৪. ৫. যীশু আল্লাহর বান্দা পুত্র? না ঈশ্বরত্বে আল্লাহর সমকক্ষ পুত্র?

আল্লাহকে পিতা বলা এবং বান্দাকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর পুত্র’ বলা হিব্রু ভাষার রীতি। পিতা অর্থ জগৎপিতা বা প্রতিপালক। আর ‘ইবন’ বা পুত্র (son) অর্থ বান্দা। এজন্য কিতাবুল মোকাদ্দসে সকল আদম-সন্তানকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা “আল্লাহর পুত্র” বলা হয়েছে। (আদিপুস্তক ৬/২-৪; ইয়োব ৩৮/৭; গীতসংহিতা ৬৮/৫)। আবার অনেক স্থানে বিশেষ বান্দা হিসেবে সকল ইস্রায়েল-সন্তানকে “আল্লাহর পুত্র” বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (দ্বিতীয় বিবরণ ১৪/১, ৩২/১৯; যিশাইয় ১/২, ৩০/১, ৬৩/৮; হোশেয় ১/১০)। বিশেষ করে আল্লাহর অনুগত বান্দাদেরকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর পুত্র’ বলা হয়েছে: “যত লোক ঈশ্বরের আজ্ঞা দ্বারা চালিত হয়, তাহারাই ঈশ্বরের পুত্র।” (রোমীয় ৮/১৪)। বিপরীতে পাপী লোকদেরকে শয়তানের পুত্র বলা হয়েছে। (মথি ৫/৯, ৪৪, ৪৫; যোহন ৩/৮-১০, ৮/৪১-৪৪)। আবার খাস বান্দা হিসেবে ইয়াকূব (আঃ) এবং তাঁর পৌত্র ইফ্রিমিয়কে আল্লাহর প্রথমজাত পুত্র বা বড় ছেলে বলা হয়েছে। (যাত্রাপুস্তক ৪/২২ এবং যিরমিয় ৩১/৯)। দায়ূদ (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র, প্রথমজাত পুত্র ও ‘জন্ম-দেওয়া’ বা ‘ঔরসজাত’ পুত্র বলা হয়েছে (গীতসংহিতা ২/৭)।

হিব্রুভাষী ইয়াহূদীগণ জানতেন যে, ইবনুল্লাহ: ‘আল্লাহর পুত্র’ অর্থ আল্লাহর বান্দা এবং যে যত বেশি আল্লাহর অনুগত তাকে তত প্রিয় বান্দা হিসেবে একমাত্র পুত্র, ঔরসজাত পুত্র ইত্যাদি বলা হয়েছে। এজন্যই তারা দাঊদ (আঃ)-কে ‘ইবনুল্লাহ’, আল্লাহ পুত্র, মাসীহুল্লাহ: আল্লাহর মাসীহ ও জন্মদেওয়া পুত্র বলার কারণে তাকে অলৌকিক সত্তা বলে দাবি করেন নি। বরং তাকে ‘আল্লাহর বান্দা দায়ূদ (Servant David) বলেই আখ্যায়িত করেছেন (২-শ্যমুয়েল ৩/১৮, ৭/৫, ৭/৮, ৭/২৬, ১-রাজাবলি ৩/৬, ৮/২৪, ৮/২৫, ৮/২৬, ১১/৩২, ১৪/৮, ২-রাজাবলি ১৯/৩৪, ২০/৬, ১-বংশাবলি ১৭/৭, ২-বংশাবলি ৬/১৫, ৬/১৬, ৬/১৭; গীতসংহিতা ১৩২/১০; যিশাইয় ৩৭/৩৫; যিহিষ্কেল ৩৪/২৩, ৩৪/২৪, ৩৭/২৫; লূক ১/৬৯; প্রেরিত ৪/২৫)।

ইয়াহূদীদের সাথে কথোপকথনে যীশু বলেন: “তোমাদের পিতার কার্য তোমরা করিতেছ। তাহারা তাঁহাকে কহিল, আমরা ব্যভিচারজাত নহি; আমাদের একমাত্র পিতা আছেন, তিনি ঈশ্বর। যীশু তাহাদিগকে কহিলেন, ঈশ্বর যদি তোমাদের পিতা হইতেন, তবে তোমরা আমাকে প্রেম করিতে ... তোমরা তোমাদের পিতা দিয়াবলের, এবং তোমাদের পিতার অভিলাষ সকল পালন করাই তোমাদের ইচ্ছা; ... কেননা সে মিথ্যাবাদী ও তাহার (মিথ্যাবাদীর) পিতা।” (যোহন ৮/৪১-৪২)

প্রচলিত ইঞ্জিলে ঈসা মাসীহ ঠিক এ অর্থেই নিজেকে আল্লাহর পুত্র এবং আল্লাহকে পিতা বলতেন। পাশাপাশি প্রচলিত চারটি ইঞ্জিলের মধ্যে শতশতবার তিনি নিজেকে মনুষ্যপুত্র (son of man) বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিতাবুল মোকাদ্দসে মনুষ্যপুত্র বলতে ‘মরণশীল মানুষ’ ও ‘আল্লাহর বান্দা’ বুঝানো হয়েছে। নবীগণকে বিশেষভাবে মানুষের পুত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে যেন কেউ অলৌকিক কার্যাদি দেখে তাদেরকে ঈশ্বরের সাথে সম্পৃক্ত মনে না করে। বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বর কখনোই মনুষ্যপুত্র নন, মনুষ্যপুত্র কখনো ঈশ্বর হতে পারে না এবং কোনো মনুষ্যপুত্রের কোনো ক্ষমতা নেই; সকল ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। (গণনাপুস্তক ২৩/১৯; ইয়োব ২৫/৬; গীতসংহিতা ১৪৬/২-৫; যিশাইয় ৫১/১২-১৩)।

বাইবেলের বর্ণনানুসারে কবর থেকে বেরিয়ে মগ্দলীনী মরিয়মকে মাসীহ বলেন: “তুমি আমার ভ্রাতৃগণের কাছে গিয়া তাহাদিগকে বল, যিনি আমার পিতা ও তোমাদের পিতা এবং আমার ঈশ্বর ও তোমাদের ঈশ্বর, তাঁহার নিকটে আমি ঊর্ধ্বে যাইতেছি (I ascend unto my Father, and your Father; and to my God, and your God)।” (যোহন ২০/১৭) তাহলে শিষ্যগণ যে অর্থে ইবনুল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র যীশুও ঠিক সে অর্থেই ইবনুল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র। আবার আল্লাহ যে অর্থে অন্য সকল মানুষের মাবুদ, অবিকল সে অর্থেই তিনি ঈসা মাসীহেরও মাবুদ। এ তাঁর জীবনের শেষ শিক্ষা। কুরআন জানায় যে, ঈসা মাসীহ বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ আমার প্রভু ও তোমাদের প্রভু (আল-ইমরান ৫১), “তোমরা আমার প্রভু ও তোমাদের প্রভু আল্লাহর ইবাদত কর... (মায়িদা ৭২ ও ১১৭), “নিশ্চয় আল্লাহ আমার প্রভু ও তোমাদের প্রভু, অতএব তোমরা তার ইবাদত কর” (মরিয়ম ৩৬ এবং যুখরুফ ৬৪)। এভাবেই কুরআন প্রকৃত ইঞ্জিল সংরক্ষণ করেছে।

আমরা দেখেছি যে, তিনি নিজেকে একজন রাসূল ও শিক্ষক হিসেবে প্রচার করেছেন। ঈশ্বরত্বে আল্লাহর সমকক্ষ বলে নিজেকে দাবি করা তো দূরের কথা কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতা-ই তাঁর নেই বলে তিনি প্রচার করেছেন। কিয়ামত বিষয়ে তিনি বলেন: “কিন্তু সেই দিনের বা সেই দণ্ডের তত্ত্ব কেহই জানে না; স্বর্গস্থ দূতগণও জানেন না, পুত্রও জানেন না, কেবল পিতা জানেন।” (মার্ক ১৩/৩২) অর্থাৎ অলৌকিক ঐশ্বরিক ক্ষমতা তো দূরের কথা, অলৌকিক জ্ঞানও তার নেই।

পিতার সমকক্ষ ঈশ্বরত্ব দাবি করা তো দূরের কথা নিজেকে ভালো বলতেও তিনি রাজি হন নি। এক ব্যক্তি তাঁকে প্রশ্ন করে, “হে সৎ গুরু (Good Master), অনন্ত জীবন পাইবার জন্য আমি কিরূপ সৎকর্ম করিব? তিনি তাহাকে কহিলেন, (Why callest thou me good? there is none good but one, that is, God: KJV/AV) আমাকে কেন সৎ (good) কহিতেছ? একজন ব্যতীত আর কেউই সৎ নন, তিনি ঈশ্বর।” (মথি ১৯/১৬-১৭: বাংলা বাইবেলের অনুবাদ অস্পষ্ট)

মাসীহের শিষ্যগণও আল্লাহর পুত্র বা ‘জাত (begotten জন্মদেওয়া) পুত্র’ বলতে আল্লাহর নেককার বান্দা বুঝিয়েছেন। যোহন বলেন: “যে কেহ বিশ্বাস করে যে, যীশুই সেই খ্রীষ্ট, সে ঈশ্বর হইতে জাত (born of God); এবং যে কেহ জন্মদাতাকে প্রেম করে; সে তাঁহা হইতে জাত ব্যক্তিকেও প্রেম করে (every one that loveth him that begat loveth him also that is begotten of him) ইহাতে আমরা জানিতে পারি যে, ঈশ্বরের সন্তানগণকে প্রেম করি, যখন ঈশ্বরকে প্রেম করি ও তাঁহার আজ্ঞা সকল পালন করি। ... আমরা জানি, যে কেহ ঈশ্বর হইতে জাত, সে পাপ করে না; কিন্তু যে ঈশ্বর হইতে জাত সে নিজেকে (আপনাকে) রক্ষা করে (he that is begotten of God keepeth himself) এবং সেই পাপাত্মা (শয়তান) তাহাকে স্পর্শ করে না।” (১- যোহন ৫/১-২ ও ১৮)

এ অর্থেই তাঁরা মাসীহকে আল্লাহর পুত্র বলেছেন। মার্ক ১৫/৩৯: “সত্যই এ মানুষটি ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন (this man was the Son of God)” এবং লূক ২৩/৪৭: সত্য, এই ব্যক্তি ধার্মিক ছিলেন (this was a righteous man)।”

যে অর্থে তাঁরা তাঁকে আল্লাহর পুত্র বলেছেন, সে অর্থেই তাঁরা তাঁকে আল্লাহর বান্দা বলেছেন। পিতর বলেন: “অব্রাহামের, ইসহাকের ও যাকোবের ঈশ্বর, আমাদের পিতৃপুরুষদের ঈশ্বর আপনার বান্দা যীশুকে গৌরবান্বিত করিয়াছেন (glorified his servant Jesus)।” (প্রেরিত ৩/১৩)

অন্যত্র শিষ্যগণ আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় বলেন: “তুমি তোমার দাস (thy servant David) আমাদের পিতা দায়ূদের মুখ দিয়া... কেননা সত্যই তোমার পবিত্র দাস যীশু (thy servant Jesus)..।” (প্রেরিত ৪/২৪-২৭)।

এর বিপরীতে সাধু পল ‘আল্লাহর পুত্র’ কথাকে গ্রীক-রোমান পৌত্তলিকদের পরিভাষায় ব্যবহার করে আক্ষরিক অর্থে তাঁকে “আল্লাহর পুত্র” বলে দাবি করেন। তিনি ও তাঁর অনুসারীরা যীশুকে আক্ষরিক অর্থে আল্লাহর একজাত বা একমাত্র ঔরসজাত পুত্র (only begotten Son), পিতা আল্লাহর মতই পরিপূর্ণ আল্লাহ, আল্লাহর অবতার বা মানবরূপী আল্লাহ (God incarnate/ God in flesh) এবং আল্লাহর যাতের অংশ (of the same substance) বলে প্রচার করেন। (যোহন ১/১, ১৪, ১৮ ৩/১৬, ৩/১৮; ইব্রীয় ১১/১৭, কলসীয় ১/১৬, ২/৯; ফিলিপীয় ২/৬, ১-তিমথীয় ৩/১৬)।

এভাবে সাধু পল ও তাঁর অনুসারিগণ ঈসা মাসীহের তাওহীদী দীনকে ত্রিত্ববাদী শির্কী ধর্মে পরিণত করেন। এ কথা মুসলিমদের বানানো কথা নয়। যে কোনো এনসাইক্লোপিডিয়া বা ইন্টারনেটে খৃস্টান গবেষকদের লেখা পড়লেই আপনি এ সত্য জানতে পারবেন। মাইক্রোসফট এনকার্টা (Microsoft ® Encarta ® 2008, article (God)) থেকে একটি মাত্র উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

Christianitybeganas a Jewish sect and thus took over the Hebrew God, the Jewish Scriptures eventually becoming, for Christians, the Old Testament. During his ministry, Jesus Christ was probably understood as a prophet of God, but by the end of the 1st century Christians had come to view him as a divine being in his own right, and this created tension with the monotheistic tradition of Judaism. The solution of the problem was the development of the doctrine of the triune God, or Trinity, which, although it is suggested in the New Testament, was not fully formulated until the 4th century.

“খৃস্টধর্ম ইয়াহূদী ধর্মের একটি ফির্কা হিসেবেই যাত্রা শুরু করে। কাজেই ঈশ্বর বা আল্লাহর বিষয়ে ইয়াহূদীদের বিশ্বাস নিয়েই তার শুরু। ক্রমান্বয়ে ইয়াহূদীদের ধর্মগ্রন্থ খৃস্টানদের নিকট ‘পুরাতন নিয়ম’ বলে গণ্য হয়। যীশু খৃস্ট তার জীবদ্দশাতে আল্লাহর একজন নবী বলেই স্বীকৃত বা গৃহীত হয়েছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু প্রথম শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে খৃস্টানগণ তাঁর বিষয়ে মনে করতে লাগলেন যে, তিনি নিজেই একজন ঐশ্বরিক সত্ত্বা। এ ধারণা ইয়াহূদী ধর্মের একত্ববাদ-এর সাথে সংঘাত সৃষ্টি করে। এ সমস্যার সমাধানের জন্য ত্রিত্ববাদ বা তিন ব্যক্তির ঈশ্বর মতবাদের উৎপত্তি ঘটে। যদিও নতুন নিয়মের মধ্যে এ মতের কিছু ধারণা আছে, তবে ত্রিত্ববাদ মতটি ৪র্থ খৃস্টীয় শতকের আগে পূর্ণরূপ লাভ করে নি।”

এভাবে ঈসা মাসীহের একত্ববাদী ধর্ম একশত বৎসরের মাথায় ত্রিত্ববাদী শির্কী ধর্মে পরিণত হলো, শুধু ঈসা মাসীহের “ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্ব” কল্পনা করার কারণে। আর এ কল্পনার মূল কারণ ছিল হিব্রু ভাষার সম্মানসূচক “ঈশ্বরের পুত্র” পরিভাষাটির অর্থ গ্রীক ভাষায় ‘আক্ষরিক’ অর্থে ব্যবহার করা।

এ মহা ধ্বংসের জন্য দায়ী ছিলেন সাধু পল ও তাঁর অনুসারীরা। যীশু বলেছেন যে, তিনি শুধু ইস্রায়েল বংশের নবী হিসেবে প্রেরিত। তাদের জন্য “ঈশ্বরের পুত্র” পরিভাষাটির ব্যবহারে কোনো অসুবিধা ছিল না। এজন্য তিনি অ-ইস্রায়েলীদের কাছে তাঁর ধর্ম প্রচার করতে কঠিনভাবে নিষেধ করেন। (মথি ৭/৬, ১০/৫-৮; ১৫/২২-২৮) কিন্তু সাধু পল ও তাঁর অনুসারীরা নিজেরা গ্রীক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যীশুর ঈশ্বরত্ব দাবি করতে থাকেন এবং এ ধর্মকে এশিয়া মাইনর ও ইউরোপের রোমান অঞ্চলে প্রচার করেন। এ সকল এলাকার মানুষেরা ঈশ্বরের পুত্র পরিভাষাকে আক্ষরিক অর্থেই বুঝতো এবং তাদের দেবদেবীদেরকে ঈশ্বরের পুত্র বা কন্যা হিসেবেই পূজা করত। তারা ঈসা মাসীহকেও এ অর্থেই বুঝে। এভাবে ১০০ বৎসরের মধ্যে ঈসা মাসীহের ধর্ম নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য বিশ্বধর্ম ইসলামে “আল্লাহর প্রিয়পাত্র” হিসেবেও কাউকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর পুত্র’ বলতে নিষেধ করা হয়েছে। (৫-মায়িদা ১৮ আয়াত)।