বড় শির্ক ও ছোট শির্ক বড় শির্কের প্রকারভেদ মোস্তাফিজুর রহমান বিন আব্দুল আজিজ আল-মাদানী ১ টি

ভয়ের শির্ক বলতে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ব্যতিরেকে কেউ কারোর পক্ষে অপ্রকাশ্যভাবে দুনিয়া বা আখিরাত সংক্রান্ত যে কোন ক্ষতি সংঘটন করতে পারে বলে অন্ধ বিশ্বাস করে তাকে ভয় পাওয়াকে বুঝানো হয়।

এ ধরণের ভয় একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্যই হতে হবে। অন্য কারোর জন্য নয়।

ভয় বলতে কোন খারাপ আলামত পরিলক্ষণ করে অপ্রীতিকর কোন কিছুর আশঙ্কা করাকে বুঝানো হয়। ভয় সাধারণত তিন প্রকার:

ক. অদৃশ্যের ভয়:

অদৃশ্যের ভয় বলতে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া কোন মূর্তি, মৃত ব্যক্তি বা অদেখা কোন জিন বা মানবের অনিষ্টতা থেকে ভয় পাওয়াকে বুঝানো হয়।

এ জাতীয় ভয় গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত যা অন্য কারোর জন্য ব্যয় করা জঘন্যতম শির্ক।

ইব্রাহীম (আ.) এর উম্মতরা তাঁকে সে যুগের মূর্তির ভয় দেখিয়েছিলো। কিন্তু তিনি ভয়ের সে অমূলক সম্ভাবনার কথা দৃঢ়ভাবে উড়িয়ে দেন।

আল্লাহ্ তা’আলা সে কথাই কোর’আন মাজীদে সুন্দরভাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন:

«وَلآ أَخَافُ مَا تُشْرِكُوْنَ بِهِ إِلاَّ أَنْ يَّشَآءَ رَبِّيْ شَيْئًا، وَسِعَ رَبِّيْ كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا، أَفَلاَ تَتَذَكَّرُوْنَ، وَكَيْفَ أَخَافُ مَآ أَشْرَكْتُمْ وَلاَ تَخَافُوْنَ أَنَّكُمْ أَشْرَكْتُمْ بِاللهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا، فَأَيُّ الْفَرِيْقَيْنِ أَحَقُّ بِالأَمْنِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ»

‘‘তোমাদের মূর্তিদেরকে আমি ভয় করিনা। তবে আমার প্রভু যাই চান তাই ঘটবে। প্রতিটি বস্ত্ত সম্পর্কে আমার প্রভু সম্যক জ্ঞান রাখেন। এর পরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবেনা? আর আমি তোমাদের মূর্তিদেরকে ভয় করবোই বা কেন? অথচ তোমরা আল্লাহ্ তা’আলার সাথে কাউকে শরীক করতে ভয় পাওনা। যদিও আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে তোমাদের নিকট কোন প্রমাণ নেই। আমাদের মধ্যে কে কতটুকু নিরাপত্তার অধিক উপযোগী জানা থাকলে অতিসত্বর তোমরা বলো’’। (আন্’আম : ৮০-৮১)

হূদ (আ.) এর উম্মতরাও তাঁকে সে যুগের মূর্তিদের ভয় দেখিয়েছিলো। তারা বলেছিলো:

«إِنْ نَقُوْلُ إِلاَّ اعْتَرَاكَ بَعْضُ آلِهَتِنَا بِسُوْءٍ، قَالَ إِنِّيْ أُشْهِدُ اللهَ وَاشْهَدُوْا أَنِّيْ بَرِيْءٌ مِّمَّا تُشْرِكُوْنَ، مِنْ دُوْنِهِ فَكِيْدُوْنِيْ جَمِيْعًا ثُمَّ لاَ تُنْظِرُوْنِ»

‘‘আমাদের ধারণা, আমাদের কোন দেবতা তোমার ক্ষতি করেছে। হূদ (আ.) বললেন: আমি আল্লাহ্ তা’আলাকে সাক্ষী রেখে বলছি এবং তোমরাও সাক্ষী থাকো যে, আমি তোমাদের দেবতা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অনন্তর তোমরা সবাই সদলবলে আমার বিরুদ্ধে ষঢ়যন্ত্র চালিয়ে যাও। আমাকে এতটুকুও অবকাশ দিও না’’। (হূদ : ৫৪-৫৫)

মক্কার কাফিররাও রাসূল (সা.) কে নিজ দেবতাদের ভয় দেখিয়েছিলো।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

«وَيُخَوِّفُوْنَكَ بِالَّذِيْنَ مِنْ دُوْنِهِ»

‘‘তারা আপনাকে আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্যদের ভয় দেখায়’’। (যুমার : ৩৬)

বর্তমান যুগের কবর পূজারীরাও তাওহীদ পন্থীদেরকে এ জাতীয় ভয় দেখিয়ে থাকে। যখন তাদেরকে কবর পূজা ছেড়ে এক আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করতে বলা হয় তখন তারা বলে: কবরে শায়িত বুযুর্গের সাথে বেয়াদবি করোনা। অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে। তাদের অনেকেরই অবস্থা এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আল্লাহ্ তা’আলার নামে মিথ্যা কসম খেতে সত্যিই তারা কোন দ্বিধাবোধ করেনা। অথচ জীবিত বা মৃত পীরের নামে মিথ্যা কসম খেতে তারা প্রচুর দ্বিধাবোধ করে। তাদের মধ্যকার কেউ অন্যের উপর যুলুম করে আল্লাহ্ তা’আলার নামে আশ্রয় চাইলে তাকে কোন আশ্রয় দেয়া হয় না। কিন্তু কোন পীর বা কবরের নামে আশ্রয় চাওয়া হলে তার প্রতি কটু দৃষ্টিতেও কেউ তাকাতে সাহস পায়না। অথচ এ জাতীয় ভয় একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাকেই করতে হবে। অন্য কাউকে নয়।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

«أَتَخْشَوْنَهُمْ فَاللهُ أَحَقُّ أَنْ تَخْشَوْهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ»

‘‘তোমরা কি ওদেরকে ভয় পাচ্ছো? অথচ তোমাদের উচিৎ একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাকেই ভয় পাওয়া যদি তোমরা সত্যিকার ঈমানদার হয়ে থাকো’’। (তাওবাহ্ : ১৩)

আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:

«إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَآءَهُ، فَلاَ تَخَافُوْهُمْ وَخَافُوْنِ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ»

‘‘নিশ্চয়ই এ শয়তান ; যে নিয়ত তোমাদেরকে নিজ বন্ধুদের ভয় দেখিয়ে থাকে। তোমরা ওদেরকে ভয় করোনা। শুধু আমাকেই ভয় করো যদি তোমরা ঈমানের দাবিদার হয়ে থাকো’’। (আলে-ইমরান : ১৭৫)

তিনি আরো বলেন:

«فَلاَ تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ»

‘‘তাদেরকে ভয় করোনা। শুধু আমাকেই ভয় করো’’। (মায়িদাহ্ : ৩)

তিনি আরো বলেন:

«وَإِيَّايَ فَارْهَبُوْنِ»

‘‘তোমরা শুধু আমাকেই ভয় করো। অন্যকে নয়’’। (বাক্বারাহ্ : ৪০)

আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর মসজিদ আবাদকারীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:

«إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللهِ مَنْ آمَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلاَةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلاَّ اللهَ، فَعَسَى أُوْلآئِكَ أَنْ يَّكُوْنُوْا مِنَ الْـمُهْتَدِيْنَ»

‘‘মসজিদগুলো আবাদ করবে শুধু ওরাই যারা আল্লাহ্ তা’আলা ও পরকালের প্রতি সত্যিকার ঈমান এনেছে এবং নিয়মিত নামায প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত দেয়। উপরন্তু তারা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া অন্য কাউকে ভয় পায়না ; বস্ত্ততঃ এদের ব্যাপারেই হিদায়াত প্রাপ্তির আশা করা যায়’’। (তাওবাহ্ : ১৮)

একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাকেই ভয় পাওয়া সর্ব যুগের নবী-রাসূলগণের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

«وَيَخْشَوْنَهُ وَلاَ يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلاَّ اللهَ»

‘‘তারা আল্লাহ্ তা’আলাকেই ভয় করতো। অন্য কাউকে নয়’’। (আহযাব : ৩৯)

এ জাতীয় ভয় ধার্মিকতার মেরুদন্ড। যা অন্যের জন্য ব্যয় করা বড় শির্ক।

খ. কোন মানুষের ভয়:

মানুষের ভয় বলতে কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির ভয়ে যে কোন ওয়াজিব কাজ ছেড়ে দেয়াকে বুঝানো হয়। যেমন: কাউকে সৎ কাজের আদেশ অথবা অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতে গিয়ে অথবা আল্লাহ্ তা’আলার পথে জিহাদ করতে গিয়ে মানুষকে ভয় পাওয়া। এ জাতীয় ভয় শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম ও ছোট শির্ক।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

«الَّذِيْنَ قَالَ لَـهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوْا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيْمَانًا وَقَالُوْا حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيْلُ، فَانْقَلَبُوْا بِنِعْمَةٍ مِّنَ اللهِ وَفَضْلٍ لَمْ يَمْسَسْهُمْ سُوْءٌ وَاتَّبَعُوْا رِضْوَانَ اللهِ وَاللهُ ذُوْ فَضْلٍ عَظِيْمٍ، إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلاَ تَخَافُوْهُمْ وَخَافُوْنِ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِيْنَ»

‘‘এরা ওরা যাদেরকে অন্যরা এ বলে ভয় দেখিয়েছে যে, সত্যিই শত্রুরা তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়েছে। অতএব তোমরা তাদেরকে ভয় করো। এতে ওদের ঈমান আরো বেড়ে যায়। বরং তারা বলে: আল্লাহ্ তা’আলাই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই আমাদের শ্রেষ্ঠ দায়িত্বশীল। অতঃপর তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আল্লাহ্ তা’আলার নিয়ামত ও অনুগ্রহ নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে অথচ তাদের কোন ক্ষতি হয়নি। আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টিই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো। তিনি বড়ই অনুগ্রহশীল। নিশ্চয়ই এ শয়তান। যে নিয়মিত তোমাদেরকে ওর অনুগতদের ভয় দেখিয়ে থাকে। অতএব তোমরা ওদেরকে ভয় করোনা। শুধু আমাকেই ভয় করো যদি তোমরা ঈমানের দাবিদার হও’’। (আল-ইমরান : ১৭৩-১৭৫)

উক্ত ভয় সম্পর্কে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:

أَلاَ لاَ يَمْنَعَنَّ رَجُلًا هَيْبَةُ النَّاسِ أَنْ يَّقُوْلَ بِحَقٍّ إِذَا عَلِمَهُ

‘‘সাবধান! মানুষের ভয় যেন তোমাদের কাউকে কোথাও সত্য কথা বলা থেকে বিরত না রাখে’’। (ইবনু মাজাহ, হাদীস ৪০৭৯)

রাসূল (সা.) আরো বলেন:

إِنَّ اللهَ لَيَسْأَلُ الْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يَقُوْلَ: مَا مَنَعَكَ إِذْ رَأَيْتَ الْـمُنْكَرَ أَنْ تُنْكِرَهُ؟ فَإِذَا لَقَّنَ اللهُ عَبْدًا حُجَّتَهُ، قَالَ: يَا رَبِّ! رَجَوْتُكَ وَفَرِقْتُ مِنَ النَّاسِ

‘‘আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামতের দিন বান্দাহকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করবেন: যখন তুমি তোমার সামনে কাউকে অপকর্ম করতে দেখলে তখন তুমি তাকে বাধা দিলে না কেন? অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা বান্দাহ্কে তার কৈফিয়ত শিখিয়ে দিলে সে বলবে: হে আমার প্রভু! আমি তো আপনার রহমতের আশা করেছিলাম ঠিকই তবে অপকর্ম প্রতিরোধের ব্যাপারে মানুষকে ভয় পেয়েছিলাম’’।

(ইব্নু মাজাহ্, হাদীস ৪০৮৯ ইবনু হিব্বান, হাদীস ১৮৪৫)

গ. আল্লাহ্ তা’আলার আযাবের ভয়:

মু’মিন বলতেই তাকে অবশ্যই আল্লাহ্ তা’আলার কঠিন আযাবের ভয় পেতে হবে। এ জাতীয় ভয় কারোর মধ্যে না থাকলে কখনোই তার পক্ষে কোন গুনাহ্’র কাজ থেকে বাঁচা সম্ভবপর নয়। এ জাতীয় ভয় ইহ্সানের অন্তর্ভুক্ত।

কোর’আন ও হাদীস এ জাতীয় ভয় প্রদর্শনে পরিপূর্ণ। তবে শুধু ভয় প্রদর্শনই নয় বরং পাশাপাশি এর উপকারিতাও বর্ণনা করা হয়েছে।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

«ذَلِكَ لِمَنْ خَافَ مَقَامِيْ وَخَافَ وَعِيْدِ»

‘‘আল্লাহ্ তা’আলার জমিনে অধিষ্ঠিত হওয়ার একমাত্র অধিকার ওদের যারা কিয়ামতের দিন আমার সামনে উপস্থিতির ভয় পায় এবং আমার কঠিন শাস্তিরও’’। (ইব্রাহীম : ১৪)

তিনি আরো বলেন:

«وَلِـمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ»

‘‘যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা’আলার সামনে উপস্থিতির ভয় পায় তার জন্যই রয়েছে দু’টি জান্নাত’’। (রাহ্মান : ৪৬)

তিনি আরো বলেন:

«قَالُوْا إِنَّا كُنَّا قَبْلُ فِيْ أَهْلِنَا مُشْفِقِيْنَ»

‘‘জান্নাতীরা তখন বলবে: আমরা ইতিপূর্বে দুনিয়াতেও পরিবার-পরিজনের সাথে থাকাবস্থায় আল্লাহ্ তা’আলার ভয়ে শংকিত ছিলাম। (ত্বূর : ২৬)

আল্লাহ্ তা’আলা তার নেককার বান্দাহ্দের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:

«يُوْفُوْنَ بِالنَّذْرِ وَيَخَافُوْنَ يَوْمًا كَانَ شَرُّهُ مُسْتَطِيْرًا»

‘‘তারা মানত পুরো করে এবং সে দিনকে (কিয়ামতের দিন) ভয় পায় যে দিনের ভয়াবহতা হবে খুবই ব্যাপক’’। (দাহর : ৭)

একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ভয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিরাই সাধারণত দ্রুত কল্যাণমুখী হয়ে থাকে। অন্যরা নয়। আর শুধুমাত্র গুনাহ্’র কারণেই যে আল্লাহ্ তা’আলার আযাবকে ভয় করতে হবে তাও কিন্তু সর্বশেষ কথা নয়। বরং সত্যিকার মুসলমানের কাজ হলো, প্রচুর নেক আমল করেও তা আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে কবুল ও মকবুল না হওয়ার আশঙ্কা করা।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

«إِنَّ الَّذِيْنَ هُمْ مِنْ خَشْيَةِ رَبِّهِمْ مُشْفِقُوْنَ، وَالَّذِيْنَ هُمْ بِآيَاتِ رَبِّهِمْ يُؤْمِنُوْنَ، وَالَّذِيْنَ هُمْ بِرَبِّهِمْ لاَ يُشْرِكُوْنَ، وَالَّذِيْنَ يُؤْتُوْنَ مَآ آتَوْا وَقُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلَى رَبِّهِمْ رَاجِعُوْنَ، أُوْلآئِكَ يُسَارِعُوْنَ فِيْ الْـخَيْرَاتِ وَهُمْ لَـهَا سَابِقُوْنَ»

‘‘নিঃসন্দেহে যারা নিজ প্রভুর ভয়ে সন্ত্রস্ত, যারা নিজ প্রভুর নিদর্শনাবলীতে বিশ্বাসী, যারা নিজ প্রভুর সাথে কাউকে শরীক করেনা এবং যারা নিজ প্রভুর নিকট প্রত্যাবর্তন করবে বলে যা দান করার তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে শুধু তারাই কেবল দ্রুত সম্পাদন করে থাকে পুণ্যকর্মসমূহ এবং তারাই উহার প্রতি সত্যিকার অগ্রগামী’’। (মু’মিনূন : ৫৭-৬১)

’আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) বলেন:

سَأَلْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَنْ هَذِهِ الآيَةِ:

«وَالَّذِيْنَ يُؤْتُوْنَ مَآ آتَوْا وَقُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ»

قَالَتْ عَائِشَةُ: أَهُمُ الَّذِيْنَ يَشْرَبُوْنَ الْـخَمْرَ وَيَسْرِقُوْنَ؟ قَالَ: لاَ يَا بِنْتَ الصِّدِّيْقِ! وَلَكِنَّهُمْ الَّذِيْنَ يَصُوْمُوْنَ، وَيُصَلُّوْنَ، وَيَتَصَدَّقُوْنَ ؛ وَهُمْ يَخَافُوْنَ أَنْ لاَ يُقْبَلَ مِنْهُمْ

‘‘আমি রাসূল (সা.) কে উক্ত আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, এরা কি মদ্যপায়ী চোর তস্কর? নতুবা তারা আল্লাহ্ তা’আলার রাস্তায় দান করেও ভয় পাবে কেন? তিনি বললেন: না, এমন নয় হে সিদ্দীকের মেয়ে! বরং এরা রোযা রাখে, নামায পড়ে এবং সাদাকা করে। এর পরও তা আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে কবুল হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে শঙ্কিত’’। (তিরমিযী, হাদীস ৩১৭৫)

ঘ. স্বাভাবিক ভয়:

স্বাভাবিক ভয় বলতে সহজাত ভয়কে বুঝানো হয়। যেমন: শত্রু, সিংহ ইত্যাদি দেখে ভয় পাওয়া। এ ভীতি দোষনীয় নয়।

আল্লাহ্ তা’আলা মূসা (আ.) সম্পর্কে বলেন:

«فَخَرَجَ مِنْهَا خَائِفًا يَّتَرَقَّبُ»

‘‘ভীত সতর্কাবস্থায় সে (মূসা (আ.)) মিসর থেকে বেরিয়ে পড়লো’’। (ক্বাসাস : ২১)

তবে আল্লাহ্ভীতি হতে হবে আশা ও ভালোবাসা মিশ্রিত। যাতে অতি ভয় কাউকে আল্লাহ্ তা’আলার রহমত থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ এবং অতি আশা কাউকে আল্লাহ্ তা’আলার পাকড়াও থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ ভাবতে উৎসাহিত না করে।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

«وَمَنْ يَّقْنَطُ مِنْ رَّحْمَةِ رَبِّهِ إِلاَّ الضَّالُّوْنَ»

‘‘একমাত্র পথভ্রষ্টরাই নিজ প্রভুর করুণা থেকে নিরাশ হয়ে থাকে’’। (হিজর : ৫৬)

তিনি আরো বলেন:

«وَلاَ تَيْأَسُوْا مِنْ رَّوْحِ اللهِ، إِنَّهُ لاَ يَيْأَسُ مِنْ رَوْحِ اللهِ إِلاَّ الْقَوْمُ الْكَافِرُوْنَ»

‘‘তোমরা আল্লাহ্ তা’আলার করুণা থেকে কখনোই নিরাশ হয়ো না। কারণ, একমাত্র কাফিররাই আল্লাহ্ তা’আলার করুণা থেকে নিরাশ হয়ে থাকে’’। (ইউসুফ : ৮৭)

তিনি আরো বলেন:

«أَفَأَمِنُوْا مَكْرَ اللهِ فَلاَ يَأْمَنُ مَكْرَ اللهِ إِلاَّ الْقَوْمُ الْـخَاسِرُوْنَ»

‘‘তারা কি নিজেদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার সূক্ষ্ম পাকড়াও থেকে নিরাপদ মনে করে? বস্ত্ততঃ একমাত্র ক্ষতিগ্রস্তরাই আল্লাহ্ তা’আলার পাকড়াও থেকে নিঃশঙ্ক হতে পারে’’। (আ’রাফ : ৯৯)

ইসমাঈল বিন রাফি’ (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন:

مِنَ الأَمْنِ مِنْ مَكْرِ اللهِ إِقَامَةُ الْعَبْدِ عَلَى الذَّنْبِ يَتَمَنَّى عَلَى اللهِ الْـمَغْفِرَةَ

‘‘আল্লাহ্ তা’আলার সূক্ষ্ম পাকড়াও থেকে নির্ভয় হওয়ার মানে এও যে, বান্দাহ্ গুনাহ্ করতে থাকবে এবং আল্লাহ্ তা’আলার নিকট ক্ষমার আশা করবে’’। (আল্ ইরশাদ্ : ৮০)

হাসান (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন:

مَنْ وُسِّعَ عَلَيْهِ فَلَمْ يَرَ أَنَّهُ يُمْكَرُ بِهِ فَلاَ رَأْيَ لَهُ، وَمَنْ قُتِرَ عَلَيْهِ فَلَمْ يَرَ أَنَّهُ يُنْظَرُ لَهُ فَلاَ رَأْيَ لَهُ

‘‘যাকে আল্লাহ্ তা’আলা অঢেল সম্পদ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছেন অতঃপর সে বুঝতে পারেনি যে, তা দিয়ে তাকে সূক্ষ্ম পরীক্ষার সম্মুখীন করা হচ্ছে তাহলে বাস্তবার্থে সে চরম বোকা। আর যাকে আল্লাহ্ তা’আলা আর্থিক সংকটে ফেলেছেন অতঃপর সে বুঝতে পারেনি যে, সকল ধরনের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য পরবর্তী সময়ের প্রয়োজনের তাগিদে তারই জন্য এবং তারই কল্যাণে সংরক্ষণ করা হচ্ছে তাহলে সেও চরম বোকা’’। (তাইসীরুল্ আযীযিল্ হামীদ : ৪২৬)

আশা ও ভয়ের সংমিশ্রণকেই ঈমান বলা হয়। নবী ও রাসূলদের ঈমান এ পর্যায়েরই ছিল। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

«إِنَّهُمْ كَانُوْا يُسَارِعُوْنَ فِيْ الْـخَيْرَاتِ وَيَدْعُوْنَنَا رَغَبًا وَّرَهَبًا وَكَانُوْا لَنَا خَاشِعِيْنَ»

‘‘তারা (নবী ও রাসূলরা) সৎকর্মে দৌড়ে আসতো এবং আমাকে ডাকতো আশা ও ভয়ের মাঝে। তেমনিভাবে তারা ছিলো আমার নিকট সুবিনীত’’। (আম্বিয়া : ৯০)

তিনি আরো বলেন:

«أُوْلآئِكَ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ يَبْتَغُوْنَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيْلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُوْنَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُوْنَ عَذَابَهُ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُوْرًا»

‘‘তারা যাদেরকে ডাকে তারাই তো নিজ প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় অনুসন্ধান করে বেড়ায়। এ প্রতিযোগিতায় যে, কে কতটুকু আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য লাভ করতে পারে এবং তারা আল্লাহ্ তা’আলার দয়া কামনা করে ও তাঁর শাস্তিকে ভয় পায়। আপনার প্রতিপালকের শাস্তি সত্যিই ভয়াবহ’’। (ইস্রা/বানী ইস্রাঈল : ৫৭)

আশা ও ভয়ের সংমিশ্রণ সত্যিকারার্থে যে কোন আল্লাহ্’র বান্দাহ্কে পুণ্য কর্ম সম্পাদন, গুনাহ্ থেকে পরিত্রাণ ও তাওবা করণে বিপুল সহায়তা করে থাকে। কারণ, যে কোন পুণ্য কর্ম সম্পাদন একমাত্র সাওয়াবের আশায় এবং যে কোন পাপ থেকে পরিত্রাণ একমাত্র শাস্তির ভয়েই সম্ভব। শুধু ভয় বা নৈরাশ্য মানুষকে নেক কাজ থেকে নিরুৎসাহী এবং শুধু নির্ভয়তা বা নিরাপত্তাবোধ মানুষকে গুনাহ্ করতে সুদূর অনুপ্রাণিত করে।

উক্ত দৃষ্টিকোণ থেকেই আলিমরা বলে থাকেন:

مَنْ عَبَدَ اللهَ بِالْـحُبِّ وَحْدَهُ فَهُوَ صُوْفِيٌّ، وَمَنْ عَبَدَهُ بِالْـخَوْفِ وَحْدَهُ فَهُوَ حَـرُوْرِيٌّ، وَمَنْ عَبَدَهُ بِالرَّجَاءِ وَحْدَهُ فَهُوَ مُرْجِئٌ، وَمَنْ عَبَدَهُ بِالْـحُبِّ وَالْـخَوْفِ وَالرَّجَاءِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ

‘‘যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহ্ তা’আলার ভালোবাসায় তাঁর ইবাদাত করে সে সূফী। যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহ্ তা’আলার ভয়ে তাঁর ইবাদাত করে সে হারুরী বা খারিজী। যে ব্যক্তি নিরেট আশায় আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করে সে মুরজি। আর যে ব্যক্তি আশা, ভয় ও ভালোবাসার সংমিশ্রণে আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করে সেই সত্যিকার মু’মিন’’। (আল্ ইরশাদ্ : ৮০)

আল্লাহ্ তা’আলাকে ভয় পাওয়ার উপায়:

তিনটি জিনিসের মাধ্যমে মানুষের অন্তরে আল্লাহ্ তা’আলার সত্যিকার ভয় সৃষ্টি হয়ে থাকে। সে জিনিসগুলো নিম্নরূপ:

১. পাপ ও পাপের অপকার সম্পর্কে অবগত হওয়া।

২. পাপের শাস্তি অনিবার্য বলে বিশ্বাস করা।

৩. পাপের পর তাওবা করা সম্ভবপর নাও হতে পারে তা বিশ্বাস করা।

কারোর মধ্যে এ তিনটি বস্ত্তর সম্মিলন ঘটলে সে কোন গুনাহ্’র আগপর একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলাকেই ভয় করতে শিখবে।

মানুষ যতই গুনাহ্ করুক না কেন তবুও সে কখনো আল্লাহ্ তা’আলার রহমত হতে নিরাশ হতে পারে না।

আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:

«قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِيْنَ أَسْرَفُوْا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لاَ تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللهِ، إِنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعًا، إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ، وَأَنِيْبُوْا إِلَى رَبِّكُمْ وَأَسْلِمُوْا لَهُ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَّأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ ثُمَّ لاَ تُنْصَرُوْنَ»

‘‘আপনি আমার বান্দাহ্দেরকে এ বাণী পৌঁছিয়ে দিন যে, হে আমার বান্দাহ্রা! তোমরা যারা গুনাহ্’র মাধ্যমে নিজেদের প্রতি অধিক অত্যাচার- অবিচার করেছো আল্লাহ্ তা’আলার অনুগ্রহ থেকে কখনো নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দিবেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। তোমরা নিজ প্রতিপালক অভিমুখী হও এবং তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করো শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার বহু পূর্বে। জেনে রাখো, এরপর কিন্তু তোমাদেরকে আর সাহায্য করা হবে না’’। (যুমার : ৫৩-৫৪)

আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্ঊদ (রা.) বলেন:

أَكْبَرُ الْكَبَائِرِ: الإِشْرَاكُ بِاللهِ وَالأَمْنُ مِنْ مَكْرِ اللهِ وَالْقُنُوْطُ مِنْ رَّحْمَةِ اللهِ وَالْيَأْسُ مِنْ رَّوْحِ اللهِ

‘‘সর্ববৃহৎ পাপ হচ্ছে, আল্লাহ্ তা’আলার সাথে কাউকে শরীক করা, তাঁর শাস্তি থেকে নিজকে নিরাপদ ভাবা এবং তাঁর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া’’। (’আব্দুর রায্যাক, হাদীস ১৯৭০১)

তবে সঠিক নিয়ম হচ্ছে, সুস্থতার সময় আল্লাহ্ তা’আলাকে ভয় পাওয়া এবং অসুস্থতা বা মৃত্যুর সময় আল্লাহ্ তা’আলার রহমতের আশা করা।