(ছ) মুসলিম জাতির পরস্পরের মধ্যকার আদব ও অধিকারসমূহ - ১

মুসলিম ব্যক্তি তার উপর তার অপর মুসলিম ভাইয়ের অধিকারসমূহ আদায় ও আদবসমূহ মেনে চলার আবশ্যকতার ব্যাপারে বিশ্বাস করে; সুতরাং সে তার মুসলিম ভাইয়ের সাথে আদবসমূহ রক্ষা করে চলবে এবং তার অধিকারসমূহ যথাযথভাবে আদায় করে দিবে; আর সে এটাও বিশ্বাস করে যে, এসব আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত এবং এর দ্বারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নৈকট্য অর্জন করা যায়; কেননা, এসব অধিকার ও আদব আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম ব্যক্তির উপর বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন, যাতে সে তার মুসলিম ভাইয়ের সাথে এগুলো মেনে চলে; সুতরাং কোনো সন্দেহ নেই— তার এ কাজ করাটা আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর নৈকট্য অর্জনের উপায় বলে গণ্য হবে।

আর এসব আদব ও অধিকারের অন্যতম কিছু দিক নিম্নরূপ:

১. যখন তার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হবে, তখন তার সাথে কথা বলার পূর্বেই তাকে সালাম প্রদান করবে; সুতরাং সে বলবে: " السلام عليكم و رحمة الله "(আপনার উপর শান্তি ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হউক); তারপর সে তার সাথে মুসাফাহা (করমর্দন) করবে এবং সালামের জবাব স্বরূপ বলবে: " و عليكم السلام و رحمة الله و بركاته " (আপনার উপরও শান্তি এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হউক); আর এটা এ জন্য যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

وَإِذَا حُيِّيتُم بِتَحِيَّةٖ فَحَيُّواْ بِأَحۡسَنَ مِنۡهَآ أَوۡ رُدُّوهَآۗ

“আর তোমাদেরকে যখন অভিবাদন করা হয়, তখন তোমরাও তার চেয়ে উত্তম প্রত্যাভিবাদন করবে অথবা সেটারই অনুরূপ করবে।”[1] আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« يُسَلِّمُ الرَّاكِبُ عَلَى الْمَاشِي ، وَالْمَاشِي عَلَى الْقَاعِدِ ، وَالْقَلِيلُ عَلَى الْكَثِيرِ » . (متفق عليه).

“বাহনে আরোহণকারী ব্যক্তি পদব্রজে আগমনকারী ব্যক্তিকে, পদব্রজে আগমনকারী ব্যক্তি বসা ব্যক্তিকে এবং কম সংখ্যক লোক বেশি সংখ্যক লোককে সালাম প্রদান করবে।”[2] তিনি আরও বলেন:

« إنَّ الملائكةَ تَعجِبُ من المسلمِ يمُرُّ على المسلمِ ولا يُسَلِّمُ عَليهِ » .

“ফেরেশ্তাগণ ঐ মুসলিম ব্যক্তির ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করেন, যে আরেক মুসলিম ব্যক্তির পাশ দিয়ে চলে গেল, অথচ সে তাকে সালাম প্রদান করল না।”[3] তিনি আরও বলেন:

« وَتَقْرَأُ السَّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ » . (متفق عليه).

“আর তুমি তোমার পরিচিত ও অপরিচিত সকল (মুসলিম) ব্যক্তিকে সালাম প্রদান করবে।”[4] তিনি আরও বলেন:

« مَا مِنْ مُسْلِمَينِ يَلْتَقِيَانِ فَيَتَصَافَحَانِ إِلاَّ غُفِرَ لَهُمَا قَبْلَ أنْ يَفْتَرِقَا » . (رواه أبو داود و ابن ماجه و الترمذي).

“যখনই দুইজন মুসলিম ব্যক্তি পরস্পর সাক্ষাৎ হওয়ার পর মুসাফাহা করে, তারা পরস্পর থেকে আলাদা হওয়ার আগেই তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।”[5] তিনি আরও বলেন:

« مَنْ بَدَأَ بِالْكَلامِ قَبْلَ السَّلامِ فَلا تُجِيبُوهُ حتى يَبدأ بِالسَّلامِ » . (رواه الطبراني و أبو نعيم).

“যে ব্যক্তি সালাম দেয়ার পূর্বে কথা বলা আরম্ভ করে, তোমরা তার কথায় সায় দেবে না, যতক্ষণ না সে সালামের মাধ্যমে কথার সূচনা করে।”[6]

২. যখন সে হাঁচি দিবে, তখন তার হাঁচির জবাব দিবে; অর্থাৎ সে যখন হাঁচি দেওয়ার পর ‘আলহামদুলিল্লাহ’ (الحَمْدُ للهِ) বলে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করবে, তখন সে তাকে উদ্দেশ্য করে বলবে: ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ (يَرْحَمُكَ اللهُ) [অর্থাৎ আল্লাহ তোমার প্রতি রহম করুন]; আর তখন হাঁচিদাতা তার জবাব স্বরূপ আবার বলবে: " يَغْفِرُ اللهُ لِيْ و لَكَ " (আল্লাহ আমাকে ও তোমাকে ক্ষমা করে দিন) অথবা বলবে: " يَهْدِيكُمُ اللهُ وَيُصْلِحُ بَالَكُمْ " (আল্লাহ তোমাদেরকে হিদায়েত করুন এবং তোমাদের অবস্থাকে ভালো করে দিন)। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« إِذَا عَطَسَ أحَدُكُمْ فَلْيَقُلْ : الحَمْدُ للهِ ، وَلْيَقُلْ لَهُ أخُوهُ أَوْ صَاحِبُهُ : يَرْحَمُكَ الله . فإذَا قَالَ لَهُ : يَرْحَمُكَ اللهُ ، فَليَقُلْ : يَهْدِيكُمُ اللهُ وَيُصْلِحُ بَالَكُمْ » . (رواه البخاري).

“যখন তোমাদের কেউ হাঁচি দেয়, তখন সে যেন বলে: ‘আলহামদুলিল্লাহ’ (الحَمْدُ للهِ) এবং তার ভাই বা সঙ্গী যেন তাকে বলে: " يَرْحَمُكَ اللهُ " (অর্থাৎ আল্লাহ তোমার উপর রহমত বর্ষণ করুন); আর যখন সে তাকে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ (يَرْحَمُكَ اللهُ) বলবে, তখন সে যেন বলে: " يَهْدِيكُمُ اللهُ وَيُصْلِحُ بَالَكُمْ " (আল্লাহ তোমাদেরকে হিদায়েত করুন এবং তোমাদের অবস্থাকে ভালো করে দিন)।”[7] আর আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

« كَانَ رسول الله صلى الله عليه وسلم إِذَا عَطَسَ وَضَعَ يَدَهُ أَوْ ثَوْبَهُ عَلَى فِيهِ ، وَخَفَضَ أَوْ غَضَّ بِهَا صَوْتَهُ » . (رواه أَبُو داود والترمذي).

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হাঁচি দিতেন, তখন তিনি তাঁর মুখের উপর হাত বা কাপড় রাখতেন এবং এর দ্বারা হাঁচির আওয়াজ নিম্নগামী করতেন।”[8]

৩. যখন সে অসুস্থ হবে, তখন তার সেবা-যত্ন করা এবং তার জন্য রোগমুক্তির দো‘য়া করা; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« حَقُّ المُسْلِم عَلَى المُسْلِم خَمْسٌ : رَدُّ السَّلامِ ، وَعِيَادَةُ المَريض ، وَاتِّبَاعُ الجَنَائِزِ ، وَإجَابَةُ الدَّعْوَة ، وتَشْميتُ العَاطِسِ » . (متفق عليه).

“এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের পাঁচটি হক বা অধিকার রয়েছে: সালামের জবাব দেয়া, রোগীর সেবা করা, জানাযার সালাতে অংশ নেয়া, দাওয়াত কবুল করা এবং হাঁচির জবাব দেয়া।”[9] আর তাছাড়া বারা ইবন ‘আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

« أمَرَنَارَسُول الله صلى الله عليه وسلم بعيَادَة المَرِيض ، وَاتِّبَاعِ الجَنَازَةِ ، وتَشْمِيتِ العَاطسِ، وَإبْرار المُقْسِم، ونَصْرِ المَظْلُوم ، وَإجَابَةِ الدَّاعِي ، وَإِفْشَاءِ السَّلامِ » . (رواه البخاري).

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন রোগীর সেবা করতে, জানাযার অনুসরণ করতে, হাঁচির জবাব দিতে, শপথ বা প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে, মাযলুমকে সাহায্য করতে, দাওয়াত দাতার দাওয়াত কবুল করতে এবং ব্যাপকভাবে সালামের প্রচলন করতে।”[10] নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:

« عُودُوا المَريضَ ، وَأطْعِمُوا الجَائِعَ ، وَفُكُّوا العَانِي » . (رواه البخاري).

“তোমারা রোগীকে দেখতে যাও বা সেবা কর, অভুক্তকে খাবার দাও এবং বন্দীদেরকে মুক্তি দাও।”[11] আর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন:

« أنَّ النَّبيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَعُودُ بَعْضَ أهْلِهِ يَمْسَحُ بِيدِهِ اليُمْنَى ، ويقولُ : « اللَّهُمَّ رَبَّ النَّاسِ ، أذْهِب البَأسَ ، اشْفِ أنْتَ الشَّافِي لاَ شِفَاءَ إِلاَّ شِفاؤكَ ، شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقماً » . (متفق عليه).

“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পরিবারের কোনো রোগীকে দেখতে গেলে তার উপর ডান হাত বুলাতেন এবং বলতেন: « اللَّهُمَّ رَبَّ النَّاسِ ، أذْهِب البَأسَ ، اشْفِ أنْتَ الشَّافِي لاَ شِفَاءَ إِلاَّ شِفاؤكَ ، شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقماً » (হে আল্লাহ! হে মানুষের প্রভু! রোগ দূর কর, রোগমুক্তি দাও, তুমিই রোগমুক্তি দানকারী, কোনো রোগমুক্তি নেই তোমার রোগমুক্তি ছাড়া— যা কোনো রোগকে ছাড়ে না)।”[12]

৪. সে যখন মারা যাবে, তখন তার জানাযায় হাযির হওয়া; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« حَقُّ المُسْلِم عَلَى المُسْلِم خَمْسٌ : رَدُّ السَّلامِ ، وَعِيَادَةُ المَريض ، وَاتِّبَاعُ الجَنَائِزِ ، وَإجَابَةُ الدَّعْوَة ، وتَشْميتُ العَاطِسِ » . (متفق عليه).

“এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের পাঁচটি হক বা অধিকার রয়েছে: সালামের জবাব দেয়া, রোগীর সেবা করা, জানাযার সালাতে অংশ নেয়া, দাওয়াত কবুল করা এবং হাঁচির জবাব দেয়া।”[13]

৫. তার শপথ পূরণ করা, যখন সে কোন ব্যাপারে শপথ করে বসে এবং তাতে অবৈধ কোন কিছু না থাকে; সুতরাং সে যে কারণে শপথ করেছে, তা পূরণে সহযোগিতামূলক কাজ করবে, যাতে তার শপথ ভঙ্গ করতে না হয়; কারণ, বারা ইবন ‘আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদিসের মধ্যে এসেছে, তিনি বলেন:

« أمَرَنَارَسُول الله صلى الله عليه وسلم بعيَادَة المَرِيض ، وَاتِّبَاعِ الجَنَازَةِ ، وتَشْمِيتِ العَاطسِ، وَإبْرار المُقْسِم، ونَصْرِ المَظْلُوم ، وَإجَابَةِ الدَّاعِي ، وَإِفْشَاءِ السَّلامِ » . (رواه البخاري).

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন রোগীর সেবা করতে, জানাযার অনুসরণ করতে, হাঁচির জবাব দিতে, শপথ বা প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে, মাযলুমকে সাহায্য করতে, দা‘ওয়াত দাতার দা‘ওয়াত কবুল করতে এবং ব্যাপকভাবে সালামের প্রচলন করতে।”[14]

>
[1] সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৮৬

[2] বুখারী, হাদিস নং- ৫৮৭৮; মুসলিম, হাদিস নং- ৫৭৭২

[3] যাইন আল-‘ইরাকী বলেন: তার মূল সনদের ব্যাপারে আমার জানা নেই।

[4] বুখারী ও মুসলিম।

[5] আবূ দাউদ, ইবনু মাজাহ ও তিরমিযী।

[6] ত্ববারানী ও আবূ না‘য়ীম; আর আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।

[7] বুখারী, হাদিস নং- ৫৮৭০

[8] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ৫০৩১; তিরমিযী, হাদিস নং- ২৭৪৫

[9] বুখারী, হাদিস নং- ৫৮৭৮; মুসলিম, হাদিস নং- ৫৭৭২

[10] বুখারী, হাদিস নং- ৪৮৮০

[11] বুখারী, হাদিস নং- ৫০৫৮

[12] বুখারী, হাদিস নং- ৫৪১১; মুসলিম, হাদিস নং- ৫৮৩৬

[13] বুখারী, হাদিস নং- ৫৮৭৮; মুসলিম, হাদিস নং- ৫৭৭২

[14] বুখারী, হাদিস নং- ৪৮৮০