‘প্রতিবেশির’ নির্লজ্জতায় অনলে গা পোড়ে প্রতিবেশির - ১

আকাশ-সংস্কৃতি কি আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে? নৈতিকতাভিত্তিক যে চরিত্র গঠনের আবেদন আমরা জানাই, যে আন্দোলন করি, যে অনুশীলন আমরা সাধ্যমত করছি, এই চরিত্রের সঙ্গে আকাশ সংস্কৃতি কি সাংঘর্ষিক, না সহযোগী?

আকাশ-সংস্কৃতি কী? আকাশের তো কোনো সংস্কৃতি পয়দা হয় না। তবে হ্যাঁ আকাশ পথে সব সংস্কৃতির বেসাতি চলে, আমদানি-রপ্তানি হয়, ক্রয়-বিক্রয় হয় তাই টোটাল সওদাকে আমরা বলতে পারি আকশ-সংস্কৃতি। আপনি আমি এটাকে সংস্কৃতি বলি আর নাই বলি, বাজারে এটাই সংস্কৃতি নামে পরিচিত। আকাশ থেকে এ পর্যন্ত একটি তারকাও খসে পড়েনি, তবুও সিনেমা জগতে, ফুটবল জগতে, ক্রিকেট জগতে, এমনকি পরীক্ষার ফলাফল সিটে হাজার হাজার তারকার ভীড়। এসবের কোন কোনটির পেছনেও আকাশ-সংস্কৃতির ভূমিকা রয়েছে।

আকাশ-সংস্কৃতির কারবারটা জানতে হলে কি আকাশ ঘুরে আসতে হয়? আসলে আকাশের ঠিকানা আমরা জানি না, বিজ্ঞানীরাও জানে না। তবে আকাশের ঠিকানা জানা না জানার প্রশ্ন পরের কথা, দুনিয়া থেকে যদি আখেরাতের সওদা আহরণ করা যায়, তাহলে জমিনে বাস করে আকাশের খবর কেন জানা যাবে না? আকাশের আলোচনায় আসার আগে দুনিয়ার কিছু খবরাখবর আমাদের জানা দরকার। আকাশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগে আমাদের নিয়ত ও আত্মপরিচয় কী সে সম্পর্কে কিছু বলার ও জানার আছে। আল্লাহ আমাদের কেন দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তা জানা থাকা দরকার। এসব না জানলে, মনোবল সেভাবে গড়তে না পারলে এবং আকাশ শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করার ঈমানী হিম্মত নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করতে না পারলে আকাশ সংস্কৃতির ভাইরাসরা আমাদের চারদিকে ঘিরে ফেলবে। এখনই ঘেরাও এর মধ্যে আছি। এজন্য দুনিয়াতে আমাদের আগমন ও জীবনযাপন আর প্রস্থান সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। নিজেকে চিনলে, নিজেকে জানলে আল্লাহকে চেনা যায়, জানা যায়। এবং তখন যে কোনো যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া যায়।

আমরা দুনিয়াতে বাস করি। এই দুনিয়াতে আমাদের প্রেরণ কি স্রষ্টার নিছক খেয়ালমাত্র? আল্লাহ বলেন,

﴿ أَفَحَسِبۡتُمۡ أَنَّمَا خَلَقۡنَٰكُمۡ عَبَثٗا وَأَنَّكُمۡ إِلَيۡنَا لَا تُرۡجَعُونَ ١١٥ ﴾ [المؤمنون: ١١٥]

‘তোমরা কি মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে কেবল অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে না?’ (সূরা আল-মু’মিনূন, আয়াত : ১১৫)

না তা নয়। খেলাচ্ছলে বা নিছক খেয়ালে আল্লাহ কিছুই করেন না। যদিও একক ক্ষমতা শুধু তারই আছে, হও বললেই হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,

﴿ إِنَّمَآ أَمۡرُهُۥٓ إِذَآ أَرَادَ شَيۡ‍ًٔا أَن يَقُولَ لَهُۥ كُن فَيَكُونُ ٨٢ ﴾ [يس: ٨٢]

‘তাঁর ব্যাপার শুধু এই যে, কোন কিছুকে তিনি যদি ‘হও’ বলতে চান, তখনই তা হয়ে যায়।’ (সূরা ইয়াসীন, আয়াত : ৮২)

এমন শক্তিধর সর্বশক্তিমান যিনি, তাঁর তো খলীফা প্রেরণের প্রয়োজন নেই। তবুও তিনি মানবজাতিকে তার খলীফা হিসেবে প্রেরণ করেছেন মানবজাতির মধ্যে জবাবদিহিতা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য। জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্য। আল্লাহ বলেন,

﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ ﴾ [الذاريات: ٥٦]

‘আর আমি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ইবাদাত করবে।’ (সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত : ৫৬)

ইবাদত কী? ইবাদত হচ্ছে, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে তার দেয়া জীবন বিধান অনুয়ায়ী জীবনযাপন করা। কিভাবে জীবনযাপন করতে হবে এজন্য কওমের কাছে প্রতি জনপদে নবী-রাসূল এসেছেন। অনেকে তার আদেশ নিষেধ শুনেছে আবার অনেকে শুনেনি। প্রেরিত গাইডকে নির্যাতিত করেছে, গাইড বুকও ধ্বংস করেছে। তাই তাদের এখন নৈতিক কোনো বোধই নেই। যা ছিল তা অবক্ষয়ে অবক্ষয়ে শেষ গেছে।

যে নৈতিকবোধ তারা নানাভাবে প্রদর্শন করে নিজেদের নীতিবান বলে বিশ্ববাসীর কাছে জাহির করছে, তা কৃত্রিম, নিজেদের মনগড়া নৈতিকতা। তারা-কাপড় পরিধান করেও থাকে দিগম্বর। সুন্দর সুন্দর জামা-কাপড় পরিধান করে বটে, সুন্দর সুন্দর সংলাপে শ্রোতাকে তারা মুগ্ধও করে। কারণ নৈতিকতার কুদরতী সীমানা আর মানুষের তৈরি সীমানার মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক। কুদরতী হুকুমের কোনো তোয়াক্কা তারা করেনি। ফলে শয়তানের সঙ্গে মিতালী করে এমন এক নৈতিকতা সৃষ্টি করে রেখেছে, যা অনৈতিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। নানা দিকে অবক্ষয়ের ঢল ও ধস। এমন এক পর্যায়ে অবক্ষয়ের সর্বশেষ স্তরে এবং সময়ের এই সন্ধিক্ষণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর মূল মিশন কী ছিল লক্ষ্যহীন ঠিকানাবিহীন এবং বিগত নবী-রাসূলদের শিক্ষা ও আদর্শ ভুলে যাওয়া মানবজাতির বংশধরদের বিস্মৃত সবক-পাঠ স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং সর্বক্ষেত্রে জাহিলিয়াতের যে অবক্ষয় নেমেছিল তা প্রতিহত করে চরিত্রবান জাতি হিসেবে গড়ে তোলা। আল্লাহ বলেন,

﴿ إِنَّآ أَرۡسَلۡنَٰكَ بِٱلۡحَقِّ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗاۚ وَإِن مِّنۡ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٞ ٢٤ ﴾ [فاطر: ٢٤]

‘আমি তোমাকে সত্যসহ পাঠিয়েছি সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারীরূপে; আর এমন কোন জাতি নেই যার কাছে সতর্ককারী আসেনি।’ (সূরা ফাতির, আয়াত : ২৪)

সংস্কৃতি একটি জাতিকে প্রভাবিত করার অতুলনীয় মাধ্যম। তবে তার ব্যবহার হওয়া চাই যথার্থ। কেননা ব্যক্তি ও সত্তার প্রভাবে সংস্কৃতির ক্রিয়া ও প্রভাব ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে বাধ্য। সুতরাং বলা যায় নাস্তিক, মুরতাদ আর সেক্যুলারিস্টদের ‘মূল্যবোধ, নৈতিকতা আর অবক্ষয়ের’ সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যার সঙ্গে তাওহীদে বিশ্বাসীদের সংজ্ঞা ব্যাখ্যার মিল নেই।

কোন পথে চললে কোন ঠিকানায় আমাকে পৌঁছাবে, কোন পথের বাঁকে বাঁকে এবং মোড়ে মোড়ে কে কে আছে এবং কেন আছে তাও জানা হয়ে গেছে। অতএব নাস্তিকের নৈতিকতা ও সংস্কৃতি আমার জন্য অনৈতিকতা ও অপসংস্কৃতি হওয়ারই স্বাভাবিক ও সঙ্গত।

‘আকাশ সংস্কৃতি’ খুব লম্বা চওড়া বিষয় নয়, তবে এর আগে অথৈ আকাশ সংস্কৃতির সঙ্গে লড়াইয়ের আগে জেনে নিতে হবে আমরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত কি না, আমরা যে অস্ত্র নিয়ে লড়াই করবো তা লড়াই উপযোগী কিনা? আর এ লড়াইয়ের ব্যাপারে আমাদের ধ্যান-ধারণা পরিষ্কার কিনা। ধারণাটা পরিষ্কার করা হয় না বলে আমাদের অনেক আবেগী লোক জোশ ও জেদের বশবর্তী হয়ে পাল্টা কিছু করতে চান এবং কিছু কিছু করেও দেখেছেন। না ওকুল পেয়েছে না একুল পেয়েছেন। ওরা ফ্যাশন শো করে, আমরাও করে দেখি না আমাদের মতো করে! করে দেখা গেল বাজার পাওয়া গেল না!

মহিলাদের রূপ প্রদর্শনই যখন ইসলামে নিষিদ্ধ, তখন ফ্যাশন দেশটায় কীভাবে বাজার পায়? নিতান্ত সাংঘর্ষিক। ফ্যাশন শো ইসলাম বিলাসিতা মনে করে, তাও আবার নারীর ফ্যাশন, মানে পুরুষকে প্রদর্শন? এভাবে উদাহরণ দিলে অনেক দেয়া যায়। মিসরে একবার জামাল আব্দুন নাসেরের সময় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ নামে নৃত্য (নাউযুবিল্লাহ) বানানো যায় কিনা- এমন এক কসরত শুরু হয়েছিল, কিন্তু শুরুতেই এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ। সন্ত্রাসের পাল্টা সন্ত্রাস, বোমাবাজির পরিবর্তে বোমাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ আর খুনের বদলা ছিনতাই অপহরণ আর খুন, গালির বদলে গালি, ইসলাম তা কখনও সমর্থন করে না।

তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য ন্যায়ের অস্ত্র বহুমুখী ব্যবহারের এস্তেমাল ইসলাম সমর্থন করে। এতটুকুই শুধু বলা যায়, এর অধিক বলার অবকাশ এখানে নেই। ওরা ক্রুসেডের ডাক দিলেও আমরা জিহাদের ডাক দিতে পারছি না নানাবিধ কারণে। কৃষ্টি-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অপরিচ্ছন্ন ধারণা, অস্পষ্টতা আর ভুল বোঝাবুঝি প্রচুর। ওদের এই আছে, হরেক রকম সংস্কৃতির উপকরণ আছে, তাদের মুকাবিলায় আমাদের কিছু থাকা দরকার। কিন্তু তাই বলে সবকিছুর জবাব একই ভাষায় দিতে হবে? ওদের সমাজে পিতৃপরিচয়হীন সন্তান কিলবিল করছে, লাখ লাখ সমকামীদের উৎপাদন চাই? আমরাও কি তবে সেই কালচারের পৃষ্ঠপোষকতা করব? অন্যের বাবা দেখতে যত সুন্দর হোক তাকে আমি বাবা বলি না, সাফ বিভাজন। আমার সংস্কৃতি আমার বটে। কিন্তু আমার ঈমানের বলয়ের বিপরীত বলয়ের সংস্কৃতি কখনোই আমার হতে পারে না। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওই বাণীই আজ বাস্তবে পরিণত হতে দেখছি। আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ، وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ، حَتَّى لَوْ سَلَكُوا جُحْرَ ضَبٍّ لَسَلَكْتُمُوهُ»، قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ: اليَهُودَ، وَالنَّصَارَى قَالَ: «فَمَنْ»

‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনুসারী হবে। হাত হাত ও বিঘত বিঘত তথা হুবহু এবং অবিকলভাবে।এমনকি তারা যদিকোনোগুইসাপের গর্তেঢুকে পড়ে তাহলে তোমরাও তাতে ঢুকে পড়বে। আমরা (সাহাবায়ে কেরাম) বললাম, হে আল্লাহর রাসূল!তারাকি ইহুদী ও খ্রিস্টন? তিনি বললেন,তারানয় তো আর কারা? [বুখারী : ৩৪৫৬; মুসলিম : ২৬৬৯]

যে বিজাতির অনুসরণ করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ»

‘যে কোনো জাতির সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল হবে সে তাদের গোত্রভুক্ত বলেই গণ্য হবে।’ [আবূ দাউদ, সুনান : ৪০৩১]

আমার কৃষ্টি বা কালচার বা সংস্কৃতির কী বুঝে তারা, এতে যাদের ঈমান ও বিশ্বাস নেই? ড. মরিস বুকাইলী বাদশাহ ফয়সালকে জানিয়েছিলেন আমি ইতিবাচক নিয়তেই বলছি, ইসলামের ওপর গবেষণা করবো। স্বল্পভাষী বাদশাহ ফয়সাল স্মিত হাসি দিয়ে বলেছিলেন খুব ভালো, তাই যদি করতে চান তাহলে আগে পবিত্র কুরআনকে কুরআনের ভাষায় পাঠ করতে শিখুন অর্থ বুঝুন আরবি ভাষা শিখুন। মুরিস বুকাইলি সে উপদেশ মতো পবিত্র কুরআন স্টাডি করেছিলেন এবং ইসলাম বুঝেছিলেন। এরই ফলে তিনি অমর কয়েকটি গ্রন্থ বিশ্ববাসীকে উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সুতরাং আমার বলয়ের সংস্কৃতিও আমাকে লালন করতে হবে এবং অন্যকেও পারলে এই সংস্কৃতির বলয়ে আনতে হবে। কিন্তু আমি কখনই অন্যের সংস্কৃতি আমদানি করে নিজের ঘর নষ্ট করতে চাই না।

আসল কথা হলো, নিজেদের পরিচয়ের স্বচ্ছতা থাকতে হবে। তাহলে আকাশ-সংস্কৃতির কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ তা বাছাই করা যাবে। আপনার আমার কাছে যদি ঈমানের চালনী না থাকে, ঈমানের নজর না থাকে, ঈমানের মনটা না থাকে তাহলে আকাশ-সংস্কৃতির ভালোমন্দ কিছুই পরখ করা যাবে না। যে দেহে রোগ প্রতিরোধ শক্তি প্রবল সে দেহে সহজে কোনো রোগ-জীবাণু প্রবেশ করতে পারে না। আকাশ-সংস্কৃতির যত ভয়ঙ্কর ভাইরাস আছে, এসব সংস্কৃতির অনিষ্টকারিতার প্রতিরোধে আমাদের সংস্কৃতি অক্ষম, যদি নিজস্ব সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে সে চেষ্টা সাধনা না থাকে। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, কালচার আর সংস্কৃতি এক নয়, যা কালচার তা সংস্কৃতি নাও হতে পারে। হাঁটার কালচার একজন হিন্দু ও একজন মুসলমানের এক, কিন্তু দু’জনের প্রার্থনা ও ‌ইবাদতের কালচার ও সংস্কৃতি এক নয়।

এক কথায় মুসলিমরা সব কালচারকে তাদের ঈমানী সংস্কারের কষ্টিপাথরে বাছাই করে যা গ্রহণ করে তা মুসলসমানদের সংস্কৃতি। সকল ধর্ম যেমন এক নয়, সকল ধর্মাবলম্বীদের সংস্কৃতিও এক নয়। প্রত্যেক ধর্মাম্বলবীদের কাছে সংস্কৃতি নির্ণয়ের কষ্টিপাথরও নেই। আর নেই বলেই যা চকমক করে ঝকমক করে, তাকেই সংস্কৃতির সোনা বলে। যেমন আশ্চর্য কিছু দেখলেই পূজোয় লেগে যায়, গাছ, বাঁশ, সাপ, পাথর, সূর্যকে এমনকি বট গাছকেও অলৌকিকতায় মণ্ডিত করে পূজো করে।

বর্তমানে আকাশ-সংস্কৃতির বড্ড জোর। বিশ্বের প্রত্যেক দেশ এই সংস্কৃতির হাওয়ায় ভাসছে। তরুণরা আবেগে থরথর করে কাঁপছে। আকাশ-সংস্কৃতির সওদা সিডি ও ক্যাসেট আকারে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দোকানে ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। এসব সওদার মূল্য অতি কম কিন্তু মুগ্ধ করার, সম্মোহিত করার আছর থাকে বেশি। ঘরে ঘরে টিভি ও অন্যান্য যন্ত্র প্রবেশ করছে। পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন চ্যানেলের নাম প্র্রোগ্রাম রোজ ছাপা হয়। দিনরাতের প্রতিটি মুহূর্তে চিত্তকে বিনোদিত করার ব্যবস্থা আছে। বিনোদনের কি আইটেম আপনার চাই? হাতের কাছে রিমোট কন্ট্রোল মেশিন আছে। বোতাম টিপতে থাকুন একটার পর একটা। পশ্চিমাদের বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে সংস্কৃতি নামের বিভিন্ন অপসংস্কৃতি তৈরি করে বিশ্বময় রপ্তানি করছে, কেউ কেউ আমদানিও করছেন। যত অশ্লীলতা আছে, কুৎসিতদের জন্য কুৎসিত বিনোদন আছে সবই সরবরাহ করছে সিডিতে বন্দি করেও। ভারত ও পশ্চিমাদের ফ্যাক্টরিগুলোতে আকাশ সংস্কৃতি বিভিন্ন আইটেম তৈরি করে।

গত শতাব্দীর আশির দশকে বিভিন্ন কারণে লাতিন আমেরিকার প্রত্যেক দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছিল, কিন্তু তাদের কাছে সংস্কৃতি যাচাই বাছাইয়ের যন্ত্র না থাকায় এক পর্যায়ে উত্তেজনা থেমে যায়। ঠান্ডা হয়ে যায়, এখন লাতিন আমেরিকা খুশির বন্যায় সাঁতার কাটছে। আমাদের দেশেও যখন পশ্চিমা অপসংস্কৃতির এ বন্যার গলিজ পানি ঢুকতে থাকে তখন দেখা গেল শহর বন্দরের প্রত্যেক অলিগলিতে ভিডিও ক্লাব ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়েছে। বেশকিছু দিন ধরে পাকড়াও চললো তারপর কি যেন একটা সমঝোতা হয়ে গেল। কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই, দেশের যুবসমাজ ও কিশোর কিশোরীরা উচ্ছন্নে যাচ্ছে, কিছু একটা করা দরকার। আপত্তিকর পরিবেশনায় বদঅভ্যস্ত চ্যানেলগুলো বন্ধের পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ভারতের আকাশ বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর জন্য বন্ধ অথচ ভারতীয় চ্যানেলের একটি নাটকও কখন সম্প্রচার করা হবে তা বাংলাদেশে সময়সহ প্রচারিত হয়।

আকাশ সংস্কৃতি আমাদের নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটাচ্ছে কীভাবে ব্যাখ্যার বোধ হয় কোনো প্রয়োজন নেই। নগ্নতা নগ্নতা ছাড়া তো তাদের কাছে কিছুই নেই। এই দুয়ের প্রমাণ যে যতো ঘটাচ্ছে সে ততো বেশি আকাশের বাজার দখল করতে সক্ষম হয়েছে। অপসংস্কৃতির প্লাবনের মধ্যেও কোনো কোনো মুসলিম দেশ সেন্সর করে আকাশের এ সওদা প্রত্যাখ্যান করার সাহস দেখিয়েছে। কারণ প্রত্যেক দেশের কাছে এই আর্ন্তজাতিক নেটওয়ার্কের লোকাল কন্ট্রোলিং ব্যবস্থা আছে। যা আপত্তিকর বলে মনে করা হবে তা প্রদর্শন না করার হুকুম শক্তভাবে দেয়া যায়। ইরান ও সউদী আরব পারছে। আমরা কেন পারবো না?

নগ্নতা বিরুদ্ধে একটা ঘৃণাবোধ সৃষ্টির জাতীয় আন্দোলন অপরিহার্য। তরুণ সমাজের মধ্যে এই জাগরণ যদি আসে তাহলে আন্দোলন সফল হয়। নৈতিকতাবোধ শক্তি, শিক্ষা ও অনুশীলন ছাড়া এই ভাইরাস বন্ধ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে এই ভাইরাস প্রতিরোধে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সেটা হলো এই অপসংস্কৃতির কেউ মনে প্রাণে পছন্দ করে না। আল্লাহর রাসূলের না পছন্দের আর পছন্দের দিকটি যত বেশি প্রচারে আসবে শিক্ষায় আসবে আমলে অনুশীলনে আসবে এই আসমানী বালা-মুসিবত থেকে বাঁচার ব্যবস্থা হবে, নতুবা পরিত্রাণ নেই। হ্যা, আশার কথা, খুব দুর্বল হলেও বিপরীত একটা স্রোত একটা হাওয়া সৃষ্টির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আশা শুধু এই আমাদের ঈমানের তেজই আমাদের হেফাজত করতে পারে।