আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত বিধান পরিত্যাগ করে অন্যের ফয়সালা মেনে চলা - ১

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آَمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا فَكَيْفَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ ثُمَّ جَاءُوكَ يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ إِنْ أَرَدْنَا إِلَّا إِحْسَانًا وَتَوْفِيقًا

‘‘আপনি কি তাদেরকে দেখেন নি যারা আপনার উপর যে কিতাব নাযিল হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে বলে দাবী করে? তারা বিচার ফয়সালার জন্য তাগুত এর কাছে যায়, অথচ তা অস্বীকার করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আর শয়তান তাদেরকে চরম গোমরাহীতে নিমজ্জিত করতে চায়। আর যখন তাদেরকে বলা হয় এসো সেই জিনিষের দিকে, যা আল্লাহ্ নাযিল করেছেন এবং এসো রাসূলের দিকে তখন তুমি মুনাফেকদেরকে দেখবে, ওরা তোমার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুন বিপদ এসে যায়, অতঃপর তারা তোমার কাছে আল্লাহ্‌র নামে কসম করতে করতে ফিরে আসে এবং বলে, মঙ্গল ও সম্প্রীতি ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিলনা’’। (সূরা নিসাঃ ৬০)

ব্যাখ্যাঃ হাফেয ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ উক্ত আয়াতগুলোতে ঐ ব্যক্তির দোষারোপ করা হয়েছে, যে কুরআন ও সুন্নাহ বাদ দিয়ে অন্যান্য বাতিল বিষয়ের ফয়সালা কবুল করে। এখানে তাগুত বলতে এটিই উদ্দেশ্য। যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের এবাদত করল, এবাদতের যে কোনো প্রকারের মাধ্যমেই তা হোক না কেন, যেমন আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে দুআ করা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে মদদ চাওয়া ইত্যাদি, সেই মাবুদ যদি কোনো সৎ লোক হয়, তাহলে সেই এবাদত শয়তানের এবাদত বলেই গণ্য হবে। কেননা শয়তানই তাকে সেই সৎ লোকের এবাদত করার আদেশ করেছে এবং তা তার সামনে সুসজ্জিত করে পেশ করেছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَيَوْمَ يَحْشُرُهُمْ جَمِيعًا ثُمَّ يَقُولُ لِلْمَلَائِكَةِ أَهَؤُلَاءِ إِيَّاكُمْ كَانُوا يَعْبُدُونَ (40) قَالُوا سُبْحَانَكَ أَنْتَ وَلِيُّنَا مِنْ دُونِهِمْ بَلْ كَانُوا يَعْبُدُونَ الْجِنَّ أَكْثَرُهُمْ بِهِمْ مُؤْمِنُونَ

‘‘যেদিন তিনি তাদের সবাইকে একত্রিত করবেন এবং ফেরেশতাদেরকে বলবেন, এরা কি তোমাদেরই পূজা করত? ফেরেশতারা বলবে, আপনি পাক-পবিত্র, তারা ব্যতীত আপনিই আমাদের বন্ধু; বরং তারা জিনের এবাদত করত। তাদের অধিকাংশই ছিল তাদের প্রতি বিশ্বাসী’’। (সূরা সাবাঃ ৪০-৪১) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

وَيَوْمَ نَحْشُرُهُمْ جَمِيعًا ثُمَّ نَقُولُ لِلَّذِينَ أَشْرَكُوا مَكَانَكُمْ أَنْتُمْ وَشُرَكَاؤُكُمْ فَزَيَّلْنَا بَيْنَهُمْ وَقَالَ شُرَكَاؤُهُمْ مَا كُنْتُمْ إِيَّانَا تَعْبُدُونَ (28) فَكَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ إِنْ كُنَّا عَنْ عِبَادَتِكُمْ لَغَافِلِينَ

‘‘আর যেদিন আমি তাদের সবাইকে সমবেত করবো; আর যারা শির্ক করত তাদেরকে বলবোঃ তোমরা এবং তোমাদের শরীকরা নিজ নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে যাও। অতঃপর তাদেরকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেব, তখন তাদের শরীকরা বলবে, তোমরা তো আমাদের উপাসনা করোনি। বস্তুত আল্লাহ্ আমাদের ও তোমাদের মাঝে সাক্ষী হিসাবে যথেষ্ট। আমরা তোমাদের বন্দেগী সম্পর্কে জানতাম না’’। (সূরা ইউনুসঃ ২৮-২৯)

আর সেই মাবুদ যদি এমন ব্যক্তি হয়, যে নিজেই নিজের এবাদত করার প্রতি আহবান জানায় কিংবা তাগুতের এবাদত করার প্রতি আহবান জানায় অথবা কোনো গাছ অথবা পাথর অথবা কবর হয় কিংবা লাত, উয্যা, মানাত এবং অনুরূপ অন্যান্য বস্ত্ত হয়, তাও তাগুত হিসাবে গণ্য হবে। যেসব বস্ত্তকে মুশরিকরা মাবুদ নির্ধারণ করেছিল যেমন সৎ লোক, ফেরেশতা বা অন্যান্য বস্ত্তর আকৃতিতে তারা নিজেদের মাবুদ বানিয়ে নিয়েছিল, উহা সেই তাগুতের অন্তর্ভূক্ত, যার প্রতি কুফরী করার জন্য এবং যার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য সকল মাবুদের এবাদত থেকে বিরত থাকার আদেশও দিয়েছেন। সে যেই হোক না কেন।

সুতরাং জানা গেল যে, আল্লাহ ব্যতীত যেসব বস্ত্তর এবাদত করা হয়, ঐ রকম প্রত্যেক বস্ত্তর প্রতি কুফরী করা ওয়াজিব। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِي بَرَاء مِّمَّا تَعْبُدُونَ إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُ سَيَهْدِينِ وَجَعَلَهَا كَلِمَةً بَاقِيَةً فِي عَقِبِهِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ

‘‘আর যখন ইবরাহীম তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বললেনঃ তোমরা যাদের এবাদত করো, তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তবে আমার সম্পর্ক তাঁর সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব, তিনিই আমাকে সৎপথ প্রদর্শন করবেন। এ কথাকে তিনি অক্ষয় বাণী স্বরূপ তার সন্তানদের মধ্যে রেখে গেছেন, যাতে তারা এদিকেই ফিরে আসে’’। (সূরা যুখরুফঃ ২৬-২৮)

এখানে ইবরাহীম (আঃ) সকল মাবুদ থেকে কেবল ঐ মাবুদকেই আলাদা করেছেন, যিনি তাঁকে সৃষ্টি করেছেন। এটিই হচ্ছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্এর অর্থ। যেমন ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা সূরা মুমতাহানার ৪নং আয়াতে বলেনঃ

قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ إِلَّا قَوْلَ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ رَبَّنَا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنَا وَإِلَيْكَ أَنَبْنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ

‘‘তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তাঁর সংঙ্গীগণের মধ্যে চমৎকার নমুনা রয়েছে। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিলঃ তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহ্‌র পরিবর্তে যার এবাদত করো, তার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করছি। তোমরা এক আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে ও আমাদের মধ্যে চির শত্রুতা ও বিদ্বেষ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ইবরাহীমের উক্তি তাঁর পিতার উদ্দেশ্যে এই আদর্শের ব্যতিক্রম। তিনি বলেছিলেনঃ আমি অবশ্যই তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব। তোমার উপকারের জন্যে আল্লাহ্‌র কাছে আমার আর কিছু করার নেই। হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তোমারই উপর ভরসা করেছি, তোমারই দিকে মুখ করেছি এবং তোমারই নিকট আমাদের প্রত্যাবর্তন’’।

অনুরূপ যে বিচারক ও শাসক আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের হুকুমের বিরোধীতা করে এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান বাদ দিয়ে অন্য বিধান দ্বারা মানুষের মধ্যে ফয়সালা করে অথবা যে মূর্খতা বশতঃ মানুষের মধ্যে ফয়সালা করে অথবা যে ব্যক্তি লোকদের কাছে কামনা করে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতায় তার অনুসরণ করা হোক অথবা যে চায় এমন বিষয়ে তার অনুসরণ করা হোক, যে সম্পর্কে জানা যায়নি যে, উহা সত্য-সঠিক, এমন বিষয়ে যদি তার অনুসরণকারীরা হক-বাতিলের পরওয়া না করেই তার হুকুমের অনুসরণ করে, তাহলে এই ব্যক্তি বিনা সন্দেহে তাগুত। আল্লাহ তাআলা সূরা নিসার ৬০ নং আয়াতে বলেনঃ

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آَمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا

‘‘তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা এই মর্মে দাবী করে চলেছে যে, তারা ঈমান এনেছে সেই বস্ত্তর উপর যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেই সব কিতাবের প্রতি যেগুলো তোমার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে। কিন্তু নিজেদের বিষয়সমূহ ফয়সালা করার জন্য তাগুতের দিকে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদেরকে আদেশ করা হয়েছে, তারা যেন তাগুতকে অস্বীকার করে। শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে সরল সোজা পথ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিতে চায়’’। কেননা তাগুতকে অস্বীকার করা তাওহীদের অন্যতম রোকন। যেমন সূরা বাকারার ২৫৬ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

‘‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই। নিঃসন্দেহে হেদায়াত গোমরাহী থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এখন যারা তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান আনয়ন করে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল, যা কখনো বিচ্ছিন্ন হয়না। আর আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’’। সুতরাং এই রোকন যদি অর্জিত না হয় অর্থাৎ তাগুতকে যদি অস্বীকার না করে, তাহলে لاإله إلا الله যা অস্বীকার করেছে, তার অস্বীকার করা হবেনা।

وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا ‘‘শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে সরল সোজা পথ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিতে চায়’’ঃ অর্থাৎ শয়তান তাদেরকে হেদায়াত থেকে সরিয়ে গোমরাহ করতে চায়। এই আয়াতে চারটি বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে।

১) মানুষকে গোমরাহ করার মধ্যে শয়তানেরও ইচ্ছা রয়েছে।

২) মানুষকে গোমরাহীতে লিপ্ত করাই শয়তানের কাজ।

৩) শয়তানের গোমরাহীকে মাসদারের (ক্রিয়ামূল উল্লেখের) মাধ্যমে তাগিদ করা হয়েছে।

৪) শয়তানের এই গোমরাহীকে হক ও হেদায়াত থেকে বহু দূরের গোমরাহী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

সুবহানাল্লাহ! কত মহান এই কুরআন! যে ব্যক্তি এই কুরআনে গবেষণা করবে, তার জন্য কুরআন কতইনা উপকারী! কতই না উচ্চাঙ্গের! এটি একটি সুস্পষ্ট দলীল যে, তা রাববুল আলামীনের কালাম। তিনি অহীর মাধ্যমে তাঁর সম্মানিত রাসূলের উপর নাযিল করেছেন। তাঁর সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত বান্দা লোকদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তাঁর উপর, জিবরীলের উপর এবং সকল সাহাবীর উপর আল্লাহ তাআলার সালাত ও সাল্লাম বর্ষিত হোক।

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ ‘‘আর যখন তাদেরকে বলা হয় এসো সেই বিষয়ের দিকে, যা আল্লাহ্ নাযিল করেছেন এবং এসো রাসূলের দিকে তখন তুমি মুনাফেকদেরকে দেখবেঃ কেননা মুনাফেক সত্যকে এবং সত্যের অনুসারীকে ঘৃণা করে এবং সত্যের পরিপন্থী বাতিলকে পছন্দ করে। আহলে নিফাক তথা মুনাফেকদের অবস্থা এটিই।

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ এই আয়াত থেকে দলীল পাওয়া যাচ্ছে যে, কাউকে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের ফয়সালা মেনে নেয়ার আহবান জানানো হলে সে যদি তা কবুল করতে অস্বীকার করে, তাহলে সে মুনাফেক।

ব্যাখ্যাকার বলেনঃ এই ধরণের মুনাফেকের সংখ্যা অগণিত। আল্লাহ যেন তাদের সংখ্যা না বাড়ান!

উপরোক্ত আয়াতে يصدون ফেলে লাযেম। এখানে এটি يعرضون (মুখ ফিরিয়ে নেয়া) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা এর মাসদার হচ্ছে صدودا। এই স্বভাবের লোকের সংখ্যা প্রচুর। বিশেষ করে ইল্মের দাবীদারদের মধ্যে এদের সংখ্যা প্রচুর। এরা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এমন লোকদের কথার দিকে ধাবিত হয়, যাদের মধ্যে প্রচুর ভুল রয়েছে। বিশেষ করে যারা চার মাজহাবের কোনো একটি মাজহাবের অনুসারী বলে দাবী করে, তাদের মধ্যেই রয়েছে প্রচুর ভুল। এসব লোকেরা মাজহাব ওয়ালাদের এমন মাসআলায় তাকলীদ করে, যা কুরআন ও সুন্নাহর দলীল বিরোধী হওয়ার কারণে সেগুলোর তাকলীদ করা বৈধ নয়। এ সমস্ত মুকাল্লিদ লোকদের মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুন্নাতের অনুসারী গরীব অবস্থায় রয়েছে। এটি একটি বিরাট মসীবতে পরিণত হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ

‘‘তাদেরকে যখন বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা, তখন তারা বলে, মূলতঃ আমরাই সংশোধনকারী’’। (সূরা বাকারাঃ ১১)

ব্যাখ্যাঃ আবুল আলীয়া আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ তোমরা যমীনে আল্লাহর নাফরমানী করোনা। কেননা যে ব্যক্তি যমীনে আল্লাহর নাফরমানী করবে অথবা আল্লাহর নাফরমানীর আদেশ করবে, সে যমীনে ফাসাদ সৃষ্টিকারী বলে গণ্য হবে। আর আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের আনুগত্যের মধ্যেই আসমান ও যমীন সংশোধিত থাকে। অধ্যায়ের সাথে আয়াতের মিল এভাবে পাওয়া যায় যে, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলকে বাদ দিয়ে অন্যের ফয়সালা গ্রহণ করা মুনাফেকদের কাজের অন্তর্ভূক্ত। আর এটি যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করাও বটে।

আয়াতে নফসের পূজারী ও বিদআতীদের কথা দ্বারা ধোঁকায় পতিত হওয়া থেকেও সতর্ক করা হয়েছে। যদিও তারা তাদের দাবীকে চাকচিক্যময় করে পেশ করে।

আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেনঃ

وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا وَادْعُوهُ خَوْفًا وَطَمَعًا إِنَّ رَحْمَةَ اللَّهِ قَرِيبٌ مِنَ الْمُحْسِنِينَ

‘‘পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার পর তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। অল্লাহকে আহবান করো ভয় ও আশা সহকারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌র রহমত সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী। (সূরা আরাফঃ ৫৬)

ব্যাখ্যাঃ আবু বকর বিন আয়াশ (রঃ) আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ আল্লাহ তাআলা পৃথিবীবাসীর নিকট মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমন সময় পাঠিয়েছেন, যখন তারা বিপর্যয়ের মধ্যে ছিল। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তাঁর মাধ্যমে সংশোধন করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর আনীত দ্বীন বাদ দিয়ে অন্য দিকে আহবান করবে, সে পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভূক্ত হবে।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ অধিকাংশ মুফাসসির বলেনঃ নবী-রাসূল পাঠিয়ে, শরীয়ত নাযিল করে এবং আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমে পৃথিবীকে সংশোধন করার পর তাতে পাপ কাজের মাধ্যমে এবং আল্লাহর নাফরমানীর দিকে আহবানের মাধ্যমে তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। কেননা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের এবাদত করা, আল্লাহ ছাড়া অন্যের দিকে আহবান করা এবং আল্লাহর সাথে শির্ক করা যমীনে সর্ববৃহৎ ফাসাদ সৃষ্টি করার শামিল। প্রকৃত অর্থে আল্লাহ রাববুল আলামীনের সাথে শরীক স্থাপন করা, আল্লাহ ছাড়া অন্যের দিকে আহবান করা, আল্লাহ ছাড়া অন্য মাবুদ নির্ধারণ করা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্যকে অনুসরণীয় বানানো ভূপৃষ্ঠে বিরাট ফাসাদ সৃষ্টি করার নামান্তর। পৃথিবী এবং পৃথিবীবাসী ততক্ষণ পর্যন্ত সংশোধন হবেনা যতক্ষণ না একমাত্র আল্লাহর এবাদত করা হবে এবং আল্লাহর দিকেই আহবান করা হবে; অন্যের দিকে নয়। সেই সঙ্গে আল্লাহর রাসূল ব্যতীত অন্য কারো আনুগত্য করা হবেনা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্যের কথা তখনই মান্য করা হবে, যখন সে রাসূলের কথার আনুগত্য করার আদেশ দিবে। সুতরাং সে যখন রাসূলের সুন্নাত অমান্য করার আদেশ দিবে এবং তাঁর শরীয়তের খেলাফ করার হুকুম করবে, তখন তার কথা মান্য করা যাবেনা ও তার কথার আনুগত্যও করা যাবেনা।

যে ব্যক্তি পৃথিবীর অবস্থা নিয়ে চিন্তা করবে, সে দেখবে পৃথিবীর প্রতিটি সংস্কার ও সংশোধনের মূলেই রয়েছে আল্লাহর তাওহীদ, তাঁর এবাদত এবং আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য। আর প্রতিটি ফিতনা, মসীবত, অনাবৃষ্টি, শত্রুদের বিজয় এবং অন্যান্য অকল্যাণের মূলেই রয়েছে আল্লাহর রাসূলের বিরোধিতা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ব্যতীত অন্যের দিকে আহবান করা।

আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ

‘‘তারা কি জাহেলী যুগের ফয়সালা কামনা করে? বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ্ অপেক্ষা উত্তম ফয়সালাকারী আর কে আছে?’’ (সূরা মায়েদাঃ ৫০)

ব্যাখ্যাঃ আল্লামা ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ আল্লাহ তাআলা ঐ লোকের প্রতিবাদ করছেন, যে আল্লাহর হুকুম প্রত্যাখ্যান করে। অথচ আল্লাহর বিধান সকল প্রকার কল্যাণের প্রতি আহবান করে এবং সকল অকল্যাণ থেকে নিষেধ করে। তা বর্জন করে যে ব্যক্তি অন্যান্য মত, নিজস্ব প্রবৃত্তি এবং আল্লাহর শরীয়তের দলীল ছাড়াই মানুষের তৈরী বিভিন্ন পরিভাষার দিকে ঝুঁকে পড়ল, যেমন জাহেলী সমাজের লোকেরা তাদের গোমরাহী ও মূর্খতা দ্বারা ফয়সালা করত, যেমন তাতারগণ চেঙ্গিস খানের গৃহীত রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা রাষ্ট্র চালাত, চেঙ্গিসখান বিভিন্ন ধর্ম থেকে কতগুলো হুকুম-আহকাম একত্রিত করে একটি কিতাব রচনা করেছিল, তাতে তার নিজস্ব অনেক মতামতও ছিল, তার কিতাবটি পরবর্তীতে তার ছেলেদের জন্য এমন একটি শরীয়তে রূপ নেয়, যাকে তারা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের হুকুমের উপর প্রাধান্য দিত, যে ব্যক্তি এরূপ করবে সে কাফের হয়ে যাবে, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আবশ্যক। যাতে সে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের হুকুমের দিকে ফিরে আসে এবং ছোট-বড় সকল বিষয়েই ইসলামী শরীয়ত দ্বারা ফয়সালা করে।