পরিবার এবং মা দিবসের ব্যাপারে ইসলামের হুকুম

আমি ‘‘নাদওয়াহ’’ নামক একটি পত্রিকায় ৩০/১১/১৩৮৪ তারিখে একটি লেখা দেখতে পেলাম, যার শিরোনাম ছিল: (মা এবং পরিবারকে সম্মান করা)। লেখক বিভিন্ন দিক দিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতা তুলে ধরে বলেছেন: বৎসরে একটি দিনকে নির্দিষ্ট করা দরকার, যেখানে মাকে সম্মান করা হবে। তিনি বলেছেন: চিন্তাবিদগণ এ দিনটি উদ্ভাবন করতে গিয়ে আরেকটি জিনিস ভুলে গেছে। সেটি হলো: এতীম অনাথ শিশুরা যখন মা দিবসে অন্যান্য শিশুদেরকে তাদের মা’দের সম্মানে আনন্দ স্ফুর্তি করতে দেখে তখন তারা মনে কষ্ট পায়, কাজেই এ দিনে গোটা পরিবারকে সম্মানের কথা বলেছেন লেখক এবং ইসলাম এ দিনটিকে ঈদ হিসাবে স্বীকৃতি না দেওয়ায় তিনি ক্ষমা চেয়েছেন, কেননা ইসলামী শরীয়ত সর্বদা মাকে সম্মান করা এবং তার সাথে সদ্ব্যবহার করা ওয়াজিব করেছে। সুতরাং মা’র সম্মানের জন্য বৎসরে কোনো একটি দিনকে নির্দিষ্ট করার প্রয়োজনীয়তা বাকী রাখে নি।

ইসলাম এ দিবসটি স্বীকৃতি না দেওয়ায় তিনি ক্ষমা চেয়ে এবং এ দিবসটি উদ্ভাবকদের অন্য একটি ভালো কাজ ভুলে যাওয়ার সমালোচনা করে ভালোই করেছেন, কিন্তু তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাব্যস্ত স্পষ্ট হাদীসের বিরোধী বিদ‘আতসমূহের দিকে যেমনি কোনো ইঙ্গিত করেননি তেমনি এর ক্ষতি, এতে কাফের ও মুশরিকদের সামঞ্জস্যতার দিকেও কোনো ইঙ্গিত করেন নি।

কাজেই আমি অতি সংক্ষেপে লেখক এবং অন্যান্যদেরকে বলতে চাই: এ বিদ‘আতসহ আরো অন্যান্য যে সকল বিদ‘আত ইসলামের শত্রুগণ এবং এ দ্বীনে বিদ‘আত প্রচলনে অজ্ঞ লোকগণ তৈরী করেছে এতে ইসলামের দুর্ণাম করেছে এবং লোকজনকে ইসলাম থেকে দূরে রেখেছে। আর এতে নারী-পুরুষের একসাথে অবাধে চলাফেরার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে তা আল্লাহ ব্যতীত কেউ বলতে পারবে না।

অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বহু সহীহ হাদীস এসেছে, যাতে তিনি দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টি করা এবং ইয়াহূদী, খৃষ্টান ও মুশরিকদের মত ইসলামের শত্রুদের সামঞ্জস্য করা থেকে সতর্ক করেছেন। যেমন তাঁর বাণী:

“যে ব্যক্তি আমার এ দ্বীনের মধ্যে নতুন কোনো জিনিস সৃষ্টি করবে যা এর অন্তর্ভুক্ত নয় তা প্রত্যাখ্যাত।”[1]

সহীহ মুসলিমে এসেছে : “যে ব্যক্তি এমন কোনো আমল করবে যা আমার শরীয়ত সমর্থিত নয় তা প্রত্যাখ্যাত।” অর্থাৎ এটি প্রবর্তকের উপর ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

এবং তিনি তাঁর জুম‘আর খুৎবায় বলতেন :

“অতঃপর সর্বোত্তম বাণী হলো: আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হেদায়েত হলো: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হেদায়েত, আর নিকৃষ্টতর কাজ হলো এর নব আবিষ্কৃত কাজ, এবং প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।”[2]

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, মাকে বা পরিবারকে সম্মান করার জন্য বৎসরে একটি দিনকে নির্দিষ্ট করা নব আবিষ্কৃত কাজের অন্তর্ভুক্ত; যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেন নি এবং তাঁর কোনো সাহাবীও করেননি, সুতরাং তা পরিহার করে এ থেকে সতর্ক থাকা এবং আল্লাহ ও তার রাসূল যা শরিয়ত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা ওয়াজিব।

আর লেখক পূর্বে যে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ইসলামী শরীয়ত সর্বদা মাকে সম্মান করার বিধান করেছে এবং তার সাথে সদ্যবহারের জন্য উৎসাহ দিয়েছে, তা সত্য বলেছেন। কাজেই মাকে সম্মান করা, তার সাথে সদ্ব্যবহার করা, তার প্রতি অনুগ্রহ করা এবং তার কথা শোনার ব্যাপারে আল্লাহ যা বিধান করেছেন তার উপরই সীমাবদ্ধ থাকা মুসলিমদের উপর ওয়াজিব। আর দ্বীনে নব কাজের উদ্ভাবন করা যা থেকে আল্লাহ সতর্ক করেছেন তা এবং ইসলামের শত্রুদের সামঞ্জস্যতা, তাদের পথে চলা এবং তাদের চিন্তাধারায় যা ভালো কাজ তা ভালো মনে করাই বিদ‘আত।

এ সম্মান শুধু মা’র জন্য নয় বরং মা-বাবা উভয়কে সম্মান করা, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করা এবং সার্বিক দিক দিয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য ইসলাম বিধান করেছে, সেই সাথে তাদের অবাধ্যতা, তাদের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা থেকে সতর্ক করার সাথে সাথে মা’র হক্ব আদায়ের ব্যাপারে ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। কেননা মা সন্তানকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন এবং সন্তানকে গর্ভে ধারণ করা, দুধ পান করান এবং লালন পালনের ক্ষেত্রে অধিক কষ্ট করে থাকেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿۞وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنًاۚ﴾ [الاسراء: ٢٣]

“আর তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন যে, একমাত্র তারই ইবাদত কর এবং মা-বাবার প্রতি অনুগ্রহ কর।” [সূরা ইসরা/২৩]

তিনি আরও বলেন:

﴿ وَوَصَّيۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ بِوَٰلِدَيۡهِ حَمَلَتۡهُ أُمُّهُۥ وَهۡنًا عَلَىٰ وَهۡنٖ وَفِصَٰلُهُۥ فِي عَامَيۡنِ أَنِ ٱشۡكُرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيۡكَ إِلَيَّ ٱلۡمَصِيرُ ١٤ ﴾ [لقمان: ١٤]

“আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্টবরণ করে গর্ভে ধারণ করা এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট।” [সূরা লোকমান/১৪]

তিনি আরও বলেন:

﴿فَهَلۡ عَسَيۡتُمۡ إِن تَوَلَّيۡتُمۡ أَن تُفۡسِدُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَتُقَطِّعُوٓاْ أَرۡحَامَكُمۡ ٢٢ ﴾ [محمد: ٢٢]

“ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সম্ভবত: তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে।” [সূরা মুহাম্মদ/২২]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ সনদে এসেছে, তিনি বলেছেন,

«أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الكَبَائِرِ؟» ثَلاَثًا، قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَالَ: «الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ، وَعُقُوقُ الوَالِدَيْنِ - وَجَلَسَ وَكَانَ مُتَّكِئًا فَقَالَ - أَلاَ وَقَوْلُ الزُّورِ»

“আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় পাপ সম্পর্কে বলব না? একথা তিনি তিনবার বললেন। তারা বললেন হ্যাঁ, বলুন ইয়া রাসূলাল্লাহ, তিনি বললেন: আল্লাহর সাথে শির্ক করা এবং মা-বাবার অবাধ্য হওয়া, তিনি হেলান দিয়ে বসা ছিলেন অতঃপর সোজা হয়ে বসে বললেন: খবরদার! মিথ্যা বলা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।”[3]

এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞাসা করে বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমার নিকট থেকে ভালো ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে যোগ্য কে?

তিনি বললেন: তোমার মা

সে বলল: তারপর কে?

তিনি বললেন: তোমার মা

সে বলল: তারপর কে?

তিনি বললেন: তোমার মা

সে বলল: তারপর কে?

তিনি বললেন: তোমার বাবা। অতঃপর তোমার নিকটতম প্রতিবেশী তারপর তোমার নিকটতম।”[4]

তিনি আরও বললেন: “আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।”[5]

তাঁর নিকট থেকে সহীহ সনদে আরও এসেছে যে, তিনি বলেছেন: “যে ব্যক্তি তার রিযিক বৃদ্ধি এবং বয়স বাড়াতে ভালোবাসে সে যেন আত্মীয়তা সম্পর্ক বজায় রাখে।”[6]

মাতা-পিতার সাথে সদ্যবহার, আত্মীয়তা সম্পর্ক বজায় রাখা এবং মা’র হক্বের অধিক গুরুত্বের ব্যাপারে বহু আয়াত এবং হাদীস রয়েছে। উপরে যেগুলো উল্লেখ করেছি আশা করি তাই যথেষ্ট। যে ব্যক্তি তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবে সে ব্যক্তি স্পষ্ট প্রমাণ পাবে যে, সর্বদা মাতা-পিতার প্রতি সম্মান, তাদের প্রতি অনুগ্রহ এবং সকল আত্মীয়ের প্রতি অনুগ্রহ করা ওয়াজিব এবং তাদের অবাধ্য হওয়া ও আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করা সবচেয়ে দূষনীয় এবং কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত যা আল্লাহকে রাগান্বিত করা ও জাহান্নামে যাওয়া বাধ্য করে। আল্লাহর নিকট এ থেকে আশ্রয় চাই। পাশ্চাত্য সভ্যতা মা’কে সম্মানের জন্য বৎসরে একটি দিনকে নির্দিষ্ট করে বাকী দিনগুলোতে অবহেলা করাসহ বাবা এবং প্রতিবেশীদেরকে যে অবহেলা করে এর চেয়ে ইসলামী সভ্যতা বহুগুণে ভালো।

জ্ঞানীদের অজানা নয় যে, এতে মহা ফেৎনা ফাসাদ সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহর বিধানেরও পরিপন্থী এবং তা রাসূলের সতর্ক করা কাজে পতিত হওয়া ওয়াজিব করে। এগুলো দিনকে নির্দিষ্ট করা এবং লোকদের জন্মোৎসব পালন, স্বাধীনতা দিবস, ক্ষমতা দখল ইত্যাদি ইত্যাদি দিবস পালনেরই অন্তর্ভুক্ত। এ সকল কার্যকলাপ সবই নব আবিষ্কৃত কাজ যাতে মুসলিগণ আল্লাহর শত্রু বিধর্মীদের অন্ধ অনুসরণ করে চলেছে। পক্ষান্তরে শরিয়তের সতর্ক করা এবং নিষিদ্ধ করা কাজ থেকে গাফেল হয়ে আছে। এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে সাব্যস্ত সহীহ হাদীসের বাস্তবায়ন যে তিনি বলেছেন: অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের হুবহু অনুকরণ করবে, এমন কি তারা যদি ষাণ্ডার গর্তে প্রবেশ করে তাহলে অবশ্যই তোমরাও সেখানে প্রবেশ করবে। সাহাবায়ে কেরাম বলল: হে আল্লাহর রাসূল, তারা কি ইয়াহূদী ও খৃষ্টান? তিনি বললেন: তবে আর কে? অন্য শব্দে এসেছে: আমার উম্মত পূর্ববর্তী উম্মতের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে বিঘতে বিঘতে এবং হাতে হাতে। তারা বলল: হে আল্লাহর রাসূল, তারা কি পারস্য এবং রুম? তিনি বললেন তাহলে আর কে? অর্থাৎ তারাই।রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ উম্মতের পূর্ববর্তী উম্মত ইয়াহূদী, খৃষ্টান, অগ্নিপুজক, কাফের ইত্যাদি জাতির চরিত্র এবং কাজ কর্মের অনুসরণের ব্যাপারে যা বলেছেন তাই হয়েছে, এমন কি ইসলাম একেবারে সংখ্যালগু হয়ে গেছে। আর কাফেরদের রীতি, তাদের চরিত্র এবং কাজকর্ম বহুলোকদের নিকট ইসলামের কাজকর্ম থেকে ভালো মনে হচ্ছে, শুধু তাই নয় বরং সৎকর্মগুলো মন্দ এবং মন্দগুলো সৎকর্ম, বিদ‘আতগুলো সুন্নাত আর সুন্নাতগুলো বিদ‘আত হিসাবে অনেকের নিকট পরিচিতি লাভ করেছে। এর কারণ হলো অজ্ঞতা এবং ইসলামের সুন্দর চরিত্র ও সৎকর্মগুলো পরিহার করা। ইন্নালিল্লাহি অ-ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন সকল মুসলিমকে দ্বীন বুঝার মাধ্যমে তাদের অবস্থাগুলো ঠিক করে নেয়ার তাওফীক দান করেন, তাদের নেতাদেরকে যেন সঠিক রাস্তা দেখান, এবং আমাদের আলেম ও লেখকদেরকে যেন দ্বীনের শিষ্টাচারিতা তুলে ধরার সাথে সাথে বিদ‘আত এবং সকল প্রকার নব আবিষ্কৃত যা ইসলামের দুর্ণাম করে এবং লোকজনকে ইসলাম থেকে দূরে রাখে তা থেকে সতর্ক করে দেওয়ার তাওফীক দান করেন। নিশ্চয়ই তিনি প্রতিটি জিনিসের উপর ক্ষমতাবান। সালাত ও সালাম হোক আল্লাহর বান্দা ও রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ উপর, তাঁর পরিবার, সকল সাহাবী এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা তাদের পথে চলবে ও তাদের অনুসরণ করবে তাদের উপর।

>
[1] বুখারী ও মুসলিম।

[2] সহীহ মুসলিম।

[3] সহীহ বুখারী হাদীস নং ২৬৫৪; সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৮৭।

[4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৯৭১, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৪৮।

[5] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৯৮৪, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৫৬।

[6] সহীহ বুখারী; হাদীস নং ৫৯৮৬, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৫৭।