তাওহীদের ফযীলত এবং তাওহীদ যে সমস্ত গুনাহ্ মিটিয়ে দেয় - ২

উপরে বর্ণিত হাদীছে আল্লাহ্ এবং নবী-রাসূলদের শত্রু ইহুদীদেরও প্রতিবাদ করা হয়েছে। ইহুদী-খৃষ্টান, -এই উভয় দলই ঈসা (আঃ)এর ব্যাপারে পরস্পর বিরোধী কথা বলে। আল্লাহর দুশমন ইহুদীরা বলেঃ ঈসা (আঃ) জারজ সন্তান। আল্লাহ্ এদেরকে ধ্বংস করুন। আল্লাহ্ তাআলা স্বীয় কিতাবে তাদের কথাকে মিথ্যায়ন করেছেন, তাদেরকে মিথ্যুক বলেছেন এবং তাদের ধারণাকে বাতিল করে দিয়েছেন। এমনি উপরোক্ত এবং অন্যান্য আয়াতে ঈসা (আঃ)কে নিয়ে খৃষ্টানদের বাড়াবাড়িরও প্রতিবাদ করেছেন। সুতরাং খৃষ্টানরা ঈসা (আঃ)এর বিষয়ে সীমালঙ্ঘন, বাড়াবাড়ি, কুফরী ও গোমরাহীতে লিপ্ত রয়েছে। অপর পক্ষে ইহুদীরা তাঁর সাথে মারাত্মক দুর্ব্যবহার করেছে। উভয় দলই প্রকাশ্য গোমরাহীর মধ্যে রয়েছে। কুরআনের অনেক স্থানেই আল্লাহ্ তাআলা তাদের এই গোমরাহীর বিষয়টি তুলে ধরেছেন। এ ব্যাপারে মূল সত্যটি পরিস্কারভাবে বর্ণনা করার মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলা তাঁর শানকে উন্নীত করেছেন এবং তাঁকে পাঁচজন উলুল আযম রাসূলদের কাতারে শামিল করেছেন। সূরা আহযাব ও শুরায় তাদের বর্ণনা একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা আহযাবের ৭ নং আয়াতে বলেনঃ

وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُمْ وَمِنْكَ وَمِنْ نُوحٍ وَإِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِيثَاقًا غَلِيظًا

‘‘যখন আমি নবীগণের কাছ থেকে, তোমার কাছ থেকে এবং নূহ, ইব্রাহীম, মূসা ও মারইয়ামের পুত্র ঈসার কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম এবং অঙ্গীকার নিলাম তাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার। আর সূরা শুরার ১৩ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيبُ

‘‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারণ করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি তোমার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করোনা। তুমি মুশরিকদেরকে যে বিষয়ের প্রতি আমন্ত্রণ জানাও, তা তাদের কাছে দুঃসাধ্য বলে মনে হয়। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন এবং যে তাঁর অভিমূখী হয়, তাকে পথ প্রদর্শন করেন’’। আল্লাহ্ তাআলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উলুল আযম রাসূলদের ন্যায় সবর করার আদেশ দিয়েছেন। সূরা আহকাফের ৩৫ নং আয়াতে তিনি বলেনঃ

فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُوْلُوا الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلَا تَسْتَعْجِلْ لَهُمْ

‘‘অতএব, তুমি সবর করো, যেমন সুদৃঢ় মনোবলের অধিকারী রাসূলগণ সবর করেছেন এবং ওদের বিষয়ে তড়িঘড়ি করবে না’’।

উপরোক্ত ব্যাখ্যা থেকে জানা গেল, সমস্ত নবী-রাসূলের মধ্যে উলুল আযম রাসূলগণ তথা নূহ, ইবরাহীম, মুসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সর্বাধিক উত্তম। এদের মধ্যে এবং অন্যান্য সকল নবী-রাসূলদের মধ্যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বোত্তম। তাঁর উপর এবং সকল নবী-রাসূলের উপর এবং কিয়মাত পর্যন্ত উত্তমভাবে তাদের অনুসরণকারীদের উপর আল্লাহর দুরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক।

জান্নাত সত্যঃ এ কথার সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হল এই বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ্ তাআলা মুমিন বান্দাদের জন্য জান্নাত তৈরী করে রেখেছেন। কিয়ামতের দিন তারা এতে প্রবেশ করবে। এটি চিরকাল থাকবে। এতে রয়েছে সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ, ফলফলাদি, চিরস্থায়ী নেয়ামত এবং আল্লাহর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকার স্বাদসহ অফুরন্ত নেয়ামত। আল্লাহ্ তাআলা সূরা হুদের ১০৮ নং আয়াতে বলেনঃ

وَأَمَّا الَّذِينَ سُعِدُوا فَفِي الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ عَطَاءً غَيْرَ مَجْذُوذٍ

‘‘আর যারা সৌভাগ্যবান তারা অবস্থান করবে বেহেশতের মাঝে, সেখানেই চিরদিন থাকবে, যতদিন আসমান ও যমীন বর্তমান থাকবে। তবে তোমার প্রতিপালক অন্য কিছু ইচ্ছা করলে ভিন্ন কথা। এ দানের ধারাবাহিকতা কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়’’। আল্লাহ্ তাআলা সূরা সিজদার ১৭ নং আয়াতে বলেনঃ

فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاء بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

‘‘কেউ জানেনা তাদের কৃতকর্মের জন্য নয়ন শীতলকারী কী প্রতিদান লুকায়িত আছে’’।

জাহান্নাম সত্যঃ এই সাক্ষ্য দানের তাৎপর্য হল, মুমিনগণ এই বিশ্বাস করবে যে, জাহান্নাম হচ্ছে আযাবের স্থান। যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করবে, তাঁর এবাদত, প্রভুত্ব ও মালিকানায় শির্ক করবে এবং তাঁর নাম ও গুণাবলীতে পরিবর্তন করবে, তিনি তাদের জন্য এটি প্রস্ত্তত রেখেছেন। কিয়ামতের দিন তারা তাতে প্রবেশ করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতি ঈমান আনবেনা সে কুরআন এবং রাসূলগণ যা নিয়ে এসেছেন, তার প্রতি কুফরী করল। কেননা আল্লাহ্ তাআলা কুরআনে জান্নাত ও জান্নাতের চিরস্থায়ী নেয়ামতের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি আরো বর্ণনা করেছেন যে, জান্নাত হচ্ছে আল্লাহ্ ভীরুদের বাসস্থান। আল্লাহ্ তাআলা কুরআনে জাহান্নামের বর্ণনাও দিয়েছেন এবং তাতে যে শাস্তি রয়েছে, তারও বিবরণ দিয়েছেন। আর এটিকে তিনি কাফের-মুশরিকদের জন্য তৈরী করে রেখেছেন।

তাকে আল্লাহ তাআলা জান্নাত দান করবেন, তার আমল যাই হোক না কেনঃ অর্থাৎ যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য দিল যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তিনি একক। তাঁর কোন শরিক নেই। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। ঈসা (আঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, তিনি তাঁর এমন এক কালিমা, যা তিনি মারইয়াম (আঃ) এর প্রতি প্রেরণ করেছেন এবং তিনি তাঁরই পক্ষ থেকে প্রেরিত একটি রুহ। জান্নাত সত্য জাহান্নাম সত্য, আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাত দান করবেন। তার আমল যাই হোক না কেন। অর্থাৎ তাঁর ইখলাস তথা একনিষ্ঠতার সাথে উপরোক্ত বিষয়গুলোর ঘোষণা দেয়ার কারণে, সত্য বিষয়গুলোর সত্যায়ন করার কারণে, নবী-রাসূলদের প্রতি এবং তাদেরকে যেই নবুওয়াত ও রেসালাত দেয়া হয়েছে, তার প্রতি ঈমান আনয়নের কারণে, খৃষ্টান ও ইহুদীরা ঈসা (আঃ)এর ব্যাপারে যেই বাড়াবাড়ি ও দুর্ব্যবহার করেছে তার প্রতিবাদ ও বিরোধীতা করার কারণে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সে ঈসা (আঃ)এর ব্যাপারে আরও দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেছে যে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতিও ঈমান আনয়ন করেছে। যার আমল ও অবস্থা এই রকম হবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যদিও সৎকর্ম সম্পাদনে তার ত্রুটি রয়েছে এবং তাঁর বেশ কিছু গুনাহ্ও রয়েছে। এ সৎআমলটি অর্থাৎ নির্ভেজাল তাওহীদের ঘোষণা অন্যান্য সকল গুনাহ্-এর তুলনায় ভারী হয়ে যাবে। হে পাঠক! আপনি এই গুরুত্বপূর্ণ হাদীছটি ভাল করে বুঝে নিন।

ইমাম বুখারী ও মুসলিম সাহাবী ইতবান রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

«فَإِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ يَبْتَغِى بِذَلِكَ وَجْهَ اللَّهِ»

‘‘আল্লাহ তাআলা এমন ব্যক্তির উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেছে’’।[11]

............................................................

ব্যাখ্যাঃ এটি বুখারী ও মুসলিম শরীফের একটি দীর্ঘ হাদীছের অংশ। লেখক তা থেকে শুধু ঐ টুকুই বর্ণনা করেছেন, যা এ অধ্যায়ের জন্য প্রযোজ্য। কালেমায়ে তায়্যেবার এটিই প্রকৃত অর্থ। এ পবিত্র বাক্যটি এবাদতের মধ্যে ইখলাসের দাবী জানায় এবং শির্ককে সম্পূর্ণরূপে নাকোচ করে। সিদ্ক এবং ইখলাস এই দু’টি বিষয় এমন, যার একটি অন্যটির সাথে জড়িত। এ দু’টির একটিকে অন্যটি ছাড়া কল্পনাও করা যায়না। বান্দা যদি এবাদতের মধ্যে একনিষ্ঠ না হয়, তাহলে সে মুশরিক হিসাবে গণ্য হবে। আর যদি সত্যবাদী না হয়, তাহলে মুনাফেক হিসাবে গণ্য হবে। মুখলিস হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে কালেমায়ে তাওহীদ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’কে জবান দিয়ে পাঠ করার সাথে সাথে খালেসভাবে কেবল আল্লাহর এবাদত করে। এর নামই তাওহীদ। এটিই ইসলামের মূল কথা। ইবরাহীম (আঃ) এই বিষয়ে বলেছেনঃ

رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

‘‘হে আমাদের রব! আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ করো এবং আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি করো, আমাদের হজ্জের রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের ক্ষমা করো। নিশ্চয়ই তুমি তাওবা কবুলকারী, দয়ালু’’। (সূরা বাকারাঃ ১২৮) ইয়ামানের সাবা শহরের রাণী বিলকীস বলেছিলঃ

رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي وَأَسْلَمْتُ مَعَ سُلَيْمَانَ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

‘‘হে আমার প্রতিপালক, আমি তো নিজের প্রতি যুলুম করেছি। আমি সুলায়মানের সাথে সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক আল্লাহ্‌র কাছে আত্মসমর্পন করলাম’’। (সূরা নামলঃ ৪৪) ইবরাহীম খলীল (আঃ) বলেছিলেনঃ

إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ حَنِيفاً وَمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

‘‘আমি একনিষ্ঠ হয়ে স্বীয় চেহারা ঐ সত্তার দিকে ফিরাচ্ছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই’’। (সূরা আনআমঃ ৭৯) হানীফ ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে সম্পূর্ণরূপে শির্ক বর্জন করে, শির্কের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল আমল ও এবাদত কেবল আল্লাহ্ তাআলার জন্যই সম্পাদন করে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা লুকমানের ২২ নং আয়াতে বলেনঃ

وَمَن يُسْلِمْ وَجْهَهُ إِلَى اللَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى

‘‘যে ব্যক্তি সৎকর্মপরায়ণ হয়ে স্বীয় মুখমণ্ডলকে আল্লাহ্ অভিমুখী করে, সে এক মজবুত হাতল ধারণ করে’’। মুখমণ্ডলকে আল্লাহ্ অভিমুখী করার অর্থ হচ্ছে, বান্দা তাঁর এবাদতকে একমাত্র আললাহর জন্য এমনভাবে খালেস করবে যে, তাতে যেন কোন প্রকার শির্ক বা নিফাক স্থান না পায়। আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে এটিই হচ্ছে এ আয়াত এবং অন্যান্য আয়াতের অর্থ। যার অবস্থা এ রকম হবে, কালেমায়ে তাইয়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ কেবল তারই উপকার করবে। এ জন্যই আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেনঃ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى ‘‘সে এক মজবুত হাতল ধারণ করল’’।[12] কিন্তু যে ব্যক্তি কালেমায়ে তাওহীদ পাঠ করার সাথে সাথে আল্লাহ্ ছাড়া অন্যকে আহবান করবে, জীবিত কিংবা মৃত এমন অলীর কাছে সাহায্য চাইবে, যে উপকার কিংবা ক্ষতির মালিক নয় তার কালেমা পাঠ কোন উপকার করবেনা। অধিকাংশ বনী আদমের অবস্থা বর্তমানে এ রকমই। তারা জবানের মাধ্যমে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করলেও তাদের কাজ তাদের কথার বিপরীত। কালেমায়ে তাওহীদ তখনই পাঠকের উপকারে আসবে যখন সে নেতিবাচক ও ইতিবাচকের সাথে এর অর্থ ভালভাবে উপলদ্ধি ও বিশ্বাস করার পরই তা পাঠ করবে। কালেমাটির অর্থ সম্পর্কে যে ব্যক্তি অজ্ঞ, কালেমাটি তাঁর কোন উপকার করবেনা।[13] কেননা আরবী ভাষায় যে অর্থে এই পবিত্র বাক্যটি তৈরী করা হয়েছে তা সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আর তা হচ্ছে শির্ককে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করা। এমনিভাবে যে ব্যক্তি এর অর্থ জানবে ও বুঝবে, কিন্তু অন্তর দিয়ে তা বিশ্বাস করবেনা, কালেমাটি তারও কোন উপকার করবেনা। কেননা যখন কোন বিষয়ে কারো ইয়াকীন চলে যাবে, তখন ঐ বিষয়ে তার অন্তরে সন্দেহ প্রবেশ করবে। এ জন্যই মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায়غَيْرَ شَاكٍ কথাটি এসেছে। অর্থাৎ কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করার সময় আল্লাহ্ তাআলার ওয়াহ্দানিয়াত সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ পোষণ করলে কোন উপকার হবেনা। সুতরাং ইলম ও ইয়াকীন ব্যতীত কালেমাটি পাঠ করলে পাঠকের কোন উপকার হবেনা। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ صِدْقًا مِنْ قَلْبِهِ خَالِصاً مِنْ قَلْبِهِ অর্থাৎ পূর্ণ বিশ্বাস এবং একনিষ্ঠতার সাথে কালেমাটি পাঠ করলেই উপকার হবে। এমনি যে ব্যক্তি সত্যবাদী এবং একনিষ্ঠ না হয়ে কালেমাটির স্বীকারোক্তি প্রদান করবে, ঐ ব্যক্তির জন্য কালেমাটি উপকারী হবেনা। কেননা তাঁর অন্তর মুখের স্বীকারোক্তির বিরোধী। মুনাফিকদের অবস্থা এ রকমই। তারা মুখে এমন কথা বলে, যা তাদের অন্তরে নেই। এমনি অবস্থা মুশরিকদেরও। মুশরিকদের থেকেও এই কালেমাটি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা র্শিক এবাদতের ক্ষেত্রে ইখলাস ও কালেমায়ে তাওহীদের তাৎপর্যের পরিপন্থী। কালেমায়ে তাওহীদ যেমন আল্লাহর কোন শরীক হওয়াকে অস্বীকার করে, তেমনি শির্কের সাথে সম্পর্কচ্ছেদেরও ঘোষণা দেয় এবং একমাত্র আল্লাহর জন্য পরিপূর্ণ ইখলাসেরও প্রমাণ বহন করে। সুতরাং যার স্বীকারোক্তি এই মর্মার্থ হতে মুক্ত হবে, তার এ কালেমার স্বীকারোক্তি কোন কাজে আসবেনা। এটিই হচ্ছে মাজার পূজারীদের অবস্থা। তারা মুখে বলে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’। কিন্তু তারা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করতে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, তারা তাওহীদপন্থীদের সাথে শত্রুতাও পোষণ করে এবং শির্ক ও মুশরিকদের সাহায্যও করে। ইবরাহীম খলীল (আঃ) তাঁর পিতা ও স্বগোত্রীয় লোকদেরকে বলেছিলেনঃ

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِي بَرَاء مِّمَّا تَعْبُدُونَ إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُ سَيَهْدِينِ وَجَعَلَهَا كَلِمَةً بَاقِيَةً فِي عَقِبِهِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ

‘‘আর যখন ইবরাহীম তার পিতা এবং তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন, তোমরা যাদের পূজা কর, তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তবে আমার সম্পর্ক তাঁর সাথে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব, তিনিই আমাকে সৎপথ প্রদর্শন করবেন। এ কথাটিকে তিনি অক্ষয় বাণী স্বরূপ তার সন্তানদের মধ্যে রেখে গেছেন, যাতে তারা আল্লাহ্‌র দিকেই ফিরে আসে’’। (সূরা যুখরুফঃ ২৬-২৮) এটিই হচ্ছে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর সঠিক অর্থ। ইবরাহীম খলীল (আঃ) তাঁর জবানের মাধ্যমে এই অর্থটিকেই প্রকাশ করেছেন। এই অর্থটির জন্যই কালেমাটি গঠন করা হয়েছে এবং তা এই অর্থই প্রকাশ করে। সেটি হচ্ছে শির্ক থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহর এবাদত করা, এতে তার কোন শরীক নেই। ইতিপূর্বে এর বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। এমনিভাবে যে ব্যক্তি কালেমাটি পাঠ করবে, কিন্তু এটি যেই ইখলাসের প্রমাণ বহন করে, তা কবুল করেনি, সে এই বাক্যটি পাঠে মিথ্যুক হিসাবে গণ্য হবে। শুধু তাই নয়; বরং এই কালেমাটির অর্থ পরিবর্তনকারী হিসাবে গণ্য হবে, কালেমায়ে তায়্যেবা যেই শির্ককে অস্বীকার করেছে, সেটিকেই সাব্যস্ত করবে এবং এটি যেই ইখলাসকে সাব্যস্ত করে তা অস্বীকারকারী হিসাবে গণ্য হবে।

ইসলামের প্রথম তিন যুগের পর উম্মতে মুহাম্মাদীর অধিকাংশ লোকের অবস্থা এ রকমই। এর কারণ হচ্ছে, কালেমায়ে তাওহীদের অর্থ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করা। এই মূর্খতা ও প্রবৃত্তির অনুসরণই মানুষকে সত্য গ্রহণ এবং আল্লাহ্ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য যেই দ্বীন ও তাওহীদসহ নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন তা কবুল করতে বাধা দেয়।

প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি এরশাদ করেছেন, মূসা (আঃ) বললেনঃ হে আমার রব! আমাকে এমন জিনিস শিক্ষা দিন যা দ্বারা আমি আপনাকে স্মরণ করব এবং আপনাকে ডাকব। আল্লাহ বললেন, ‘হে মূসা! তুমি لا إله إلا الله বল। মূসা বললেনঃ তোমার সব বান্দাই তো এটা বলে। তিনি বললেনঃ হে মূসা! আমি ব্যতীত সপ্তাকাশে যা কিছু আছে তা আর সাত তবক যমীন যদি এক পাল্লায় থাকে এবং আরেক পাল্লায় যদি শুধু لا إله إلا الله থাকে তাহলেلا إله إلا الله -এর পাল্লাই বেশী ভারী হবে’’।[14]

..............................................................

ব্যাখ্যাঃ لا إله إلا الله-এর মধ্যে ব্যবহৃত لا অক্ষরটি লায়ে নফী জিন্স। এই প্রকার لا এর পরে যে বিষয়টি আসে, লা-এর মাধ্যমে উক্ত বিষয়ের সকল প্রকারকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে শুধু إلا-এর পরে উল্লেখিত বিষয়টির জন্য তা সাব্যস্ত করা হয়। সুতরাং এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। এখানে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর তা হচ্ছে لا- এর খবর উহ্য রয়েছে। মূলতঃ বাক্যটি এরূপ لاإله حق إلا الله অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া কোন সত্য মাবুদ নেই।[15] সূরা হজ্জের ৬২ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِن دُونِهِ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ

‘‘এটা এ কারণে যে, আল্লাহ্ই সত্য; তার পরিবর্তে তারা যাকে ডাকে, তা অসত্য এবং আল্লাহ্ই সবার উচ্চে’’। সুতরাং আল্লাহই সত্য ইলাহ্। তিনিই এবাদতের একমাত্র হকদার। তিনি ব্যতীত যত ইলাহ আছে, তার সবই বাতিল। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে এই আয়াতে এবং অন্যান্য আয়াতসমূহে।

সুতরাং এটিই অর্থাৎ لا إله إلا الله হচ্ছে মহান কালেমা, এটিই মজবুত হাতল, এটিই কালিমাতুত তাকওয়া এবং এটিই কালিমাতুল ইখলাস। এর উপরই আসমান-যমীনের ভিত্তি, এর পূর্ণতার জন্যই ফরয ও সুন্নাতসমূহকে শরীয়তের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে, পৃথিবীতে এর শিক্ষা ও দাবীকে বাস্তবায়নের জন্যই তলোয়ার কোষমুক্ত করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমেই আল্লাহর বান্দাদের মধ্য হতে অনুগত ও নাফরমান বান্দাদের মধ্যে পার্থক্য হয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি সত্যায়ন, ইখলাস, মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নিয়ে, মুহাববত এবং বিনয়ের সাথে এই বাক্যটি পাঠ করবে এবং এর উপর আমল করবে, আল্লাহ্ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তার আমল যাই হোক না কেন।

সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

أَفْضَلُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ وَأَفْضَلُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنَّبِيُّونَ مِنْ قَبْلِى لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهْوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ

‘‘সর্বোত্তম দুআ হচ্ছে আরাফা দিবসের দুআ। আমি এবং আমার পূর্বের নবীগণ যা বলেছেন, তার মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছেঃ

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهْوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ

আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি একক। তাঁর কোনো শরীক নেই। মালিকানা তাঁরই। সমুদয় প্রশংসা তাঁরই জন্য। তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান’’।[16]

আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে মারফু সূত্রে বর্ণিত হাদীছে এসেছে, কিয়ামতের দিন সমস্ত সৃষ্টির সামনে আমার উম্মতের একজন লোকের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকা হবে এবং তার সামনে ৯৯টি রেজিষ্টার বই খোলা হবে। চোখের দৃষ্টি যত দূর যায়, ততদূর লম্বা হবে এক একটি রেজিষ্টার। অতঃপর তাকে বলা হবে, তুমি কি এ সমস্ত আমল থেকে কোনো কিছু অস্বীকার করতে পারবে? সে বলবেঃ হে আমার প্রতিপালক! না। কোন কিছুই অস্বীকার করতে পারবনা। তাকে বলা হবেঃ তোমার কোন ওজর (অযুহাত) আছে কি? অথবা তোমার কোন নেকী আছে কি? তখন লোকটি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বলতে থাকবেঃ না, আমার কোন নেক আমল নেই। অতঃপর বলা হবেঃ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমাদের কাছে তোমার একটি নেকী রয়েছে। তোমার উপর কোন প্রকার যুলুম করা হবেনা। অতঃপর তার জন্য একটি কার্ড বের করা হবে। তাতে লেখা থাকবেঃ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোনো সত্য উপাস্য নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল। লোকটি তখন বলবেঃ হে আমার প্রতিপালক! এত বিশাল বিশাল বইগুলোর সামনে এই কার্ডটির কোন মূল্য আছে কি? তখন তাকে বলা হবেঃ তোমার উপর কোন রকম যুলুম করা হবেনা। এ কথা বলার পর রেজিষ্টারগুলো রাখা হবে এক পাল্লায় এবং কার্ডটি রাখা হবে আরেক পাল্লায়। এতে বইগুলোর পাল্লা হালকা হয়ে যাবে এবং কার্ডটির পাল্লা ভারী হয়ে যাবে।[17]

আমি ব্যতীত সপ্তাকাশে যা কিছু আছে তা, আর সাত যমীন যদি এক পাল্লায় রাখা হয়ঃ এখানে আসমান ও যমীনে যা আছে, তার সবই উদ্দেশ্য। আর আমি ব্যতীত এ কথার মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলা স্বীয় সত্তাকে আসমানবাসী থেকে আলাদা করেছেন। কেননা তার পবিত্র সত্তা সব কিছুর উর্ধ্বে। আল্লাহ্ তাআলা সুরা বাকারার ২৫৫ নং এবং সূরা শুরার ৪ নং আয়াতে বলেনঃ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ ‘‘তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান’’। অর্থাৎ তার ক্ষমতা সর্বোচ্চ, তার মর্যাদা সর্বোচ্চ এবং তার সত্তা সকলের উর্ধ্বে। ক্ষমতা, মর্যাদা এবং উঁচু হওয়া- এই তিনটির প্রত্যেকটিই আল্লাহর সিফাত। এগুলো আললাহ্ তাআলার কামালিয়াতের প্রমাণ বহন করে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى

‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। (সূরা তোহাঃ ৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ الرَّحْمَانُ

‘‘অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন। তিনি পরম দয়াময়’’। (সূরা ফুরকানঃ ৫৯) এভাবে কুরআনের সাতটি আয়াতে আল্লাহ্ তাআলার আরশে সমুন্নত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَالْعَمَلُ الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ

‘‘তাঁর কাছে শুধু পবিত্র কথাই উপরের দিকে আরোহণ করে এবং তিনি সৎকর্ম উন্নীত করেন’’। (সূরা ফাতিরঃ ১০) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

يَخَافُونَ رَبَّهُمْ مِنْ فَوْقِهِمْ

‘‘তারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, যিনি তাদের উপরে’’। (সূরা নাহ্লঃ ৫০) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

تَعْرُجُ الْمَلاَئِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ

‘‘ফেরেশতা এবং রূহ (জিবরীল) তাঁর দিকে উর্ধ্বগামী হয় এমন একদিনে যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর।’’। (সূরা মাআরেজঃ ৪) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

إِذْ قَالَ اللَّهُ يَاعِيسَى إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ

‘‘আল্লাহ যখন বললেনঃ হে ঈসা! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে মৃত্যু দান করবো[18] এবং তোমাকে আমার দিকে উঠিয়ে নেব’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ৫৫) এ রকম আরো অনেক আয়াত রয়েছে যা প্রমাণ করে আল্লাহ্ তাআলা উপরে সমুন্নত। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তাআলা মাখলুকের উপরে থাকার গুণটি অস্বীকার করল, সে কুরআন ও সুন্নাহ্র সুস্পষ্ট দলীলের বিরোধীতা করল এবং আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে পরিবর্তন ও বিকৃতি করল। উপরোক্ত হাদীছাংশে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য সকল বস্ত্তর উলুহীয়াত ও উবুদীয়াতকে অস্বীকার করা হয়েছে। উপরোক্ত হাদীছে আরো প্রমাণ পাওয়া যায় যে, আসমানের ন্যায় যমীনও সাতটি।

এই বিশাল বিশাল সৃষ্টির মুকাবেলায় কেবল ঐ ব্যক্তির ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’র পাল্লা ভারী হবে যে কুরআন ও সুন্নাহ্য় বর্ণিত শর্তসহ এই মহান বাক্যটি পাঠ করবে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সূরা তাওবা এবং অন্যান্য সূরায় এমন অনেক লোকের আলোচনা করেছেন, যারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বলে, কিন্তু এই পবিত্র বাক্যটি তাদের কোন উপকারে আসবেনা। ইহুদী, খৃষ্টান ও মুনাফেকদের অবস্থা এমনই। এদের সংখ্যা প্রচুর। এদের নিফাকীও বহুরূপী। তাদের স্বীকারোক্তি কোন কাজে আসেনি। কেননা তারা শর্তগুলো পালন সাপেক্ষ এই কালেমাটি পাঠ করেনি। তাদের কেউ কালেমার মর্ম না জেনেই তা পাঠ করেছে। অর্থাৎ যে অর্থে কালেমাটি তৈরী করা হয়েছে, তা না জেনেই পাঠ করছে। এই কালেমাটির মাকসুদ হচ্ছে শির্ক প্রত্যাখ্যান করা এবং তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া। সেই সাথে সত্যকে মনেপ্রাণে কবুল করা এবং ইখলাসের সাথে আল্লাহর এবাদত করাই এই কালেমার মাকসুদ। এ ছাড়া যে ব্যক্তি এই কালেমার অন্য কোন অর্থ বুঝার এবং তার উপর আমল করার আহবান জানায়, তার কথা গ্রহণ করা যাবেনা। এই কালেমার দাবী অনুযায়ী আনুগত্য বর্জন করা কালেমার মাকসুদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অতীত ও বর্তমানের অধিকাংশ লোকের অবস্থা এ রকমই। তারা কালেমা পাঠ করলেও এর অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞ এবং এর দাবী অনুযায়ী আমল করতেও তারা প্রস্ত্তত নয়। পরবর্তী কালের অধিকাংশ লোকের অবস্থা এ রকমই।

কতক লোক এমন আছে, যাদের অন্তরে অহংকার, কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ এবং অন্যান্য দোষ-ত্রুটি থাকার কারণে কালেমার প্রতি ভালবাসা পোষণ করতে এবং এর দাবী অনুযায়ী আমল করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সূরা তাওবার ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ

‘‘বলোঃ তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা, যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান, যাকে তোমরা পছন্দ কর, এসব কিছু আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহ্‌র বিধান আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ্ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না’’।

সুতরাং খাঁটি ঈমানদারগণ যখন জবান দিয়ে এই কালেমাটি পাঠ করে, তখন অন্তর দিয়ে অনুধাবন করেই পাঠ করে এবং এর দাবী অনুযায়ী আমল করে। তারা কালেমার শর্তগুলোও বাস্তবায়ন করে।[19] শর্তগুলো হচ্ছে, কালেমার অর্থ জানা, তা নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করা, সত্যায়ন করা, একনিষ্ঠতা, এর মর্মার্থকে ভালবাসা, কবুল করে নেওয়া এবং অনুগত হওয়া। সেই সঙ্গে তারা কেবল আল্লাহর জন্যই কারও সাথে শত্রুতা পোষণ করে এবং আল্লাহর জন্যই কাউকে বন্ধু বানায়। কাউকে ভালবাসা বা ঘৃণা করার ক্ষেত্রেও কথা একই। সত্যিকার মুমিনদের অবস্থা আল্লাহ্ তাআলা সুরা তাওবায় এবং কুরআনের অন্যান্য স্থানে আলোচনা করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা তাদের প্রশংসা করেছেন, তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেছেন, তাদের জন্য জান্নাত তৈরী করেছেন এবং জাহান্নাম থেকে তাদেরকে পরিত্রাণ দেয়ার ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاء بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاَةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللّهَ وَرَسُولَهُ أُوْلَـئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللّهُ إِنَّ اللّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

‘‘আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ্ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে। অচিরেই এদের উপর আল্লাহ্ দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান’’। (সূরা তাওবাঃ ৭১) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَالسَّابِقُونَ الأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللّهُ عَنْهُمْ وَرَضُواْ عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَداً ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

‘‘আর যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী ও আনসারদের মাঝে অগ্রগামী এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ্ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন বেহেশত, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এটাই হল মহান সফলতা’’। (সূরা তাওবাঃ ১০০) এ রকম আরো অনেক আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা খাঁটি ঈমানদারদের প্রশংসা এবং পরকালে তাদের জন্য প্রস্ত্ততকৃত নেয়ামতের আলোচনা করেছেন। এ সমস্ত সাহাবী এবং উত্তমভাবে তাদের অনুসারীগণই হচ্ছেন লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর প্রকৃত অনুসারী।

যে ব্যক্তি কুরআন নিয়ে গবেষণা করবে, সে আল্লাহ্কে ভালবাসার ক্ষেত্রে, তার তাওহীদের ক্ষেত্রে, তার আনুগত্যের ক্ষেত্রে, তার নাফরমানী থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে, আগ্রহ ও আমলসহ আল্লাহর প্রিয় বস্ত্তকে প্রাধান্য দেয়ার ক্ষেত্রে এবং ভয়-ভীতিসহ আল্লাহর অপছন্দনীয় বস্ত্ত বর্জন করার ক্ষেত্রে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখতে পাবে। এমনি সে ব্যক্তি মানুষের অবস্থা, কথা-বার্তা, কর্ম, নিয়ত-উদ্দেশ্য এবং তাদের মধ্যে অন্যান্য বিষয়ে বিরাট পার্থক্য দেখতে পাবে এবং তার কাছে অহংকারী ও দাম্ভিক লোকদের বিভ্রান্তি সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। সহীহ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে,

«الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ وَالْعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا وَتَمَنَّى عَلَى اللَّهِ»

‘‘প্রকৃত জ্ঞানী হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে নিজের নফ্সের হিসাব নিল এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য আমল করল। অক্ষম হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে স্বীয় ন্ফসের চাহিদা পূরণে প্রবৃত্তির অনুসরণ করল এবং আমল ছেড়ে দিয়ে নিজের আশা-আকাঙ্খা পূরণে আল্লাহর উপর ভরসা করে বসে থাকল।[20]

আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেনঃ আল্লাহ্ তাআলা হাদীছে কুদছীতে বলেছেনঃ

«يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِى بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِى لاَ تُشْرِكُ بِى شَيْئًا لأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً»

‘‘হে বনী আদম! তুমি যদি যমীন পরিপূর্ণ গুনাহ্ নিয়ে আমার কাছে আগমণ কর এবং আমার সাথে অন্য কিছুকে শরীক না করে মিলিত হও, তাহলে যমীন পরিপূর্ণ ক্ষমাসহ আমি তোমার সাথে সাক্ষাৎ করবো।[21]

.........................................................

ব্যাখ্যাঃ এই হাদীছে এমন কথা বর্ণিত হয়েছে, যা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর অর্থকে খোলাসা করেছে। এ জন্যই এটি সমস্ত মাখলুক এবং সকল পাপের মুকাবেলায় ভারী হয়ে যাবে। আর সেই কথাটি হচ্ছে এককভাবে আল্লাহর এবাদত করার সাথে সাথে ছোট-বড়, কম-বেশী সকল শির্ক বর্জন করা। এটিই হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ তাওহীদের দাবী। যে তাওহীদ বাস্তবায়ন এবং কালেমায়ে ইখলাসের দাবী পূরণ করতে পারবেনা, সে কখনই শির্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারবেনা। কালেমায় ইখলাসের দাবী ও শর্তগুলো পূর্বে আলোচিত হয়েছে। আর তা হচ্ছে কালেমার অর্থ জানা, তা নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করা, সত্যায়ন করা, একনিষ্ঠতা, এর মর্মার্থকে ভালবাসা, কবুল করে নেওয়া, অনুগত হওয়া ইত্যাদি আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ

‘‘সে দিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন উপকারে আসবেনা; কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে আসবে’’। (সূরা শুআরাঃ ৮৮-৮৯)

[11] - বুখারী, অধ্যায়ঃ বাড়িঘরে নামাযের স্থান নির্ধারণ করা, মুসলিম, অধ্যায়ঃ জামাআতের সাথে নামায পড়া হতে বিরত থাকার অনুমতি।

[12] - العروة الوثقى উরওয়াতুল উছকা হচ্ছে মজবুত হাতল বা রশি। এই রশিকে যে আঁকড়ে ধরবে, রশিটি কখনো ছিড়বেনা এবং সে রশি থেকে বিচ্ছিন্নও হবেনা। এটি তাকে সরাসরি জান্নাতে নিয়ে যাবে। এখানে একটি হাদীছ উল্লেখ করার প্রয়োজন অনুভব করছি। আশা করি এর মাধ্যমে এই রশির অর্থ পরিস্কার হবে। সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন সালামের ফযীলতে ইমাম বুখারী (রঃ) কাইস বিন আববাদের সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। কাইস বলেনঃ আমি একদা মদীনার মসজিদে বসা ছিলাম। তখন একজন লোক মসজিদে প্রবেশ করল। তার চেহারায় ছিল বিনয় ও একাগ্রোতার ছাপ। লোকেরা বললঃ এই লোকটি জান্নাতের অধিবাসী। লোকটি খুব সংক্ষেপে দুই রাকআত নামায আদায় করল। অতঃপর সে মসজিদ হতে বের হয়ে গেল। আমিও তার পিছনে বের হলাম। আমি লোকটিকে বললামঃ তুমি যখন মসজিদে প্রবেশ করেছিলে, তখন লোকেরা বলেছেঃ এই লোকটি আহলে জান্নাতের অন্তর্ভূক্ত। লোকটি বললঃ আল্লাহর কসম! কারো জন্য এমন কথা বলা উচিৎ নয়, যা সে জানেনা। অচিরেই আমি তোমাকে এর কারণ খুলে বলবো।

আসল ব্যাপার এই যে, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানায় একটি স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নটি আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বর্ণনা করলাম। আমি স্বপ্নে দেখি আমি যেন একটি বাগানের মধ্যে আছি। এ কথা বলে তিনি বাগানের প্রশস্ততা ও তার সবুজ শ্যামল শোভার কথা উল্লেখ করলেন। তারপর বললেনঃ বাগানের মধ্যভাগে ছিল লোহার একটি খুঁটি। খুঁটির নীচের ভাগ ছিল মাটির মধ্যে এবং তার উপরের অংশ ছিল আকাশে। তার উপরের প্রান্তে রয়েছে একটু রশি। আমাকে বলা হলঃ এতে আরোহণ কর। আমি বললামঃ আমি তো পারছি না। এমন সময় আমার কাছে একজন খাদেম এসে পেছন দিক থেকে আমার কাপড় উঁচু করে ধরল। তখন আমি আরোহণ করতে লাগলাম। অবশেষে স্তম্ভটির উপরের প্রান্তে পৌঁছে রশিটা ধরে ফেললাম। তখন আমাকে বলা হল, দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরো। তারপর আমি ঐ রশিটা আমার হাতে ধরা অবস্থায় জেগে উঠলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আমার স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলে তিনি বললেনঃ ঐ বাগানটি হল ইসলাম। ঐ স্তম্ভটা হল ইসলামের মূল স্তম্ভ। আর ঐ রশিটা হল ইসলামের সুদৃঢ় রশি। কাজেই মৃত্যু পর্যন্ত তুমি ইসলামের উপরই থাকবে।

[13] - কালেমার অর্থ ও তাৎপর্য না জেনে কেউ যদি তা পাঠ করে, তাহলে এই কালেমা তার উপকারে আসবে কিনা- এ বিষয়টি মতভেদপূর্ণ। তবে অনেক দলীল প্রমাণ করে যে, অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবে। এ বিষয়ে যথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা আসবে ইনশা-আল্লাহ।

[14] - ইবনে হিববান ও হাকিম। ইমাম আলবানী (রঃ) হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। দেখুনঃ সহীহুত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব, হাদীছ নং- ৯২৩। তবে এই কালেমার শক্তি আসমান-যমীন অপেক্ষা বেশী’’। একাধিক বিশুদ্ধ হাদীছ রয়েছে।

[15] - বাংলা ভাষায় অধিকাংশ ইসলামী বই-পুস্তকগুলোতে ‘আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই’,-এভাবেই لا إله إلا الله-এর অনুবাদ করা হয়েছে। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর অনুবাদ এভাবে করা ঠিক নয়। কারণ বাক্যটির আসল রূপ হচ্ছে لا إله حق إلا الله। যদি অনুবাদ করা হয় যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তাহলে حق(হক) শব্দটির অনুবাদ ছুটে যায়। আর আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই- এ কথাটিও অবাস্তব। কারণ আমরা এই পৃথিবীতে অসংখ্য মাবুদ দেখতে পাচ্ছি। মূলতঃ যার এবাদত ও উপাসনা করা হয়, তাই মাবুদ। সে হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায় যে সমস্ত দেব-দেবীর পূজা ও উপাসনা করে, সেগুলো তাদের মাবুদ। মক্কার মুশরিকরা যে সমস্ত মূর্তির উপাসনা করত, সেগুলো ছিল তাদের মাবুদ। যে সমস্ত মুসলিম কবরে সিজদাহ্ করছে, অলী-আওলীয়া ও কবরবাসীর কাছে সাহায্য চাচ্ছে, তারাও এগুলোকে মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে। সুতরাং পৃথিবীতে বহু মাবুদ আছে এবং মানুষ সেগুলোর পূজা করছে। তবে এগুলো সত্য ও সঠিক মাবুদ নয়। এ কথাটিই ব্যক্ত হয়েছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর মধ্যে। সুতরাং لا إله إلا الله -এর সঠিক অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্ ছাড়া সত্য-সঠিক কোন উপাস্য নেই। (অনুবাদক)

[16] - ইমাম মালেক (রঃ) মুআত্তায় তালহা বিন উবাইদুল্লাহ (রাঃ) হতে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আলবানী (রঃ) বলেনঃ সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে, হাদীছটির শাওয়াহেদ থাকার কারণে তথা অন্যান্য সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে সহীহ। দেখুনঃ সিলসিলা সহীহা, হাদীছ নং- ১৫০৩।

[17] - তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ। ইমাম তিরমিজী হাদীছটি বর্ণনা করার পর সহীহ বলেছেন। ইমাম আলবানী (রঃ)ও হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ১৩৫।

হাদীছে বর্ণিত আল্লাহর রহমত কেবল তার বেলায় প্রযোজ্য হবে যার প্রতি আল্লাহ বিশেষ অনুগ্রহ করবেন। এটা একান্তই আল্লাহর অনুগ্রহ। কাজেই উল্লেখিত রহমতের আশায় এবাদত-বন্দেগী না করে বসে থাকা মোটেই উচিত নয়।

[18] - এখানে মৃত্যু বলতে নিদ্রা উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আমি তোমাকে নিদ্রার মাধ্যমে উপরে উঠিয়ে নিবো। কেননা ঈসা (আঃ) মৃত্যু বরণ করেন নি। কিয়ামতের আগে তিনি পুনরায় দুনিয়াতে আগমণ করবেন।

[19] - কালেমার শর্তসমূহঃ

(১) ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভাবে অর্থ জানা, যা অজ্ঞতার পরিপন্থী। নেতিবাচক হলো আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য এবাদাত সাব্যস্ত না করা। আর ইতিবাচক হলো তা (এবাদাত) এককভাবে তাঁর জন্য সাব্যস্ত করা। তাঁর কোন অংশীদার নেই তিনিই একমাত্র এবাদাতের মালিক ও হক্বদার।

(২) এই কালেমার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখা, যা সন্দেহের পরিপন্থী। অর্থাৎ এই কালেমার দাবীর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রেখে আন্তরিকভাবে নিশ্চিত হয়ে মুখে উচ্চারণ করা।

(৩) এই কালেমাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করা, যা প্রত্যাখ্যাণের পরিপন্থী। আর তা হলো এই কালেমার সকল দাবী-চাহিদা ও তার বক্তব্য গ্রহণ করা। সংবাদ সমূহের প্রতি বিশ্বাস রাখা, আদেশ সমূহ পালন করা। নিষেধ সমূহ হতে বিরত থাকা। কুরআন ও হাদীসের দলীল পরিত্যাগ ও অপব্যাখ্যা না করা।

(৪) অনুগত হওয়া, যা অগ্রায্য করার পরিপন্থী। আর তা হলো এই কালেমা যে সকল বিধানের নির্দেশ দিয়েছে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ভাবে তার প্রতি অনুগত থাকা।

(৫) এই কালেমাকে সত্য জানা, যা মিথ্যার পরিপন্থী। আর তা হলো বান্দা এই কালেমাকে সত্য জেনে অন্তর হতে উচ্চারণ করবে। এই কালেমা পাঠকারীর অন্তর তার কথা মোতাবেক হবে এবং তার বাহ্যিক অবস্থা অভ্যন্তরীণ অবস্থার অনুরূপ হবে। অতঃপর যে ব্যক্তি এই কালেমা মুখে উচ্চারণ করেছে আর তার দাবীকে অস্বীকার করেছে নিশ্চয়ই তার এই উচ্চারণ কোন কাজে আসবেনা, যেমন মুনাফেকদের অবস্থা ছিল। তারা এই কালেমা মুখে উচ্চারণ করতো অন্তরে অস্বীকার করত।

(৬) পূর্ণ একনিষ্ঠতা থাকা, যা শির্কের পরিপন্থী। আর তা হল বান্দা আমলকে নেক নিয়তের দ্বারা শির্কের সকল প্রকার প্রাদুর্ভাব হতে মুক্ত রাখবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَতারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে এবাদাত করার। (সূরা আল-বায়্যিনাঃ ৫)

(৭) এই কালেমার সাথে ভালবাসা রাখা, যা ঘৃণা ও অপছন্দের পরিপন্থী। আর ইহা বাস্তবায়িত হবে কালেমাকে, তার দাবীকে, তার নির্দেশিত বিধানকে এবং যারা এই কালেমার শর্ত মোতাবেক চলে তাদেরকে ভালবাসার মাধ্যমে। আর উল্লেখিত কথাগুলোর বিপরীত কথার সাথে বিদ্বেষ রাখার মাধ্যমে। এর নিদর্শন হলঃ আল্লাহর প্রিয় বস্ত্তকে প্রাধান্য দেয়া, যদিও তা প্রবৃত্তির বিরোধী হয়। আর আল্লাহর যা অপছন্দ তা অপছন্দ করা, যদিও প্রবৃত্তি তার দিকে ধাবিত হয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যাদের বন্ধুত্ব রয়েছে তাঁদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যাদের শত্রুতা রয়েছে তাদের সাথে শত্রুতা রাখা। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

فَقَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ

‘‘তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ, তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার এবাদাত কর তার সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নাই। আমরা তোমাদেরকে মানি না। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে শুরু হল শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য, যতক্ষন না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন কর। (সূরা মুমতাহিনাঃ ৪) তিনি আরও বলেনঃ

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ

‘‘মানুষের মধ্যে এমন লোক রয়েছে, যে আল্লাহ ছাড়া অপরকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভাল বাসার ন্যায় তাদেরকে ভালবাসে, কিন্তু যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালবাসা দৃঢ়তর’’। (সূরা বাকারাঃ ১৬৫) আর যে ব্যক্তি ইখলাস ও ইয়াকীনের সাথে (لا إله إلا الله) লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ‘‘আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মাবুদ নেই’’ এ কথা বলবে এবং সকল পাপাচার, বিদআত, ছোট শির্ক ও বড় শির্ক হতে মুক্ত থাকবে, সে দুনিয়াতে পথভ্রষ্ঠতা হতে হেদায়াত পাবে। আর আখেরাতে শাস্তি হতে নিরাপত্তা পাবে। তার উপর জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবে। এই শর্তগুলো পূর্ণ করা বান্দার উপর আবশ্যক। আর এই শর্তগুলো পূর্ণ করার অর্থ হল যে, এই শর্তগুলো একজন বান্দার জীবনে সমাবেশ ঘটা এবং তা জানা অত্যাবশ্যক হওয়া। তবে ইহা মুখস্থ করা জরুরী নয়। আর এই মহান কালেমা (لا إله إلا الله) হল তাওহীদুল উলুহীয়্যাহ, যা তাওহীদের প্রকারসমূহের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক প্রকার তাওহীদ, এ বিষয়েই নাবীগণ ও তাঁদের সম্প্রদায়ের মাঝে মতানৈক্য সংঘটিত হয়েছিল। আর এরই বাস্তবায়নের জন্যে রাসূলগণকে প্রেরণ করা হয়েছিল।

[20] - তিরমিজী। ইমাম আলবানী হাদীছটিকে দুর্বল বলেছেন। দেখুনঃ শাইখের তাহকীকসহ মিশকাত, হাদীছ নং- ৫২৮৯।

[21] - তিরমিজী, অধ্যায়ঃ গুনাহ্ করার পর বান্দার জন্য আল্লাহর ক্ষমা। ইমাম আলবানী (রঃ) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ১২৭।

[22] - যে ব্যক্তি লা-ইলাহা পাঠ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে,- অনেক লোকই এই হাদীছটি বুঝতে ভুল করেছে। তারা মনে করে শুধু জবান দিয়ে এই বাক্যটি উচ্চারণ করাই জান্নাতে যাওয়ার জন্য এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ। মূলতঃ বিষয়টি এরূপ নয়। যারা এরূপ মনে করে, তারা বিভ্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত। তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর সঠিক মর্মার্থ বুঝতে পারে নি। না বুঝার কারণ হল, তারা এ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেনি। এই পবিত্র বাক্যটির সঠিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ্ ব্যতীত সকল মাবুদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং সকল প্রকার এবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই খাস (নির্ধারণ) করা। এবাদতগুলো এমন পদ্ধতিতে করা, যাতে আল্লাহ্ সন্তুষ্ট হন। এটিই লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর হক। যে ব্যক্তি এই হক আদায় করবেনা, কিংবা এর কিছু অংশ আদায় করবে, অতঃপর আল্লাহর সাথে অন্যান্য অলী-আওলীয়া ও সৎ লোকদের কাছে দুআ করবে এবং তাদের জন্য নযর পেশ করবে, সে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’এর শর্ত ভঙ্গকারী হিসাবে গণ্য হবে। সে এটি পাঠ করার দাবী করলেও তাতে কোন লাভ হবে না।