আল্লাহ তাআলার বাণীঃ (إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ) ‘‘তুমি যাকে পছন্দ করো, তাকে হেদায়াত করতে পারবেনা*, তবে আল্লাহ্ তাআলাই যাকে ইচ্ছা হেদায়াতের পথে আনয়ন করেন। কে সৎপথে আসবে, সে সম্পর্কে তিনিই অধিক অবগত আছেন’’। (সূরা কাসাসঃ ৫৬)

 ব্যাখ্যাঃ আল্লামা হাফেয ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলকে বলেনঃ হে মুহাম্মাদ! তুমি যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করতে পারবেনা। অর্থাৎ কারো হেদায়াতের বিষয় তোমার উপর সোপর্দিত নয়। তোমার দায়িত্ব শুধু তাবলীগ করা তথা মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দেয়া। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করেন। আল্লাহরই রয়েছে পরিপূর্ণ হিকমত এবং অকাট্য প্রমাণ। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

لَيْسَ عَلَيْكَ هُدَاهُمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ

‘‘তাদেরকে সৎপথে আনার দায়িত্ব তোমার উপর নয়; বরং আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনয়ন করেন’’। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

وَمَا أَكْثَرُ النَّاسِ وَلَوْ حَرَصْتَ بِمُؤْمِنِينَ

‘‘তুমি যতই আগ্রহী হও না কেন, অধিকাংশ লোকই ঈমান আনবেনা’’। ব্যাখ্যাকার বলেনঃ আমি বলছি, এখানে যেই হেদায়াতকে অস্বীকার করা হয়েছে, তা হচ্ছে, হেদায়াতে তাওফীক ও হেদায়াতে মাকবুল। অর্থাৎ হেদায়াতের তাওফীক দেয়ার দায়িত্ব তোমার নয়; হেদায়াতের তাওফীক দেয়ার বিষয়টি একমাত্র আল্লাহর হাতে এবং তিনিই হেদায়াতের তাওফীক দিতে সক্ষম। সূরা শুরার ৫২ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ ‘‘নিশ্চয় তুমি সরল পথ প্রদর্শন করো’’। এখানে হেদায়াত দ্বারা উদ্দেশ্য বাতলে দেয়া ও নির্দেশনা দেয়া। তিনি ছিলেন আল্লাহর পক্ষ হতে বর্ণনাকারী এবং তাঁর শরীয়ত ও দ্বীনের পথ প্রদর্শনকারী।

সহীহ বুখারীতে ইবনুল মুসাইয়্যিব তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনঃ

«لَمَّا حَضَرَتْ أَبَا طَالِبٍ الْوَفَاةُ جَاءَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم و عِنْدَهِ َعَبْدَ اللَّهِ بْنَ أَبِى أُمَيَّةَ وأبو جهل فَقَالَ له «أَىْ عَمِّ قُلْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ كَلِمَةً أُحَاجُّ لَكَ بِهَا عِنْدَ اللَّهِ » فَقَالا أَتَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَأَعاد عليه النبي صلى الله عليه وسلم فأعادا فكان آخر ما قَالَ هو عَلَى مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ وَأَبَى أَنْ يَقُولُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ فقَالَ النبي اللَّهِ صلى الله عليه وسلم «لأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ مَا لَمْ أُنْهَ عَنْكَ » فَأَنْزَلَ اللَّهُ مَا كَانَ لِلنَّبِىِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَأَنْزَلَ اللَّهُ فِى أَبِى طَالِبٍ ( إِنَّكَ لاَ تَهْدِى مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِى مَنْ يَشَاءُ

‘‘যখন আবু তালিবের মৃত্যু উপস্থিত হল তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে আসলেন। আবদুল্লাহ বিন আবি উমাইয়্যাহ এবং আবু জাহেল আবু তালিবের পাশেই উপস্থিত ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, চাচা, আপনি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলুন। এটি এমন একটি কালেমা, আপনি যদি তা পাঠ করেন, তাহলে এর দ্বারা আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য বিতর্ক করবো, তখন তারা দু’জন তাকে বললঃ তুমি আবদুল মুত্তালিবের ধর্ম ত্যাগ করবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কালেমা পড়ার কথা আরেকবার বললেন। তারা দু’জনও আবু তালিবের উদ্দেশ্যে পূর্বোক্ত কথা আরেকবার বলল। আবু তালিবের সর্বশেষ অবস্থা ছিল, সে আবদুল মুত্তালিবের ধর্মের উপরই অটল ছিল এবং ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে অস্বীকার করেছিল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আপনার ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে নিষেধ না করা হবে ততক্ষণ আমি আপনার জন্য মাগফিরাত কামনা করতে থাকবো। অতঃপর আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করেনঃ

مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ

‘‘মুশরিকদের জন্য মাগফিরাত কামনা করা নবী এবং মুমিনদের জন্য শোভনীয় নয়’’। (সূরা তাওবাঃ ১১৩) আল্লাহ তাআলা আবু তালিবের ব্যাপারে এ আয়াত নাযিল করেন,

إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ

‘‘তুমি যাকে পছন্দ করো, তাকে হেদায়াত করতে পারবেনা। কিন্তু আল্লাহ যাকে চান তাকে হেদায়াত করেন’’। (সূরা আল-কাসাসঃ ৫৬)

ব্যাখ্যাঃ ইবনুল মুসাইয়্যিব বলতে এখানে সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব বিন হাযান বিন আবী ওয়াহাব বিন আমর বিন আয়েয আল কুরাইশী আল মাখযুমী উদ্দেশ্য। তিনি ছিলেন মদীনার সাতজন উঁচু মানের আলেম ও ফকীহএর অন্তর্ভূক্ত। মুহাদ্দিছগণ এ ব্যাপারে একমত যে, তার থেকে বর্ণিত মুরসাল হাদীছ অন্যান্য তাবেয়ীদের মুরসাল হাদীছ থেকে অধিক বিশুদ্ধ। আলী ইবনুল মাদীনি (রঃ) বলেনঃ তাবেয়ীদের মধ্যে তার চেয়ে অধিক জ্ঞানী আর কেউ ছিল বলে আমার জানা নেই। ৯০ হিজরীর পর প্রায় আশি বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর পিতা মুসাইয়্যিব ছিলেন একজন সাহাবী। মুসাইয়্যিব (রঃ) উছমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতকাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। সাঈদ বিন মুসাইয়্যিবের দাদাও সাহাবী ছিলেন। হাযান ইয়ামামার যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।

لَمَّا حَضَرَتْ أَبَا طَالِبٍ الْوَفَاةُ যখন আবু তালিবের মৃত্যু উপস্থিত হলঃ অর্থাৎ যখন মৃত্যুর আলামত ও পূর্বাভাস প্রকাশ পেল।

جَاءَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কাছে উপস্থিত হলেনঃ সম্ভবতঃ মুসাইয়্যিব রাযিয়াল্লাহু আনহু আবু জাহল ও আব্দুল্লাহ ইবনে আবু উমাইয়্যার সাথে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কেননা তারা উভয়েই ছিলেন বনী মাখযুমের অন্তর্ভূক্ত। মুসাইয়্যিবও ছিলেন মাখযুম কবীলার অন্তর্ভূক্ত। ঐ সময় তারা তিনজনই কাফের ছিলেন। কাফের অবস্থাতেই আবু জাহেল বদরের যুদ্ধে নিহত হয়। আর বাকী দুইজন ইসলাম কবুল করেছিলেন।

أَىْ عَمِّ قُلْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ হে আমার ‘চাচা! আপনি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলুনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার চাচাকে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার উপদেশ দিলেন। কারণ যে ব্যক্তি, ইল্ম, ইয়াকীন এবং ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর মর্মার্থ মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নেওয়াসহ এটি পাঠ করল, সেই কেবল শির্ককে অস্বীকার করল এবং তা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ঘোষণা করল। কেননা আবু তালেব এই কালেমার মর্মার্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কে জ্ঞান রাখত। সেই মজলিসে উপস্থিত অন্যরাও জানত যে, কালেমায়ে তায়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সকল প্রকার শির্ককে অগ্রাহ্য করে এবং তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আবু তালেবকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছিলেন তখন তারা তাঁর বিরোধীতা করেছিল এবং বলেছিলঃ হে আবু তালেব! তুমি কি আব্দুল মুত্তালিবের দ্বীন থেকে সরে যাচ্ছ? কেননা মূর্তি পূজার মাধ্যমে শির্ক করাই ছিল আব্দুল মুত্তালিবের দ্বীন। জাহেলী যামানার কুরাইশ এবং অন্যদের অবস্থা ছিল একই রকম।

كَلِمَةً أُحَاجُّ لَكَ بِهَا عِنْدَ اللَّهِ এটি এমন একটি কালেমা, আপনি যদি তা পাঠ করেন, তাহলে এর দ্বারা আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য সুপারিশ করবঃ এখানে كلمةশব্দটি তার পূর্বের لاإله إلا الله হতে বদল হওয়ার কারণে মানসুব হয়েছে। উহ্য মুবতাদার খবর হিসাবে এটি মারফুও হতে পারে।

আবু তালেব যদি ঐ অবস্থায় কালেমায়ে তাওহীদ তথা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করত, তাহলে তার কাছ থেকে তা গ্রহণ করা হত এবং এর মাধ্যমে সে মুসলিম বলে গণ্য হত।

فَقَالا أَتَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ তারা দু’জন তাকে বললঃ ‘তুমি আবদুল মুত্তালিবের ধর্ম ত্যাগ করবে? অর্থাৎ আবু জাহেল এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আবু উমাইয়্যাহ আবু তালেবকে সেই অভিশপ্ত দলীলটিই স্মরণ করিয়ে দিল, যাকে সকল মুশরিকই যুগে যুগে নবী-রাসূলদের বিরোধিতায় উত্থাপন করেছে। যেমন ফিরআউন মুসাকে বলেছিলঃ فَمَا بَالُ الْقُرُونِ الْأُولَى ‘‘তাহলে অতীত যুগের লোকদের অবস্থা কী?’’ (সূরা তোহাঃ ৫১) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

وَكَذَلِكَ مَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ فِي قَرْيَةٍ مِنْ نَذِيرٍ إِلَّا قَالَ مُتْرَفُوهَا إِنَّا وَجَدْنَا آَبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آَثَارِهِمْ مُقْتَدُونَ

‘‘এমনিভাবে তোমার পূর্বে আমি যখন কোন জনপদে কোন সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই তাদের বিত্তশালীরা বলেছে, আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকে পেয়েছি এ পথের পথিক এবং আমরা তাদেরই পদাংক অনুসরণ করে চলছি’’। (সূরা যুখরুফঃ ২৩)

فَأَعاد عليه النبي صلى الله عليه وسلم فأعادا নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কালেমা পড়ার কথা আরেকবার বললেন। তারা দু’জনও আবু তালিবের উদ্দেশ্যে পূর্বোক্ত কথা আরেকবার বললঃ অর্থাৎ শির্কের উপর অবিচল থাকার আহবান জানাল। এ থেকে বুঝা যায় যে, খারাপ লোকদের সংস্পর্শ গ্রহণ করা ক্ষতিকর। সুতরাং তাদের নিকটবর্তী হওয়া এবং তাদের কথা শ্রবণ করা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। কবি বলেনঃ

إذا ما صَحِبت القوم فاصحب خيارهم

ولا تصحب الأردى فتردى مع الرّدِي

‘‘তুমি যখন কোনো গোত্রের সাহচর্য গ্রহণ করবে, তখন তাদের সর্বোত্তম লোকদের সাহচর্য গ্রহণ করবে। মন্দ লোকদের সাহচর্য গ্রহণ করবেনা, কেননা দুষ্ট লোকদের সঙ্গ গ্রহণ করলে তুমিও তাদের সাথে ধ্বংস হবে।

فكان آخر ما قَالَ هو عَلَى مِلَّةِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ وَأَبَى أَنْ يَقُولُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ আবু তালিবের সর্বশেষ অবস্থা এই ছিল যে, সে আবদুল মুত্তালিবের ধর্মের উপরই অটল ছিল এবং ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে অস্বীকার করেছিলঃ হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (রঃ) বলেনঃ এখানে বর্ণনাকারী জোর দিয়ে বলেছেন যে, আবু তালেব কালেমা পাঠ করেনি।

শাইখুল ইসলাম আল্লামা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রঃ) বলেনঃ এখানে ঐ সমস্ত লোকের প্রতিবাদ রয়েছে, যারা বলে আবু তালেব এবং তার অন্যান্য মুরববীরা সকলেই ছিল মুসলিম।

لأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ مَا لَمْ أُنْهَ عَنْكَ আপনার ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে নিষেধ করা না হবে ততক্ষণ আমি আপনার জন্য মাগফিরাত কামনা করতে থাকবঃ لأستغفرن এর মধ্যে لام অক্ষরটি কসমের ‘লাম’। অর্থাৎ কসমের জবাবের শুরুতে ব্যবহৃত হয়েছে। মূল বাক্যটি এ রকম ছিলঃ وَاللَّهِ لأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ ‘‘আল্লাহর কসম আমি আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবো’’। ইমাম নববী (রঃ) বলেনঃ এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, শপথ দাবী করা ছাড়াই শপথ করা জায়েয।

ইবনে ফারিস (রঃ) বলেনঃ আবু তালিব মৃত্যু বরণ করার সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বয়স ছিল ৪৯ বছর ৮ মাস ১১ দিন। আবু তালিবের মৃত্যুর ৮ দিন পর খাদীজা রাযিয়াল্লাহু আনহা ইন্তেকাল করেন।

অতঃপর আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাযিল করেন, যার অর্থ হচ্ছে, মুশরিকদের জন্য মাগফিরাত কামনা করা নবী এবং মুমিনদের জন্য শোভনীয় নয়ঃ পূর্ণ আয়াতটি হচ্ছে,

مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ

‘‘নবী ও মুমিনের উচিত নয় যে, তারা মুশরেকদের জন্য মাগফেরাত কামনা করবে, যদিও তারা নিকটাত্মীয় হয়, এ কথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে তারা জাহান্নামী’’। (সূরা তাওবাঃ ১১৩) এখানে মুমিনের পক্ষে মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিৎ নয় বলে যে খবরটি এসেছে, তা নিষেধাজ্ঞা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রকাশ্য কথা হচ্ছে এই আয়াতটি আবু তালিবকে কেন্দ্র করে নাযিল হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তিঃ وَاللَّهِ لأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ مَا لَمْ أُنْهَ عَنْكَ এর পরে فأنزل الله এর মধ্যে ধারাবাহিকতার অর্থ প্রদানকারী فا ফা অক্ষরটি তাই প্রমাণ করে।

আলেমগণ এই আয়াত নাযিল হওয়ার আরো অনেক কারণ বর্ণনা করেছেন। তবে এগুলোর মধ্যে পারস্পরিক কোনো বৈপরিত্য নেই। কেননা কখনো একই আয়াত একাধিক কারণ ও প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়। এ আয়াত থেকে জানা গেল যে, মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা এবং তাদেরকে ভালবাসা হারাম। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয় গুলো জানা যায়ঃ

১) إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ ‘‘হে মুহাম্মাদ! তুমি যাকে পছন্দ করো, তাকে হেদায়াত করতে পারবেনা’’। এ আয়াতের তাফসীর জানা গেল।

২) সূরা তাওবার ১১৩ নং আয়াত অর্থাৎ,

مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ

‘‘নবী ও মুমিনদের উচিত নয় যে, তারা মুশরেকদের জন্য মাগফেরাত কামনা করবে, যদিও তারা নিকটাত্মীয় হয়, এ কথা সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে তারা জাহান্নামী’’-এর তাফসীরও জানা গেল।

৩) একটি বিরাট মাসআলা জানা গেল। আর সেটি হচ্ছে, قل لا إله إلا الله ‘‘আপনি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলুন’’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কথা কথার ব্যাখ্যা। এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা এক শ্রেণীর কথিত জ্ঞানের দাবীদারদের কথার বিপরীত। তারা দাবী করে থাকে যে, অর্থ না বুঝেই এবং ইখলাস ব্যতীত শুধু জবান দিয়ে এটি পাঠ করলেই নাজাত পাওয়া যাবে। তাদের দাবী সম্পূর্ণ বাতিল।

৪) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুপথ যাত্রী আবু তালিবের ঘরে প্রবেশ করে যখন বললেন, হে চাচা! আপনি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলুন, এ কথার দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কী উদ্দেশ্য ছিল তা আবু জাহেল এবং তার সঙ্গীরা ভাল করেই বুঝতে পেরেছিল। আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির অমঙ্গল করুন! যে ইসলামের মূলনীতি কালেমা তায়্যেবার অর্থ সম্পর্কে আবু জাহেলের চেয়েও অধিক অজ্ঞ।[1]

৫) আপন চাচার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তীব্র আকাঙ্খা ও প্রাণপন চেষ্টা করেছেন।

৬) যারা আবদুল মুত্তালিব এবং তার পূর্বসূরীদের মুসলিম হওয়ার দাবী করে, এখানে তাদের দাবী খন্ডন করা হয়েছে।

৭) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় চাচা আবু তালেবের জন্য মাগফিরাত চাইলেও তার গুনাহ মাফ হয়নি; বরং তার মাগফিরাত চাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।

৮) মানুষের উপর খারাপ বন্ধুদের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে থাকে।[2]

৯) পূর্বপুরুষ এবং সৎ লোকদের প্রতি অতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শনের কারণেই মানুষ গোমরাহ হয়।

১০) আবু জাহেল কর্তৃক পূর্ব পুরুষদের প্রতি অন্ধ ভক্তির যুক্তি প্রদর্শনের কারণে বাতিল পন্থীদের অন্তরে সংশয়ের সৃষ্টি হয়।

১১) সর্বশেষ আমলের শুভাশুভ পরিণতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ। কেননা আবু তালিব যদি শেষ মুহূর্তেও কালিমা পড়ত তাহলে তার বিরাট উপকার হত।

১২) এ বিষয়টিতে গভীরভাবে চিন্তা করা উচিৎ যে, গোমরাহীতে নিমজ্জিত লোকদের অন্তরে বাপ-দাদাদের রসম-রেওয়াজের প্রতি চরম ভালবাসা রয়েছে। কেননা আবু তালেবের ঘটনায় যা বর্ণিত হয়েছে, তা হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ঈমান আনার কথা বারবার বলার পরও কাফির মুশরিকরা তাদের পূর্ব পুরুষদের মিল্লাতের অনুসরণকেই যুক্তি হিসেবে পেশ করেছে। তাদের অন্তরে বাপ-দাদাদের ধর্মের প্রতি তাযীম থাকার কারণে এবং সেটি তাদের নিকট সুস্পষ্ট হওয়ার কারণেই তারা মাত্র একটি দলীলকে যথেষ্ট বলে মনে করেছে।

[*]- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেই হেদায়াতের মালিক নয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে, তা হচ্ছে হেদায়াতের তাওফীক দেয়া। আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কেউ এই প্রকার হেদায়াতের মালিক নয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَنْ تُؤْمِنَ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ

‘‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউই ঈমান আনতে পারেনা’’। (সূরা ইউনূসঃ ১০০) নূহ (আঃ) তাঁর পুত্রকে হেদায়াত করতে পারেন নি, স্ত্রীকেও সৎ পথে আনতে পারেন নি। ইবরাহীম খলীল (আঃ) তাঁর পিতাকে দ্বীনের পথে আনয়ন করার চেষ্টা করেও সফল হন নি। লুত (আঃ)এর ক্ষেত্রেও একই কথা। তাঁর স্ত্রীকে সুপথে আনতে পারেন নি। আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম ও ইসহাক (আঃ)এর ব্যাপারে বলেনঃ

وَبَارَكْنَا عَلَيْهِ وَعَلَى إِسْحَاقَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِهِمَا مُحْسِنٌ وَظَالِمٌ لِنَفْسِهِ مُبِينٌ

‘‘তাকে (ইবরাহীমকে) এবং ইসহাককে আমি বরকত দান করেছি। তাদের বংশধরদের মধ্যে কতক সৎকর্মী এবং কতক নিজেদের উপর স্পষ্ট যুলুমকারী। (সূরা সাফফাতঃ ১১৩)
আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেই প্রকার হেদায়াত করতে সক্ষম বলে কুরআন সাক্ষ্য দিয়েছে, তা হচ্ছে হেদায়াতের পথ দেখানো। তিনি এবং সকল নবী-রাসূলই মানুষকে হেদায়াতের পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা সূরা শুরার ৫২ নং আয়াতে বলেনঃ وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ‘‘নিশ্চয় আপনি সরল পথপ্রদর্শন করেন’’।

[1] - এখানে সম্মানিত লেখক ঐ সমস্ত অজ্ঞ মুসলিমদেরকে বুঝিয়েছেন, যারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবী করে, কিন্তু ইসলামের মূল বাণী তথা কালেমা তায়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর অর্থ বুঝেনা। অর্থ না বুঝার কারণে তারা এর মর্মার্থের বিপরীত কর্ম-কান্ডে যেমন পীর, কবর ও মাজার পূজায় লিপ্ত হয়।

[2] - তাই তো কবি শেখ সাদী বলেছেনঃ সৎ সঙ্গে সর্গবাস অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।