আগেই বলেছি যে, প্রেরিত পুস্তকটি ও পরবর্তী পত্রগুলি থেকে জানা যায় যে, সাধু পলের এ মতবাদ হাওয়ারী এবং শরীয়ত পালনকারী খৃস্টানদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়ে। আত্মরক্ষার জন্য তিনি অতিভক্তির আশ্রয় গ্রহণ করেন। এতকাল সকলেই জানত যে বিশ্বাস ও শরীয়ত পালনের মাধ্যমেই মানুষ নাজাত পায়। এখন তিনি বলছেন শরীয়ত পালন মুক্তির পথে প্রতিবন্ধক। এটি প্রমাণের জন্য তিনি বললেন: যীশু তো আর সাধারণ কোনো নবী নন; যে তাকে হত্যা করাতে শুধু হত্যাকারীদের পাপ হয়েছে। বরং তিনি ঈশ্বর; তিনি ক্রুশে মরে সকলের পাপ মোচন করেছেন। কাজেই শরীয়ত পালনের আর প্রয়োজন নেই। তিনি প্রচার করতে থাকেন: “ব্যবস্থা (শরীয়ত) দ্বারা যদি ধার্মিকতা হয়, তাহা হইলে খৃস্ট অকারণে মরিলেন” (গালাতীয় ২/২১)। তিনি বলেন: “খৃস্ট যীশুতে জীবনের আত্মার যে ব্যবস্থা, তাহা আমাদেরকে পাপের ও মৃত্যুর ব্যবস্থা (শরীয়ত) হইতে মুক্ত করিয়াছে (রোমীয় ৮/২) অর্থাৎ শরীয়ত আছে বলেই পাপ এবং পাপ আছে বলেই অনন্ত মৃত্যু বা নরকবাস। যীশুতে বিশ্বাস করলে আর শরীয়ত থাকে না; আর শরীয়ত না থাকলে তো কোনো কিছুই আর পাপ বলে গণ্য হবে না।

সাধু পলের এ উদ্ভাবন সফল হয়েছিল। এ অতিভক্তির আকীদা তাকে ও তাঁর মতবাদকে চিরস্থায়ী করে; নইলে হাওয়ারী ও শরীয়তপন্থীদের প্রতিরোধে তার মতবাদ বিলুপ্ত হয়ে যেত। যেভাবে আমাদের সমাজে শরীয়ত-মুক্ত তরিকত-মারিফত পন্থীগণ সর্বদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ওলীগণের প্রতি অতিভক্তি প্রকাশ করেন এবং শরীয়ত-পন্থীদেরকে বেয়াদব বানিয়ে সাধারণ মানুষদের সমর্থন লাভ করেন ও টিকে থাকেন।

সাধু পলের উদ্ভাবিত ‘অতিভক্তির’ মূল বিষয় ত্রিত্ববাদ। মাসীহ আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস এবং প্রচার করতেন। তিনি হিব্রু ভাষার রীতিতে ইয়াহূদী নবীগণ ও সকল ইয়াহূদীর মতই ‘রব্ব’ অর্থে আল্লাহকে পিতা বলতেন। তিনি সর্বদা বলেছেন, পিতাই একমাত্র ঈশ্বর। পিতার পাশাপাশি পুত্র ও পবিত্র আত্মাও ঈশ্বর-এ কথা ঘুণাক্ষরেও তিনি বলেন নি। পক্ষান্তরে সাধু পলের ধর্মের মূল বিশ্বাস যে, আল্লাহ তিনজন সম্পূর্ণ পৃথক ব্যক্তি। এরূপ জঘন্য কথা ঈসা মাসীহ কখনোই বলেন নি।

মার্ক ১২/২৮-৩৪: “একজন আলেম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তৌরাত শরীফের মধ্যে সবচেয়ে দরকারী হুকুম কোনটা’? জবাবে ঈসা বললেন, ‘সবচেয়ে দরকারী হুকুম হল, বনি-ইস্রাইলরা, শোন, আমাদের মাবুদ আল্লাহ্ এক। তোমরা প্রত্যেকে তোমাদের সমস্ত দিল, সমস্ত প্রাণ, সমস্ত মন এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমাদের মাবুদ আল্লাহকে মহব্বত করবে। তার পরের দরকারী হুকুম হল এই, ‘তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মত মহব্বত করবে’। এই দু‘টা হুকুমের চেয়ে বড় হুকুম আর কিছুই নেই”। তখন সেই আলেম বললেন, “... আপনি সত্যি কথাই বলেছেন যে, আল্লাহ্ এক এবং তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। আর সমস্ত দিল, সমস্ত বুদ্ধি ও সমস্ত শক্তি দিয়ে তাঁকে মহববত করা এবং প্রতিবেশীকে নিজের মত মহববত করা পশু ও অন্য সব কোরবানীর চেয়ে অনেক বেশী দরকারী”। ঈসা যখন দেখলেন সেই আলেমটি খুব বুদ্ধিমানের মত জবাব দিয়েছেন তখন তিনি তাঁকে বললেন “আল্লাহর রাজ্য থেকে আপনি বেশী দূরে নন”।

সাধু পলের অনুসারীরা বলেন, আল্লাহকে একমাত্র মাবূদ বলে বিশ্বাস করলেও নাজাত হবে না; বরং ত্রিত্বে, যীশুর ঈশ্বরত্বে ও যীশুর রক্তের মাধ্যমে পাপমোচনে বিশ্বাস করতে হবে। যদি ত্রিত্ববাদী এ আকীদা সঠিক হতো, তবে নিশ্চয়ই ভাববাদীগণের গ্রন্থে প্রথম আজ্ঞা হিসেবে সুস্পষ্টরূপে তা উল্লেখ করা হতো এবং যীশু বলতেন: ‘প্রথম আজ্ঞাটি এই, ‘ঈশ্বর প্রভু এক, যিনি তিনটি প্রকৃত ও সম্পূর্ণ পৃথক সত্তার সমন্বয় এবং আমিই ঈশ্বরের দ্বিতীয় ব্যক্তি ও ঈশ্বরের পুত্র।’ যেহেতু যীশু তা বলেন নি এবং কোনো নবীর পুস্তকে বা ইঞ্জিলেও তা বলা হয় নি, সেহেতু আমরা সুনিশ্চিতরূপে জানতে পারছি যে, সাধু পলের খৃস্টধর্ম একটি ভ্রান্ত মতবাদ।

আরো লক্ষণীয় যে, এ অধ্যাপক ত্রিত্বে বিশ্বাস করতেন না। উপরন্তু কেউ ত্রিত্বের কথা বললে বা যীশু নিজেকে ঈশ্বরের এক অংশ বলে দাবি করলে তাকে নির্দ্বিধায় হত্যা করতেন। অথচ যীশু সুস্পষ্ট উক্ত অধ্যাপককে জান্নাতী বললেন।

সাধু পলের অনুসারীরা বলেন, ইয়াহূদীদের ভয়ে বা মানুষেরা বুঝবে না বলে যীশু মিথ্যা বলেছিলেন! তাঁরা নিজেদের মিথ্যাচার বৈধ করতে তাঁকে অপারগ ও মুনাফিক রূপে চিত্রিত করেন। সত্য বুঝানোর ক্ষমতা ও সাহস পলের ছিল কিন্তু যীশুর ছিল না!

আল্লাহর কাছে মুনাজাতে যীশু বলেন: “আর ইহাই অনন্ত জীবন যে, তাহারা তোমাকে, একমাত্র সত্যময় ঈশ্বরকে এবং তুমি যাঁহাকে পাঠাইয়াছ, তাঁহাকে, যীশু খ্রীষ্টকে, জানিতে পায়। (And this is life eternal, that they might know thee the only true God, and Jesus Christ, whom thou hast sent.)” (যোহন ১৭/৩)

এ কথাটি তিনি একান্তে আল্লাহর সাথে বলেছেন; কাজেই ইয়াহূদীদের ভয়ে বা কেউ বুঝবে না বলে দাবি করার সুযোগ নেই। এখানেও তিনি বলছেন যে, জান্নাত লাভ করতে বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই এবং ঈসা মাসীহ তাঁর প্রেরিত অর্থাৎ রাসূল। ঈশ্বরের ত্রিত্বে বিশ্বাস করা, আদি পাপ বা পাপ মোচনে বিশ্বাস করা ... ইত্যাদি কিছুই জান্নাত লাভের শর্ত নয়। একটিবারের জন্য গোপন মুনাজাতেও তিনি বললেন না যে, ‘ইহাই অনন্ত জীবন যে, তাহারা জানিবে তোমার সত্ত্বা তিনটি সম্পূর্ণ পৃথক সত্ত্বার সমন্বয় এবং ঈসা মাসীহ মনুষ্য ও ঈশ্বর বা মাংসে প্রকাশিত ঈশ্বর।’ পক্ষান্তরে পলীয় ধর্মের বিশ্বাস হলো কেউ যদি যীশুর উপরের কথাটি সর্বান্তকরণে ও আক্ষরিকভাবে বিশ্বাস করার কথা এক কোটি বার ঘোষণা করে, কিন্তু স্পষ্টভাবে ত্রিত্ববাদের ঘোষণা না দেয় তবে কাফির (heretic)। তাকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা (Inquisition) খৃস্টধর্মের সুপরিচিত বিধান।