সুন্নাতের পরিচয় ও গুরুত্ব অনেক জরুরী ও দীর্ঘ বিষয়। শরয়ী বিধানের দ্বিতীয় উৎস এই সুন্নাত, তাই তা অনেক দীর্ঘ হওয়ার কথা। উলামায়ে কেরাম এ বিষয়ের উপর অনেক কিতাব রচনা করেছেন।[1] আমাদের মূল আলোচনা সুন্নাত বা বিদ‘আত নিয়ে নয়। তাই এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার কথা নয়। তথাপি প্রচলিত বিভিন্ন খতম যা আমাদের মূল আলোচনার বিষয় তা বুঝতে সুন্নাত ও বিদ‘আত বোঝার বিকল্প নেই। তাই অত্যন্ত সংক্ষেপে দুটি বিষয়েই একেবারেই সামান্য আলোচনার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ। যাতে করে খতমের তাৎপর্য বুঝা আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায়। বাস্তব কথা হলো, যিনি প্রকৃতপক্ষ সুন্নাত ও বিদ‘আত চিনে নিয়েছেন তার কাছে প্রচলিত খতমের তাৎপর্য আলোচনা করে বোঝাবার প্রয়োজন নেই। যাই হোক, অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে সুন্নাত ও বিদ‘আত দুটি বিষয়কে একটু বোঝার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহর তওফিক কাম্য।

সুন্নাতের পরিচয়

সুন্নাত শব্দের শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থ: ছবি, প্রতিচ্ছবি, প্রকৃতি, জীবন পদ্ধতি, কর্মধারা, রীতি, আদর্শ ইত্যাদি।[2] শরয়ী পারিভাষিক অর্থ উল্লেখ করতে ইবনু মানযুর[3] লিখেন:

"وإذا أطلقت في الشرع فإنما يراد بها ما أمر به النبي صلى الله عليه وسلم ونهى عنه وندب إليه قولا وفعلا مما لم ينطق به الكتاب العزيز ولهذا يقال في أدلة الشرع الكتاب والسنة أي القرآن والحديث".

‘‘তবে যখন শরীয়তে সুন্নাত শব্দটি প্রয়োগ করা হয় তখন এর দ্বারা উদ্দেশ্য হয়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সব বিষয়ের আদেশ করেছেন, যে সব থেকে নিষেধ করেছেন, কথা ও কর্মের মাধ্যমে যে দিকে আহ্বান করেছেন, যা সম্মানিত কিতাব কুরআনে বলা হয় নি। এ জন্যই বলা হয়, শরীয়তের দলীল কিতাব ও সুন্নাত। অর্থাৎ হাদীস এবং কুরআন’’[4]

উসূলে ফিকহের কিতাবাদিতে সুন্নাতের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে:

" السنة في اصطلاح الأصوليين هي "ما صدر عن النبي - صلى الله عليه وسلم - غير القرآن" وهذا يشمل: قوله:- صلى الله عليه وسلم-، وفعله، وتقريره، وكتابته، وإشارته، وهمه، وتركه ". )معالم اصول الفقة عند اهل السنة والجماعة 1-118)

‘‘উসূলীদের পরিভাষায় সুন্নাত হচ্ছে, ‘‘কুরআন ছাড়া যা কিছুই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রকাশ পেয়েছে’’ এই সংজ্ঞায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা, কর্ম, স্বীকৃতি, লিখা, ইঙ্গিত, প্রতিজ্ঞা ও বর্জন সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত।’’[5]

আল্লামা শাওকানী[6] রাহ. সুন্নাতের সংজ্ঞাটি যেভাবে বর্ণনা করেন:

" وأما معناها شرعًا: أي: في اصطلاح أهل الشرع فهي: قول النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وفعله وتقريره، وتطلق بالمعنى العام على الواجب وغيره في عرف أهل اللغة والحديث، وأما في عرف أهل الفقه فإنما يطلقونها على ما ليس بواجب، وتطلق على ما يقابل البدعة كقولهم: فلان من أهل السنة ". (ارشاد الفحول الى تحقيق الحق من علم الاصول ، الفصل الاول، في معنى السنة لغة وشرعا 1-95)

‘‘শরয়ী পরিভাষায় সুন্নাতের অর্থ, অর্থাৎ শরীয়তবিদদের পরিভাষায় সুন্নাত হচ্ছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা, কাজ ও সমর্থন। ভাষাবিদ ও হাদীস বিশারদদের নিকট ব্যাপক অর্থে তা ওয়াজিব এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর প্রয়োগ করা হয়। তবে ফিক্ব্হবিদদের পরিভাষায় তারা ওয়াজিব নয় এমন বিষয়ের উপর সুন্নাতের প্রয়োগ করে থাকেন। এর বিপরীতে বিদ‘আত শব্দটি ব্যবহার হয়, যেমন বলা হয়: অমুক আহলুস্-সুন্নাহ।’’[7]

উপরের সংজ্ঞা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, ফিক্বহের পরিভাষায় সুন্নাতের একটি অর্থ, ফরয এবং ওয়াজিব ব্যতীত অন্যান্য আমল।

তবে সুন্নাতের মৌলিক অর্থ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সার্বিক জীবন আদর্শ। ফরয, ওয়াজিব ও নফল সবকিছুর উপর সুন্নাতের ব্যবহার হাদীসে প্রসিদ্ধ। মোটকথা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন আদর্শই দীন। জীবনাদর্শের বিভিন্ন দিকের গুরুত্বের তারতম্য থেকে বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা থেকে ফরয, ওয়াজিব, নফল ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। ইবাদতের মধ্যে সুন্নাতের ব্যতিক্রম মানেই দীনের মধ্যে তাহরিফ বা পরিবর্তন। দীনকে আল্লাহ তা‘আলা পরিপূর্ণ করার ঘোষণা[8] এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শই সর্বোচ্চ আদর্শ বলে ঘোষণা[9] দিয়ে দিয়েছেন। তাই কোনো ধরণের কম-বেশি, যোগ-বিয়োগ করার সুযোগ নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন যে ইবাদত যেভাবে করেছেন তা তখন সেভাবে করতে হবে। এর ব্যতিক্রম করলে তা খেলাফে সুন্নাত বলে অগ্রাহ্য হবে।

[1] বাংলাভাষীদের জন্য এ বিষয়ের উপর প্রখ্যাত আলেমে দীন ড. খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গির রচিত ‘এহ্ইয়াউস সুনান’ বইটি আমার ধারণা মতে অদ্বিতীয় এবং অতুলনীয়। সাধারণের চেয়ে আলেমদের জন্য বইটি অত্যন্ত বেশি উপকারী বলে পড়ে বুঝতে পেরেছি। বইটি পড়ে মন্তব্য করার জন্য উলামায়ে কেরামের কাছে অনুরোধ রইল। উনার প্রতিটি বই একেকটি তাজদীদি খেদমাত বলে অধমের কাছে মনে হয়েছে। আল্লাহ উনার হায়াতকে বরকতময় করে দীনের আরো বেশি খেদমাত করার সুযোগ দিন।

[2] ইবনু মানযুর, লিসানুল আরব, মাদ্দাহ: سنن , ১৩/১২৪।

[3] আরবী ভাষার বিশাল শব্দ ভান্ডার সম্বলিত বিখ্যাত অভিধান ‘লিসানুল-আরব’ এর রচয়িতা আবুল ফযল জামালুদ্দীন ইবনু মানযুর আল-আনসারী, জন্ম: ৬৩০ ওফাত: ৭১১ হিজরী, মোতাবেক: ১২৩২-১৩১১ ঈসায়ী। মূল আফ্রিক্বী বংশীয়, তবে তার জন্ম ও মৃত্যু মিশরে। (আল-আ‘লাম: ৭/১০৮।

[4] লিসানুল আরব, প্রাগুক্ত।

[5] ড. মুহাম্মদ হুসাইন ইবন হাসান, মা‘আলিমুল উসূলিল ফিক্বহী ‘ইনদা আহলিস্-সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ, দ্বিতীয় আলোচনা, সুন্নাতের সংজ্ঞা, পৃষ্টা:১১৮।

[6] মুহাম্মদ ইবন আলী ইবন মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ আশ্-শাওকানী। ১১৭৩-১২৫০ হিজরী, ১৭৬০-১৮৩৪ ঈসায়ী। ইয়ামান এর সান‘আর ফক্বীহ, মুজতাহিদ। উসূল, হাদীস, ফিক্ব্হ, তাফসীর সর্ব বিষয়ে তার পান্ডিত্য ও রচনা বিদ্যমান।

[7] আল্লামা শাওকানী, ইরশাদুল ফুহুল ইলা তাহ্ক্বীক্বিল হাক্বি মিন ইলমিল উসূল, প্রথম পরিচ্ছেদ, সুন্নাতের আভিধানিক এবং শরয়ী অর্থ, ১/৯৫।

[8] সূরা মায়েদাহ, আয়াত: ৩।

[9] সূরা আহযাব, আয়াত: ২১।