদআতীর হাত থাকে এবং বিদআতীরাই বেশীরভাগ ফিতনায় আপতিত হয়ে থাকে। তাদের কারণে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এমন ফিতনার সৃষ্টি হয় যাতে বহু মানুষ সন্ধ্যায় মুমিন থাকে, সকালে কাফের হয়ে যায় এবং সকালে মুমিন থাকলে, সন্ধ্যায় কাফের হয়ে যায়। সামান্য পার্থিব স্বার্থের বিনিময়ে এরা দ্বীনকে বিক্রয় করে দেয়। বিদআতই দ্বীন ও সমাজের বড় ফিতনা। ইবনে মাসউদ ৩৯ বলেন, “তোমাদের তখন কি অবস্থা হবে, যখন ফিতনা তোমাদেরকে আচ্ছাদিত করে নেবে? যাতে বড় বৃদ্ধ হবে এবং ছোট প্রতিপালিত (হয়ে বড়) হবে। মানুষ যাকে সুন্নাহ মনে করবে। যখন তা (ফিতনা বা বিদআত) অপসারিত করা হবে তখন লোকেরা বলবে, ‘সুন্নাত অপসারিত হল। একজন জিজ্ঞাসা করল, 'হে আবু আব্দুর রহমান! এরূপ কখন। হবে? তিনি বললেন, 'যখন তোমাদের কৃারীর সংখ্যা অধিক হবে এবং ফকীহ (অভিজ্ঞ আলেমদের) সংখ্যা কম হবে, তোমাদের নেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং আমানতদারের সংখ্যা কমে যাবে ও আখেরাতের কর্ম দ্বারা দুনিয়ার সম্পদ অন্বেষণ করা হবে।” (দারেমী ১/৬৪ নং)

ইমাম মালোকের নিকট এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আবু আব্দুল্লাহ! কোত্থেকে ইহরাম বাঁধব? তিনি বললেন, ‘যুলহুলাইফা থেকে; যেখান থেকে রসুলুল্লাহ এ ইহরাম বেঁধে ছিলেন। লোকটি বলল, আমি মসজিদে নববী) থেকে ইহরাম বাঁধতে ইচ্ছা করছি। তিনি বললেন, 'এমনটি করো না। লোকটি বলল, 'আমি ইচ্ছা করছি যে, মসজিদে কবরের নিকট থেকে এহরাম বাঁধব।” তিনি বললেন, এমনটি করো না, কারণ আমি তোমার উপর ফিতনার ভয় করি। লোকটি বলল, ‘এটা আবার কোন ফিতনা? এতো কয়েকটা মাইল মাত্র বেশী করব!’ তিনি বললেন, ‘কোন ফিতনা এর চেয়ে অধিক বড় যে, তুমি মনে কর, তুমি এমন। ফযীলতের প্রতি অগ্রগামী হয়েছ, যা হতে রসূল ধ্ৰু পিছে থেকে গেছেন? আমি শুনেছি আল্লাহ বলেছেন যে,

فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَن تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

অর্থাৎ, সুতরাং যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় (ফিতনা) অথবা কঠিন শাস্তি (আযাব) তাদেরকে গ্রাস করবে। (সূরা নুর ৬৩)।

বলাই বাহুল্য যে, বিদআতীদের এটাই হচ্ছে মূল বুনিয়াদ। ভাল জিনিস তো। বাড়তি করলে ক্ষতি কি? তাদের আকেলে অনুরূপ অতিরঞ্জনে কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু ইমাম মালেক (রঃ) বলেন, ঐটাই ফিতনা। (৮) বিদআতীর নিকট হক ও বাতিলের মাঝে তালগোল খেয়ে যায়। কখনো বা মস্তবড় গর্হিত কর্ম দেখে চুপ থেকে মৌনসম্মতি জানায়। আবার কখনো ছোট বিষয়ে কোমর বেঁধে লড়ে। কখনো সামান্য বিষয়কে বড় এবং বড় বিষয়কে তুচ্ছ জ্ঞান করে। তাই কখনো মুসলিমদের জান ও মালকে হালাল মনে করে তাদেরকে হত্যা করে। এবং কখনো মশা মারাও হারাম ভাবে। বিভিন্ন কুসংস্কারদিকে দ্বীন ভাবে। যাদু ও শয়তানী কর্মকান্ডকে কারামত জ্ঞান করে। ফলে তাদের অবস্থা ঠিক বানী ইস্রাঈলদের মত হয়; যাদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

وَلَا تَلْبِسُوا الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوا الْحَقَّ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ

অর্থাৎ, তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-শুনে সত্য গোপন করো না। (সূরা বাকারাহ ৪২ আয়াত)

(৯) বিদআতী অভিশাপ যোগ্য। তদনুরূপ যে ব্যক্তি কোন বিদআতীর সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা করে তার উপরেও আল্লাহ ফিরিশ্যামন্ডলী এবং সকল মানুষের অভিশাপ। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “মদীনায় ঈর থেকে সওর পর্যন্ত হারাম। যে ব্যক্তি তার মধ্যে কোন অপকর্ম করবে বা দুর্ঘটনা ঘটাবে বা নবরচিত কর্ম (বিদআত) করবে অথবা এমন অপকর্মকারী বা বিদআতীকে স্থান বা প্রশ্রয় দেবে বা সাহায্য করবে তার উপর আল্লাহ, ফিরিশ্যামন্ডলী এবং সমগ্র মানবমন্ডলীর অভিশাপ। আল্লাহ কিয়ামতের দিন। তার নিকট হতে ফরয ও নফল কোন কিছুই গ্রহণ করবেন না।” (বুখারী, মুসলিম ১৩৬৬নং)।

তিনি আরো বলেন, “আল্লাহর অভিসম্পাত সেই ব্যক্তির উপর যে গায়রুল্লাহর উদ্দেশ্যে যবেহ করে, আল্লাহর অভিসম্পাত সেই ব্যক্তির উপর যে নিজ পিতামাতাকে অভিসম্পাত করে, আল্লাহর অভিসম্পাত সেই ব্যক্তির উপর যে কোন দুষ্কৃতকারী বা বিদআতীকে আশ্রয় দেয় এবং আল্লাহর অভিসম্পাত সেই ব্যক্তির উপর যে ভূমির (জমি-জায়গার) সীমা-চিহ্ন পরিবর্তন করে।” (মুসলিম ১৯৭৮) (১০)

বিদআতী আল্লাহর যিকর হতে মুখ ফিরিয়ে থাকে। আবার যিকর করলেও মনগড়া রচিত যিকর মুখে আওড়ে থাকে। ইল-ইল, হু-হু, হাই-হাই’ প্রভৃতি অর্থহীন শব্দ দ্বারা উচ্চস্বরে আজব যিকর টেনে থাকে। বরং এখানেই শেষ নয়; যিকরের সময় তথাকথিত তন্ময়তা ও ভাবাবেগে তারা নিজেদের দেহ আন্দোলিত করে। কাওয়ালীর স্বরে ও ডুগডুগির তালে নাচতে থাকে। বরং নারী -পুরুষ একই কক্ষে এই যিক হেঁকে থাকে। কখনো বা হুযুরের তরফ থেকে এই প্রত্যাদেশ হয়, ‘মনের আলো বড় আলো বাইরের আলো নিভাও রে, মনের পর্দা বড় পর্দা বাইরের পর্দা উঠাও রে!’

অতঃপর ঐ কামেলের মজলিসে অন্ধকারে বেপর্দায় যা ঘটে, তা বলাই বাহুল্য! অবশ্য এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ, ঐ কামেলদের উপর শরীয়তের কোন বাঁধনই অবশিষ্ট থাকে না! পক্ষান্তরে অনেক বিদআতীর নিকট তাদের মনগড়া যিকর আওড়ানো কুরআন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কুরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত যিকর তো জানেই না। বলতে গেলে ব্যঙ্গ হাসে অথবা মুখ টেরা করে নেয়। যেহেতু ওদের নিকট কিতাবী’ যিকর অপেক্ষা ‘কলবী’ যিকরে ফযীলত বেশী। তাই কুরআন পঠিত হলে কর্ণপাত করে না অথচ ঐ ধরণের যিকর অথবা কাওয়ালী যিকরের ক্ষেত্রে মন দিয়ে কান লাগিয়ে মাথা হিলিয়ে শোনে ও আওড়ায়। মহান আল্লাহ অবিশ্বাসীদের সম্বন্ধে বলেন,

وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ ۖ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِن دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ

অর্থাৎ, যারা পরকালে বিশ্বাস রাখে না (তাদের সামনে) যখন একক আল্লাহর কথা উল্লেখ করা হয়, তখন তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয় এবং আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কারো (তাদের উপাস্যদের) উল্লেখ করা হলে তারা আনন্দে উল্লাসিত হয়।” (সূরা যুমার ৪৫ আয়াত)

এরা তো সেই বিদআতী যারা কুরআন ও সুন্নাহর নাম শুনলে স্থান ত্যাগ করার চেষ্টা করে। কুরআন-হাদীস শুনতে এদের মন টক হয়ে যায়। কুরআন ও সুন্নাহর মজলিস ও জলসায় উপস্থিত হয় না। হলেও তাদের প্রবৃত্তির প্রতিকূল কথা শুনে মজলিস ছেড়ে পলায়ন করতে চায়। মহান আল্লাহ ঐ শ্রেণীর মানুষের জন্য বলেন,

فَمَا لَهُمْ عَنِ التَّذْكِرَةِ مُعْرِضِينَ * كَأَنَّهُمْ حُمُرٌ مُّسْتَنفِرَةٌ * فَرَّتْ مِن قَسْوَرَةٍ

অর্থাৎ, ওদের কি হয়েছে যে, ব্রা উপদেশ হতে দুরে সরে পড়ে? ওরা যেন ভীতএস্ত গর্দভদল, যা সিংহের সম্মুখ হতে পলায়ন-পর। (সূরা মুদ্দাসসির ৪৯-৫১ আয়াত)

পরন্তু এমন অনেক বিদআতী আছে, যারা উচ্চ ও সমস্বরে কখনো বা লাউড স্পিকারে যিকর হাঁকে। এরা একই সঙ্গে বিদআত করে, রিয়া করে, প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় এবং আল্লাহর যিকরের প্রতি মানুষের মনকে বীতরাগ করে তোলে। আবার তাদের মধ্যে অনেকেই ইসলামকে কেবল যিকর ও খানকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় এবং অন্যান্য ময়দান ও পরিবেশে তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না!

(১১) বিদআতীদের প্রধান চরিত্রসমূহের অন্যতম চরিত্র সত্য গোপন করা। আপন ভক্তদের নিকট কত ন্যায় ও সত্যের অপলাপ ঘটায়, যা প্রকাশ করলে তাদের ভেদ ফাঁস হয়ে যায়। কোন স্বার্থের খাতিরে জানা বিষয়কে না জানার ভান। করে অথবা শব্দার্থ গোপন করে অথবা কূটাই বা দূর ব্যাখ্যা করে অথবা মনগড়া অর্থ করে আসল সত্য গোপন করে। আর এই কাজে তারা এ কাফেরদের দলে শামিল। হয়ে যায়, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ ۖ وَإِنَّ فَرِيقًا مِّنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ

অর্থাৎ, যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা তাকে (মুহাম্মাদ)কেও তেমনি চেনে, যেমন তারা তাদের পুত্রদেরকে চেনে। কিন্তু তাদের একদল জেনেশুনে সত্য গোপন করে থাকে।” (সূরা বাক্বারাহ ১৪৬ আয়াত)

তিনি আরো বলেন,

أَفَتَطْمَعُونَ أَن يُؤْمِنُوا لَكُمْ وَقَدْ كَانَ فَرِيقٌ مِّنْهُمْ يَسْمَعُونَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُ مِن بَعْدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمْ يَعْلَمُونَ

অর্থাৎ, তোমরা কি আশা কর যে, ওরা তোমাদের মত ঈমান আনবে? অথচ ওদের মধ্যে একদল আল্লাহর বাণী শ্রবণ করত এবং বুঝার পর জেনে শুনে তা বিকৃত করত।” (সূরা বাক্বারাহ ৭৫ আয়াত)

অন্যত্র তিনি বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَىٰ مِن بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ ۙ أُولَٰئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ

অর্থাৎ, আমি যে সব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথনির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, মানুষের জন্য খোলাখুলিভাবে আমি কিতাবে ব্যক্ত করার পরও যারা ঐ সকল গোপন রাখে, আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ করেন এবং অভিশাপকারীরাও তাদেরকে অভিশাপ দেয়।” (সূরা বাকারাহ ১৫৯ আয়াত) আর প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন জানা ইম প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হয় এবং তা গোপন করে, আল্লাহ কিয়ামতে তার মুখে আগুনের লাগাম দেবেন।” (ইবনে মাজাহ)। বলাই বাহুল্য যে, কোন ইলম গোপন করা মুসলিমের জন্য হারাম এবং তার শাস্তি ভয়ানক। অতএব কোন মুত্তাকী ওলী কি করে কি সাহসে কোন ইলম গুপ্ত রাখতে পারেন? যাতে এ কথাই প্রতয়মান হয় যে, কোনও ইলম -যার মাধ্যমে ইহপরকালে মঙ্গলের আশা করা যায়-তা গুপ্ত নেই। সব ইমই আল-আমীন নবী ঐক্ত, তাঁর পর তাঁর আমানতদার সাহাবায়ে কেরাম , তাঁদের পর তাবেয়ীনবৃন্দ (রঃ) এবং তাঁদেরই অনুগামী আউলিয়া ও ইমামগণ প্রকাশ ও প্রচার করে গেছেন। বাতেনী ইলম বলে কিছু নেই; যা আছে তা ভন্ডামি ও ভ্রষ্টতা। বাতেনীর নাম নিয়ে বোকা মানুষদেরকে ধােকায় ফেলে ওরা নিজেদের বুযুর্গী জাহির করে থাকে মাত্র।