(ছ) মুসলিম জাতির পরস্পরের মধ্যকার আদব ও অধিকারসমূহ - ৪

১৫. তার সাথে ধোঁকাবাজি বা প্রতারণা না করা; কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

وَٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ بِغَيۡرِ مَا ٱكۡتَسَبُواْ فَقَدِ ٱحۡتَمَلُواْ بُهۡتَٰنٗا وَإِثۡمٗا مُّبِينٗا

“আর যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয় যা তারা করেনি তার জন্য; নিশ্চয় তারা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করলো।”[1] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

وَمَن يَكۡسِبۡ خَطِيٓ‍َٔةً أَوۡ إِثۡمٗا ثُمَّ يَرۡمِ بِهِۦ بَرِيٓ‍ٔٗا فَقَدِ ٱحۡتَمَلَ بُهۡتَٰنٗا وَإِثۡمٗا مُّبِينٗا

“আর কেউ কোনো দোষ বা পাপ করে পরে সেটা কোনো নির্দোষ ব্যক্তির প্রতি আরোপ করলে সে তো মিথ্যা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে।”[2] আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« مَنْ حَمَلَ عَلَيْنَا السِّلاَحَ فَلَيْسَ مِنَّا ، وَمَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا » . (رواه مسلم).

“যে ব্যক্তি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়; আর যে ব্যক্তি আমাদের সাথে প্রতারণা করে, সেও আমাদের দলভুক্ত নয়।”[3] তিনি আরও বলেন:

« مَنْ بَايَعْتَ ، فَقُلْ : لاَ خِلاَبَةَ » . (مُتَّفَقٌ عَلَيهِ) .

“তুমি যার সাথে ক্রয়-বিক্রয় কর, তাকে বল: কোনোরূপ ধোঁকাবাজি করবে না।”[4] নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:

« مَا مِنْ عَبْدٍ يَستَرْعِيهِ اللهُ رَعِيَّةً ، يَمُوتُ يَوْمَ يَمُوتُ وَهُوَ غَاشٌّ لِرَعِيَّتِهِ ، إِلاَّ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الجَنَّة » . (رواه مسلم).

“আল্লাহ তাঁর কোনো বান্দকে প্রজা সাধারণের তত্ত্বাবধায়ক বানাবার পর তাদের সাথে খিয়ানতকারী বা প্রতারণাকারী অবস্থায় যদি সে অবধারিত মৃত্যুর দিন মৃত্যুবরণ করে, তাহলে নিশ্চিতভাবে আল্লাহ তার উপর জান্নাত হারাম করে দেবেন।”[5] তিনি আরও বলেন:

« مَنْ خَبَّبَ زَوْجَةَ امْرِئٍ ، أَوْ مَمْلُوكَهُ ، فَلَيْسَ مِنَّا » . (رواهُ أَبُو داود) .

“যে ব্যক্তি কারও স্ত্রী অথবা দাসীকে ধোঁকা দিয়ে তার চরিত্র নষ্ট করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”[6]

১৬. তার সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করা, অথবা তার খিয়ানত না করা, অথবা তার সাথে মিথ্যা কথা না বলা, অথবা তার ঋণ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে টাল-বাহানা না করা; কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَوۡفُواْ بِٱلۡعُقُودِۚ

“হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ করবে।”[7] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

وَٱلۡمُوفُونَ بِعَهۡدِهِمۡ إِذَا عَٰهَدُواْۖ

“আর তারা যখন প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন তা পূর্ণ করে।”[8] তিনি আরও বলেন:

وَأَوۡفُواْ بِٱلۡعَهۡدِۖ إِنَّ ٱلۡعَهۡدَ كَانَ مَسۡ‍ُٔولٗا

“আর প্রতিশ্রুতি পালন কর; নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।”[9] আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« أرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقاً خَالِصاً ، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا : إِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ ، وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ ، وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ » . (مُتَّفَقٌ عَلَيهِ) .

“চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকে, সে হবে খাঁটি মুনাফিক। আর যার মধ্যে এর কোনো একটি স্বভাব থাকবে, তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত মুনাফিকের একটি স্বভাব তার মধ্যে থেকে যাবে; স্বভাবগুলো হল: আমানত রাখলে খিয়ানত করে, কথা বললে মিথ্যা বলে, চুক্তি করলে ভঙ্গ করে এবং ঝগড়ায় লিপ্ত হলে অশ্লীল ভাষায় কথা বলে।”[10] নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:

« قَالَ الله تَعَالَى : ثَلاَثَةٌ أنا خَصْمُهُمْ يَوْمَ القِيَامَةِ : رَجُلٌ أعْطَى بي ثُمَّ غَدَرَ ، وَرَجُلٌ بَاعَ حُرَّاً فَأَكَلَ ثَمَنَهُ ، وَرَجُلٌ اسْتَأجَرَ أجيراً ، فَاسْتَوْفَى مِنْهُ ، وَلَمْ يُعْطِهِ أجْرَهُ » . (رواه البخاري).

“আল্লাহ তা‘আলা বলেন: কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির সাথে ঝগড়া করব: যে ব্যক্তি আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল; যে ব্যক্তি কোনো আযাদ বা স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল; আর যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিককে কাজে নিযুক্ত করে তার কাছ থেকে পুরোপুরি কাজ আদায় করল, কিন্তু তার মজুরী বা পারশ্রমিক পরিশোধ করল না।”[11] তিনি আরও বলেন:

« مَطْلُ الغَنِيِّ ظُلْمٌ، وَإِذَا أُتْبعَ أَحَدُكُمْ عَلَى مَلِيءٍ فَلْيَتْبَع » . (مُتَّفَقٌ عَلَيهِ) .

“পাওনা আদায়ের ব্যাপারে ধনী ব্যক্তির টাল-বাহানা করাটা যুলুম। আর যদি কারোর ঋণকে অন্য (ধনী) ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করা হয়, তাহলে (ঋণ দাতা) এ স্থানান্তরকে ঋণ বলে মেনে নেয়া উচিত।”[12]

১৭. তার সাথে সুন্দর ব্যবহার করবে; সুতরাং তার জন্য ভালো কিছু করবে এবং তাকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকবে; আর তার সাথে সাক্ষ্যাৎ করবে হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে— তার ভালো ব্যবহার গ্রহণ করে নিবে এবং মন্দ আচরণ ক্ষমা করে দিবে; আর তার নিকট যা নেই সে বিষয়ে তার উপর চাপ সৃষ্টি করবে না; সুতরাং জাহেলের নিকট থেকে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করবে না এবং নির্বাক ব্যক্তি থেকে ভাষা শিখবে না। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

خُذِ ٱلۡعَفۡوَ وَأۡمُرۡ بِٱلۡعُرۡفِ وَأَعۡرِضۡ عَنِ ٱلۡجَٰهِلِينَ

“মানুষের (চরিত্র ও কর্মের) উৎকৃষ্ট অংশ গ্রহণ করুন, সৎকাজের নির্দেশ দিন এবং অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চলুন।”[13] আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« اتَّقِ اللَّهَ حَيْثُ مَا كُنْتَ ، وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا ، وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ » . (رواه أحمد و الترمذي و الحاكم).

“তুমি যেখানেই থাক, আল্লাহকে ভয় কর; আর অসৎকাজ করলে তার পরপরই সৎকাজ কর, তাহলে তা মন্দ কাজকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে; আর মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার কর।”[14]

১৮. বড় হলে তাকে সম্মান করা; আর ছোট হলে তাকে স্নেহ করা; কেননা, মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يُوَقِّرْ كَبِيرَنَا ، وَيَرْحَمْ صَغِيرَنَا » . (رواه أبو داود و الترمذي).

“যে ব্যক্তি আমাদের বড়কে সম্মান করে না এবং ছোটকে স্নেহ করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”[15] তিনি আরও বলেন:

« إنَّ مِنْ إجْلالِ اللهِ تَعَالَى : إكْرَامَ ذِي الشَّيْبَةِ المُسْلِمِ » . (رواه أبو داود).

“আল্লাহ তা‘আলাকে সম্মান করার অন্যতম একটি উপায় হলো বৃদ্ধ মুসলিম ব্যক্তিকে সম্মান করা।”[16] তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন: « كَبِّرْ كَبِّرْ » অর্থাৎ বয়োজ্যেষ্ঠকে দিয়ে শুরু কর। হাদিসে প্রসিদ্ধ আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট শিশুকে নিয়ে আসা হত তার জন্য বরকতের দো‘য়া করার জন্য, অথবা তার নাম রাখার জন্য; তারপর তিনি তাকে তাঁর কোলে নিতেন, ফলে কখনও কখনও শিশু তাঁর কোলে পেশাব করে দিত। হাদিসে আরও বর্ণিত আছে: তিনি যখন সফর থেকে আগমন করতেন, তখন শিশুরা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করত; ফলে তিনি তাদের জন্য থামতেন, তারপর সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিতেন তাদেরকে তাঁর নিকট হাজির করার জন্য; তারপর তিনি তাদের মধ্য থেকে কিছু অংশকে তাঁর সামনে রাখতেন এবং কিছূ অংশকে তাঁর পেছনে রাখতেন; আবার তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিতেন শিশুদের কাউকে কাউকে (তাঁদের কোলে বা কাঁধে) বহন করার জন্য; আর শিশুদের প্রতি স্নেহ ও ভালোবাসার কারণেই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব করতেন।

>
[1] সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৮

[2] সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১২

[3] মুসলিম, হাদিস নং- ২৯৪

[4] বুখারী, হাদিস নং- ২০১১; মুসলিম, হাদিস নং- ৩৯৩৯

[5] মুসলিম, হাদিস নং- ৩৮০

[6] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ৫১৭২

[7] সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ১

[8] সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৭

[9] সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৩৪

[10] বুখারী, হাদিস নং- ৩৪; মুসলিম, হাদিস নং- ২১৯

[11] বুখারী, হাদিস নং- ২১১৪

[12] বুখারী, হাদিস নং- ২১৬৬; মুসলিম, হাদিস নং- ৪০৮৫

[13] সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৯৯

[14] আহমাদ, তিরমিযী ও হাকেম।

[15] আবূ দাউদ ও তিরমিযী এবং তিনি হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।

[16] আবূ দাউদ রহ. হাদিসটি ‘হাসান’ সনদে বর্ণনা করেছেন।