তাওহীদ পন্থীদের নয়নমণি ৬০তম অধ্যায় - ছবি অঙ্কনকারীদের ব্যাপারে যা বর্ণিত হয়েছে (باب ماجاء في المصورين) শাইখ আব্দুর রাহমান বিন হাসান বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (রহঃ) ১ টি
ছবি অঙ্কনকারীদের ব্যাপারে যা বর্ণিত হয়েছে

ব্যাখ্যাঃ অর্থাৎ এই অধ্যায়ে ছবি অঙ্কনকারীদের জন্য ভয়াবহ আযাবের কথা বর্ণিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই আযাবের কারণও বর্ণনা করেছেন। তা হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টির সাদৃশ্য করা। কেননা সৃষ্টি করা এবং হুকুম করার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। সুতরাং আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিসমূহের কোনো সৃষ্টির সাদৃশ্য করা জায়েয নেই। কেননা এতে আল্লাহর সৃষ্টির অনুরূপ সৃষ্টি করা হয়।

আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­াম বলেছেনঃ

«قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذَهَبَ يَخْلُقُ كَخَلْقِى فَلْيَخْلُقُوا ذَرَّةً ، أَوْ لِيَخْلُقُوا حَبَّةً أَوْ شَعِيرَةً»

‘‘আল্লাহ তাআলা বলেন, ঐ ব্যক্তির চেয়ে বড় যালেম আর কে হতে পারে, যে আমার সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করতে চায়? তাদের শক্তি থাকলে একটা অণু সৃষ্টি করুক অথবা একটা দানা সৃষ্টি করুক কিংবা একটি যবের দানা সৃষ্টি করুক’’।[1]

বুখারী ও মুসলিমে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­াম বলেছেনঃ

«أَشَدُّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الَّذِينَ يُضَاهُونَ بِخَلْقِ اللَّهِ»

‘‘কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে তাদেরই, যারা আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির মতো ছবি অঙ্কন করে’’।[2]

বুখারী ও মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­ামকে বলতে শুনেছি,

«كُلُّ مُصَوِّرٍ فِى النَّارِ يَجْعَلُ لَهُ بِكُلِّ صُورَةٍ صَوَّرَهَا نَفْسًا يُعَذِّبُ فِى جَهَنَّمَ»

‘‘প্রত্যেক চিত্র অঙ্কনকারীই জাহান্নামী। চিত্রকর যতটি চিত্র অঙ্কন করবে, তার প্রতেকটির বদলে একটি করে প্রাণ সৃষ্টি করা হবে। এর মাধ্যমে তাকে জাহান্নামে শাস্তি দেয়া হবে’’।[3]

বুখারী ও মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত মারফু হাদীছে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«مَنْ صَوَّرَ صُورَةً فِى الدُّنْيَا كُلِّفَ أَنْ يَنْفُخَ فِيهَا الرُّوحَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَيْسَ بِنَافِخٍ»

‘‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন প্রাণীর ছবি অঙ্কন করবে, কিয়ামতের দিন তাকে ঐ ছবিতে রূহ দেয়ার জন্য বাধ্য করা হবে। অথচ সে তাতে রূহ দিতে সক্ষম হবেনা’’।[4]

সহীহ মুসলিমে আবুল হাইয়াজ আল-আসাদী হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু একদা আমাকে বললেনঃ

«أَلَا أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أن لا تدع صُورَةً إِلَّا طَمَسْتَهَا و لَا تَدَعَنَّ قَبْرًا مُشْرِفًا إِلَّا سَوَّيْتَهُ»

‘আমি কি তোমাকে এমন কাজে পাঠাবোনা, যে কাজে স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে পাঠিয়েছিলেন? সে কাজটি হচ্ছে, তুমি কোনো প্রাণীর ছবি দেখলেই তা বিলুপ্ত না করে ছাড়বেনা। আর কোন উচু কবরকে মাটির সমান না করে ছাড়বেনা’’।[5]

ব্যাখ্যাঃ আবুল হাইয়াজ আল আসাদীর নাম হচ্ছে হাইয়ান বিন হুসাইন। তিনি আমীরুল মুমিনীন আলী বিন আবু তালিব রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। উপরোক্ত হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই কাজগুলোর প্রতিবাদ করেছেন এবং তা মিটিয়ে ফেলার হুকুম দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা সূরা বাকারার ৫৯ নং আয়াতে বলেনঃ

فَبَدَّلَ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ قَوْلًا غَيْرَ الَّذِي قِيلَ لَهُمْ

‘‘কিন্তু তাদেরকে যে কথা বলা হয়েছিল, যালেমরা তাকে অন্য কথা দ্বারা বদল করে ফেলেছে’’। আর তারা বহু ছবি তৈরী করেছে এবং তা ব্যবহার করেছে। কবরের উপর প্রচুর ঘর ও মসজিদ নির্মাণ করেছে, সেগুলোকে চাকচিক্যময় করেছে এবং সেগুলোকে মূর্তিতে পরিণত করেছে। এই কাজকে তারা দ্বীন মনে করেছে। অথচ এটি হচ্ছে সর্বাধিক নিকৃষ্ট ও গুনাহ্র কাজ। কেননা এতে রয়েছে মৃতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে বাড়াবাড়ি এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য বিভিন্ন প্রকার এবাদত পেশ করার ছড়াছড়ি। অথচ বান্দার উপর আল্লাহর অধিকার হচ্ছে সে একমাত্র আল্লাহর এবাদত করবে এবং আল্লাহর এবাদতে অন্য কাউকে শরীক করবেনা।

আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রঃ) বলেনঃ কবরের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুন্নাত, কবরের বিষয়ে তাঁর আদেশ-নিষেধ এবং এ বিষয়ে তাঁর সাহাবীগণ যে নীতির উপর ছিলেন, যে ব্যক্তি তার সাথে বর্তমান যামানার অধিকাংশ মুসলিমের অবস্থার মাঝে তুলনা করবে, সে সুস্পষ্টরূপে জানতে পারবে যে উভয় অবস্থা পরস্পর বিপরীত। এই দু’টি অবস্থা কখনো একসাথে চলতে পারেনা।[6] এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) ছবি অঙ্কনকারীদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে।

২) ছবি বানানো থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করার কারণও বলে দেয়া হয়েছে। এখানে কঠোরতা অবলম্বনের কারণ হচ্ছে, ছবি নির্মাণে আল্লাহর সাথে বেআদবী হয়। আল্লাহ তাআলা হাদীছে কুদসীতে বলেনঃ

«ومن أظلم ممن ذهب يخلق كخلقى»

‘‘ঐ ব্যক্তির চেয়ে বড় যালেম আর কে হতে পারে, যে আমার সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করতে চায়?

৩) এখানে সৃষ্টি করার ব্যাপারে আল্লাহর ক্ষমতার প্রতি সতর্ক করা হয়েছে। অপরদিকে বান্দা যে এতে সম্পূর্ণ অক্ষম তা বলা হয়েছে। তাই আল্লাহ তাআলা ছবি প্রস্ত্ততকারীদেরকে বলেছেন, তোমাদের ক্ষমতা থাকলে তোমরা একটা অণু অথবা একটা দানা কিংবা একটা যবের দানা তৈরী করে নিয়ে এসো।

৪) সুস্পষ্টরূপে ঘোষণা করা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন চিত্রকরদের সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে।

৫) চিত্রকর যতটা প্রাণীর ছবি আকঁবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য ততটা প্রাণ সৃষ্টি করবেন এবং এর দ্বারাই জাহান্নামে তাঁকে শাস্তি দেয়া হবে।

৬) অঙ্কিত ছবিতে রূহ দেয়ার জন্য চিত্রকারকে বাধ্য করা হবে।

৭) প্রাণীর ছবি পাওয়া গেলেই তা ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

[1] - সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ আল্লাহর বাণীঃ আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। হাদীছ নং- ৫৯৩৫।

[2] - সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ ছবিকে পদদলিত করা। হাদীছ নং- ৫৯৫৪।

[3] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ যে ঘরে ছবি থাকে, তাতে ফেরেশতা প্রবেশ করেনা। হাদীছ নং- ২১১০।

[4] - মুসলিম, অধ্যায়ঃ প্রাণীর ছবি অঙ্কন করা হারাম। হাদীছ নং- ২১১০।

[5] - নাসায়ী, অধ্যায়ঃ কবর মাটির সমান করে দেয়ার আদেশ, হাদীছ নং- ২০৩১।

[6] - রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবর মাটির সমান রাখার আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান যামানার অধিকাংশ মুসলিম কবরকে যমীন থেকে উঁচু করছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের উপর ঘর ও মসজিদ নির্মাণ করতে নিষেধ করেছেন। অথচ মুসলিমগণ কবরের উপর ঘর ও মসজিদ উভয়টিই নির্মাণ করছে। শুধু তাই নয়, কবরের উপর নির্মিত ঘরে লাল সালু লাগানো হচ্ছে। তার উপর আবার ফ্যানও ঘুরছে, বাতি জ্বলছে। কবর ও মাজারকে কেন্দ্র করে সকল প্রকার শির্কই সংঘটিত হচ্ছে। আমরা এসব কুসংস্কার ও পাপ কাজ থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই।