(এক) জেহরী ও সের্রী কোন ছালাতেই ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া যাবে না। দলীল হিসাবে নিম্নের আয়াত ও কিছু হাদীছ পেশ করা হয়।

অপব্যাখ্যা ও তার জবাব :

(এক) জেহরী ও সের্রী কোন ছালাতেই ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া যাবে না। দলীল হিসাবে নিম্নের আয়াত ও কিছু হাদীছ পেশ করা হয়।

(ক) আল্লাহ বলেন, وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوْا لَهُ وَأَنْصِتُوْا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ ‘আর যখন কুরআন তেলাওয়াত করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর এবং চুপ থাক। তোমাদের উপর রহম করা হবে’ (আ‘রাফ ২০৪)। আরো বলা হয় যে, ছালাতে কুরআন পাঠ করার বিরুদ্ধেই উক্ত আয়াত নাযিল হয়।

পর্যালোচনা: মূলতঃ উক্ত আয়াতে তাদের কোন দলীল নেই। বরং তারা অপব্যাখ্যা করে এর হুকুম লংঘন করে থাকে। কারণ কুরআন পাঠ করার সময় চুপ থেকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে বলা হয়েছে। কিন্তু যোহর ও আছরের ছালাতে এবং মাগরিবের শেষ রাক‘আতে ও এশার শেষ দুই রাক‘আতে ইমাম কুরআন পাঠ করেন না। অথচ তখনও তারা সূরা ফাতিহা পাঠ করে না।

দ্বিতীয়তঃ সূরা ফাতিহা উক্ত হুকুমের অন্তর্ভুক্ত নয়। তাই উক্ত আয়াতের আমল বিদ্যমান। কারণ সূরা ফাতিহার পর ইমাম যা-ই তেলাওয়াত করুন মুক্তাদী তার সাথে পাঠ করে না, যদি ইমাম ছোট্ট কোন সূরাও পাঠ করেন। বরং মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করে থাকে। তাছাড়া উক্ত আয়াত নাযিল হয়েছে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর। আর তিনিই সূরা ফাতিহাকে এর হুকুম থেকে পৃথক করেছেন এবং চুপে চুপে পাঠ করতে বলেছেন।[1] আর এটা আল্লাহর নির্দেশেই হয়েছে।[2] এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সামনে রয়েছে। উল্লেখ্য যে, উক্ত আয়াতের হুকুম ব্যাপক। সর্বাবস্থায় কুরআন তেলাওয়াত মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।[3]

তাছাড়া আল্লাহ তা‘আলাও সূরা ফাতিহাকে কুরআন থেকে পৃথক করে উল্লেখ করেছেন। রাসূল (ছাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন, وَلَقَدْ آَتَيْنَاكَ سَبْعًا مِنَ الْمَثَانِي وَالْقُرْآَنَ الْعَظِيْمَ ‘আমি আপনাকে মাছানী থেকে সাতটি আয়াত এবং মহান গ্রন্থ আল-কুরআন দান করেছি’ (সূরা হিজর ৮৭)। সুতরাং সূরা ফাতিহা ও কুরআন পৃথক বিষয়। যেমন ভূমিকা মূল গ্রন্থ থেকে পৃথক। এটি কুরআনের ভূমিকা। ভূমিকা যেমন একটি গ্রন্থের অধ্যায় হতে পারে কিন্তু মূল অংশের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। তেমনি সূরা ফাতিহা কুরআনের ভূমিকা। আর ‘ফাতিহা’ অর্থও ভূমিকা। অতএব ক্বিরাআত বলতে সূরা ফাতিহা নয়। যেমন ইমাম বুখারী (রহঃ) পরিষ্কারভাবে দাবী করেছেন।[4] অনুরূপ ইবনুল মুনযিরও বলেছেন।[5]

(খ) যোহর ও আছরের ছালাতে সূরা ফাতিহা না পড়ার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলা হয়, ইমামের আগেই যদি মুক্তাদীর ক্বিরাআত পড়া হয়ে যায়, তাহলে ইমামের অনুসরণ করা হবে না। তাছাড়া ‘মাযহাব বিরোধীদের স্বরূপ সন্ধানে’ বইয়ে কোন প্রমাণ ছাড়াই জোরপূর্বক লেখা হয়েছে, فَاسْتَمِعُوْا لَهُ وَأَنْصِتُوْا ‘শব্দ দুটি সুস্পষ্টভাবে একথার প্রমাণ করে যে, যদি ইমাম উচ্চ আওয়াজে কিরাত পড়ে তাহলে মুক্তাদীর কর্তব্য হচ্ছে, সে মনোযোগের সাথে উক্ত কিরাত শ্রবণ করবে। আর (দ্বিতীয় শব্দটি অর্থাৎ وَأَنْصِتُوْا (নীরব থাকবে) বলার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে,) যদি ইমাম নিম্ন আওয়াজেও কিরাত পড়ে তাহলেও মুক্তাগীন (মুক্তাদীগণ) নীরবই থাকবে, কিছুই পড়বে না’।[6]

পর্যালোচনা : সুধী পাঠক! পবিত্র কুরআনের আয়াতটির কিভাবে উদ্ভট ব্যাখ্যা দেয়া হল তা কি লক্ষ্য করেছেন? মনে হল, আয়াতটা লেখকের উপরই নাযিল হয়েছে। তা না হলে এভাবে কেউ ব্যাখ্য দিতে পারেন? যেখানে শর্ত করা হয়েছে, কুরআন যখন তেলাওয়াত করা হবে তখন মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে এবং চুপ থাকতে হবে। এর মধ্যে কিভাবে যোহর ও আছর ছালাত অন্তর্ভুক্ত হল? মূল কারণ হল, এই অপব্যাখ্যা ছাড়া তাদের জন্য অন্য কোন উপায় নেই। অথচ যোহর ও আছর ছালাতে মুক্তাদীরা সূরা ফাতিহা তো পড়বেই তার সাথে অন্য সূরাও পড়তে পারে। উক্ত মর্মে ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ كُنَّا نَقْرَأُ فِى الظُّهْرِ وَالْعَصْرِ خَلْفَ الإِمَامِ فِى الرَّكْعَتَيْنِ الأُولَيَيْنِ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ وَسُوْرَةٍ وَفِى الأُخْرَيَيْنِ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ.

জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, আমরা যোহর ও আছর ছালাতে প্রথম দুই রাক‘আতে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পাঠ করতাম। আর পরের দুই রাক‘আতে শুধু সূরা ফাতিহা পাঠ করতাম।[7]

ইমামের অনুসরণের যে দাবী করা হয়েছে, তাও অযৌক্তিক। কারণ রুকূ, সিজদা, তাশাহ্হুদ, দরূদ, দু‘আ মাছূরাহ সবই ইমাম-মুক্তাদী উভয়ে প্রত্যেক ছালাতে পড়ে থাকে। সে ব্যাপারে কখনো প্রশ্ন আসে না যে, ইমাম আগে পড়লেন, না মুক্তাদী আগে পড়লেন। সমস্যা শুধু সূরা ফাতিহার ক্ষেত্রে। আরো দুঃখজনক হল, ফজর, মাগরিব কিংবা এশার ছালাতের ক্বিরাআত চলাকালীন একজন মুক্তাদী ছালাতে শরীক হয়ে প্রথমে নিয়ত বলে, তারপর জায়নামাযের দু‘আ পড়ে অতঃপর তাকবীর দিয়ে ছানা পড়ে থাকে। অথচ সূরা ফাতিহা পাঠ করে না। তাহলে সূরা ফাতিহা কী অপরাধ করল? ক্বিরাআত অবস্থায় যদি সূরা ফাতিহা না পড়া যায় তাহলে উদ্ভট নিয়ত, জায়নামাযের ভিত্তিহীন দু‘আ ও ছানা পড়ার দলীল কোথায় পাওয়া গেল? অতএব যারা কোন ছালাতেই, কোন রাক‘আতেই সূরা ফাতিহা পড়া জায়েয মনে করে না, তাদের জন্য উক্ত আয়াতে কোন দলীল নেই। তাদের দাবী কল্পনাপ্রসূত, উদ্ভট, মনগড়া ও অযৌক্তিক।


নোটঃ সুতরাং সূরা ফাতিহা ও কুরআন পৃথক বিষয়। যেমন ভূমিকা মূল গ্রন্থ থেকে পৃথক। এটি কুরআনের ভূমিকা। ভূমিকা যেমন একটি গ্রন্থের অধ্যায় হতে পারে কিন্তু মূল অংশের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না।  - এই কথাটি মোটেও সঠিক নয়, বরং সূরা ফাতিহা অবশ্যই কুরআনের অংশ (এডমিন, হাদিসবিডি)

[1]. ছহীহ ইবনে হিববান হা/১৮৪১, তাহক্বীক্ব আলবানী, সনদ ছহীহ লিগায়রিহী; মুসনাদে আবী ইয়ালা হা/২৮০৫। মুহাক্কিক হুসাইন সালীম আসাদ বলেন, এর সনদ জাইয়িদ।
[2]. নাজম ৩-৪; আবুদাঊদ হা/১৪৫।
[3]. মির‘আতুল মাফাতীহ ৩/১২৫ পৃঃ।
[4]. বুখারী, আল-ক্বিরাআতু খালফাল ইমাম, পৃঃ ২০-فلو ثبت الخبران كلاهما لكان هذا مستثنى من الأول لقوله لا يقرأن إلا بأم الكتاب وقوله من كان له إمام فقراءة الإمام له قراءة جملة وقوله إلا بأم القرآن مستثنى من الجملة كقول النبي صلى الله عليه وسلم جعلت لي الأرض مسجدا وطهورا ثم قال في أحاديث أخرى إلا المقبرة وما استثناه من الأرض والمستثنى خارج من الجملة وكذلك فاتحة الكتاب خارج من قوله من كان له إمام فقراءة الإمام له قراءة مع انقطاعه.।

[5]. ইবনুল মুনযির, আল-আওসাত্ব ৪/২২৪ পৃঃ হা/১২৭১-এর আলোচনা দ্রঃ- خاص واقع على ما سوى فاتحة الكتاب وكذلك تأويل قوله وإذا قرأ فأنصتوا بعد قراءة فاتحة الكتاب واحتج بعضهم بحديث عبادة وبأخبار رويت عن الصحابة।

[6]. ঐ, পৃঃ ২৬০-২৬১।
[7]. ইবনু মাজাহ হা/৮৪৩, পৃঃ ৬১; সনদ ছহীহ, আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/৫০৬।