কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম ভূমিকা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর নিমিত্ত। সালাত ও সালাম তাঁর প্রিয়তম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, তাঁর পরিজন, সহচর, আল্লাহর সকল নবী-রাসূল ও প্রকৃত অনুসারীদের জন্য।

১৯৭৮ খৃস্টাব্দে আমেরিকার কলরাডো (Colorado) রাষ্ট্রের কলরাডো স্প্রীংস (Colorado springs) শহরে (north American conference on muslim evangelization): ‘মুসলিমদের খৃস্টান বানানো বিষয়ে উত্তর আমেরিকান সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে মিশনারিগণ পরবর্তী অর্ধশতকের মধ্যে বাংলাদেশ-সহ এশিয়ার কয়েকটি মুসলিম দেশকে খৃস্টান-প্রধান দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা নেন। তারা প্রচার-পদ্ধতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। নিজেদেরকে মুসলিম, ঈসায়ী তরীকার মুসলিম বলে পরিচয় দেওয়া, ধর্মান্তরিতদের নামায-রোযা, ঈদ-মীলাদ বহাল রাখতে বলা.. ইত্যাদি। এ উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় সহস্রাধিক প্রচারক একনিষ্ঠভাবে কর্ম করে চলেছেন। ৫০ বৎসর আগে বাংলাদেশে কয়েক হাজার খৃস্টান ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৫০ লক্ষ মুসলিম খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়।

প্রত্যেকেরই অধিকার আছে নিজ ধর্ম প্রচার করার। কিন্তু অন্যদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা বা নিজের বিশ্বাস গোপন করে প্রতারণা করা আপত্তিকর। সকল সম্প্রদায়ের ন্যায় খৃস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক ভাল মানুষ রয়েছেন, কুরআনে তাঁদের প্রশংসা করা হয়েছে (মায়িদা: ৮২)। কিন্তু খৃস্টধর্মের প্রাণপুরুষ সাধু পল মিথ্যার মাধ্যমে ধর্মপ্রচার পূণ্যকর্ম বলে গণ্য করেছেন। তিনি বলেন: "For if the truth of God hath more abounded through my lie unto his glory; why yet am I also judged as a sinner?" কিন্তু আমার মিথ্যায় যদি ঈশ্বরের সত্য তাঁহার গৌরবার্থে উপচিয়া পড়ে, তবে আমিও বা এখন পাপী বলিয়া আর বিচারিত হইতেছি কেন?” (রোমান ৩/৭)। এজন্য মিথ্যাচার অনেক প্রচারকের মূলনীতিতে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশের সর্বত্র ঈসায়ী প্রচারকগণ যা বলছেন তার মধ্যে রয়েছে: তাওরাত-ইঞ্জিল না পালন করে কোনো মুসলিম মুক্তি পাবে না। আমরা নাসারা-খৃস্টান নই; আমরা মুসলিম, আমরা ঈসায়ী মুসলিম। আমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মান্য করি, কুরআন ও সকল ধর্মগ্রন্থ মান্য করি। শুধু ঈসায়ী তরীকা গ্রহণ করি। শুধু ভক্তির জন্য ঈসাকে আল্লাহর পুত্র বলি। আমরা বাইবেল মানি না; বরং কিতাবুল মোকাদ্দস মানি। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু আরবদের সতর্ক করতে এসেছিলেন, আর ঈসা মাসীহ বিশ্বের পাপীদের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছেন। ঈসা মাসীহ যেহেতু আবার আসবেন; কাজেই তার উপর ঈমান এনে আগেই প্রস্তুতি নেওয়া ভাল। ঈসা মাসীহ জীবিত কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত; জীবিতের কাছেই যেতে হবে। ঈসা মাসীহ জীবিতকে মৃত করেছেন কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা করেন নি; কাজেই ঈসা মাসীহই বড়। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষ খুন করেছেন; কাজেই তিনি শান্তির দুত নন; ঈসা মাসীহ শান্তির দূত! মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাপী, কাজেই তিনি কিয়ামতে শাফা‘আত করতে পারবেন না; ঈসা মাসীহ নিষ্পাপ, তিনিই শাফা‘আত করবেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃদ্ধ বয়সে কিশোরী মেয়ে বিবাহ করেন, কাজেই তাঁর চরিত্র ভাল ছিল না। (নাঊযু বিল্লাহ!) .... এ জাতীয় আরো অনেক নোংরা কথা।

এ সকল কথা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করছে এবং মুসলিমদের আহত করছে। বিষয়টিকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও তথ্যভিত্তিক আলোচনায় রূপান্তরিত না করলে যে কোনো সময় হানাহানির রূপ নিতে পারে। কারণ, বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক করতে অক্ষম হলে মানুষ আবেগ তাড়িত হয়ে শক্তির আশ্রয় নিতে পারে। এজন্য এ পুস্তিকাটির রচনা। যেমন সমাজের আলিম, তালিবুল ইলম এবং সাধারণ যে কোনো মুসলিম কুরআন, হাদীস ও তাওরাত-ইঞ্জিল-এর আলোকে ঈসায়ী প্রচারকদের সাথে তথ্যভিত্তিক ও জ্ঞানবৃত্তিক আলোচনা করতে পারেন।

অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। আল্লাহ বলেন: “আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না।” (আন‘আম: ১০৮)। “তোমরা উত্তম ও সৌজন্যময় পন্থা ব্যতীত কিতাবীগণের (ইয়াহূদী-খৃস্টানগণের) সাথে বিতর্ক করো না, তবে তাদের সাথে করতে পার যারা তাদের মধ্যে সীমালঙ্ঘন করে।” (আনকাবূত: ৪৬)। সারা বিশ্বে ঈসায়ী পোপ, পাদরি ও পণ্ডিতগণ ঘৃণ্য সিনেমা, কার্টুন, প্রচারণা ও বইপুস্তক লিখে এবং প্রচারকগণ মাঠে ময়দানে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে নোংরা কথা বলে মুসলিমদের অনুভূতিকে আহত করছেন। কিন্তু কুরআনের নির্দেশে আমরা আমাদের মারাত্মকভাবে আহত অনুভূতিকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ এবং খৃস্টান পণ্ডিতদের বক্তব্যের আলোকেই প্রচারকদের বক্তব্য পর্যালোচনা করেছি।

খৃস্টানগণ এতদিন ঈশ্বর, ভাববাদী, যীশু খৃস্ট ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতেন। বর্তমানে আল্লাহ, নবী, ঈসা মাসীহ, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন। আমি উভয় প্রকারের পরিভাষা ব্যবহার করেছি। বাংলা বাইবেলের কেরির অনুবাদই মূল ইংরেজির নিকটবর্তী, কিন্তু ভাষা দুর্বোধ্য। মুসলমানী অনুবাদগুলিতে মূলত মুসলিমদের ধর্মান্তর করার দিকেই লক্ষ্য রাখা হয়েছে। ফলে অনেক স্থানেই মূল অর্থ বিকৃত হয়েছে। এজন্য ইংরেজি বাইবেল সামনে রেখে মূলত কেরির বাংলা বাইবেল এবং প্রয়োজনে কিতাবুল মোকাদ্দস ও অন্যান্য বাংলা অনুবাদের সাহায্য গ্রহণ করেছি এবং প্রয়োজনে তুলনার জন্য ইংরেজি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছি।

গ্রীক biblion, ল্যাটিন biblia ও ইংরেজি bible শব্দটির অর্থ গ্রন্থাবলি বা গ্রন্থমালা। মূল গ্রীক বাইবেল বা ক্যাথলিক বাইবেলের পুস্তকের সংখ্যা ৭৩টি। প্রটেস্ট্যান্ট খৃস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথার: Martin Luther (১৫২৯ খৃ) ৭টি পূর্ণ বইকে জাল বলে বাতিল করেন। বাকি বইগুলি থেকেও অনেক অধ্যায় ও আয়াত জাল বলে বাতিল করেন। এজন্য প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলে বইয়ের সংখ্যা ৬৬টি। ক্যাথলিক বাইবেল বাংলায় ‘পবিত্র বাইবেল: জুবিলী বাইবেল’ নামে অনূদিত এবং বাংলাদেশ ক্যাথলিক বিশপ সম্মিলনী ১৯৯৯, ২০০৬ কর্তৃক প্রকাশিত। প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলটি ‘পবিত্র বাইবেল’ নামে প্রথম উইলিয়াম কেরি কর্তৃক অনূদিত ও বিভিন্ন সময়ে পরিমার্জিত ও বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি (বি. বি. এস.) কর্তৃক প্রকাশিত। বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি সর্বশেষ বাইবেলকে ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার করে ‘কিতাবুল মোকাদ্দস’ নামে প্রকাশ করেন। এতে বাইবেলের বইগুলির নামও পরিবর্তন করা হয়। এজন্য এখানে বাইবেলের বইগুলির নামের তালিকা এ পুস্তিকার শেষে দেওয়া হলো।

ত্রিত্ববাদী আকীদা, খৃস্টান প্রচারকদের সীমালঙ্ঘন এবং কিতাবুল মোকাদ্দসের বিকৃতি বুঝাতে তাদের অনেক কুফরী আকীদা বা বক্তব্য উদ্ধৃত করতে বাধ্য হয়েছি। লেখার সময় মুখে বারবার (নাউযূ বিল্লাহ) বললেও সর্বত্র লিখতে পরিনি। পাঠক এগুলি পাঠের সময় অবশ্যই বারংবার নাউযূ বিল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ বলে হৃদয়কে পবিত্র করবেন।

বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে গবেষণা সহজ হয়েছে। খৃস্টধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন নাম ও শব্দের ইংরেজি বানান অনেক সময় বন্ধনীর মধ্যে উল্লেখ করেছি, যেন আগ্রহী পাঠক এ সকল শব্দ ইংরেজিতে লিখে সার্চ করে খৃস্টান লেখকদের বক্তব্য থেকেই আমাদের উপস্থাপিত তথ্যের বিশুদ্ধতা ও এ বিষয়ক অন্যান্য তথ্য জানতে পারেন।

আল্লাহর মহান রাসূল ঈসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে এবং রাহমাতুল্লিল আলামীন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরুদ্ধে অশোভন নিন্দামূলক (blasphemous) অপপ্রচারের প্রতিরোধে এ সামান্য প্রচেষ্টাকে মহান আল্লাহ আমার, আমার পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তান, সকল পাঠক ও দীনের সকল প্রচারকের নাজাতের উপকরণ হিসেবে কবুল করুন। আমীন!