প্রথম উদাহরণ: ‘হজরে আসওয়াদ পৃথিবীতে আল্লাহর ডান হাত’।

যারা সিফাতসমূহকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে তাবিল তথা দূর ব্যাখ্যার আশ্রয় নেয় তাদের মধ্যে একদল আছে এমন যারা কুরআন-সুন্নাহয় সিফাত-বিষয়ক কিছু টেক্সট সম্পর্কে আহেল সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তাদের দাবি এই যে আহলে সুন্নাত এই টেক্সটসমূহকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে অন্য অর্থে নিয়ে থাকেন। তাদের এ প্রশ্ন উত্থাপনের মূল লক্ষ্য আহলে সুন্নাতকে তাবিলপন্থীদের দলে শামিল করে নেওয়া এবং আহলে সুন্নাতের মধ্যে ও তাদের মধ্যে যে কোনো পার্থক্য নেই তা প্রমাণ করা।

যারা এরূপ প্রশ্ন করেন, দু পর্যায়ে তাদের উত্তর দিতে চাই। প্রথম পর্যায়ে সংক্ষিপ্তভাবে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে বিস্তারিতভাবে:

প্রথমত: সংক্ষিপ্ত জবাব আর তা দুভাবে:

এক. আমরা এটা মানি না যে আহলে সুন্নাতের ব্যাখ্যা সিফাত বিষয়ক কিছু টেক্সটকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে দেয়; কারণ বাহ্যিক অর্থ বলতে বুঝায় কোনো কথা সামনে আসামাত্র যে অর্থটি মাথায় উঁকি দেয়। আর এ বাহ্যিক অর্থ কথার কনটেক্সট হিসেবে, কথাকে যার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে উল্লেখ করা হয় তার হিসেবে, ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। পাশাপাশি বাক্যের গাঁথুনি হিসেবেও শব্দার্থের পরিবর্তন হয়। আর একটি বাণী তো কিছু শব্দ ও বাক্যের সমন্বয়েই তৈরি হয়। অতএব একটিকে অন্যটির সঙ্গে মেলানোর পরই অর্থ উদ্ধার হয়।

দুই. যদি আমরা মেনেও নিই যে আহলে সুন্নাত যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা কিছু টেক্সটকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে দেয়, তবে তারা এরূপ করেছেন কুরআন-সুন্নাহর দলিলের ভিত্তিতে। হয়তো টেক্সটের সঙ্গেই থাকা দলিল অথবা অন্য কোথাও থাকা দলিল। তারা নিছক কিছু সংশয়-সন্দেহকে দলিল হিসেবে সাব্যস্ত করেননি, অথচ এসব সংশয়-সন্দেহকেই আহলে তা‘তীল অকাট্য প্রমাণ হিসেবে মনে করে এবং আল্লাহর জন্য তা সাব্যস্ত করে যা তিনি নিজের জন্য সাব্যস্ত করেননি।

দ্বিতীয়ত: বিস্তারিত জবাব

এ পর্যায়ে ওইসব টেক্সট সম্পর্কে আলোচনা করব যেগুলোর ব্যাপারে বলা হয় যে আহলে সুন্নাত তা বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। নিম্নবর্ণিত উদাহরণগুলো থেকে তা বুঝা যাবে। তাহলে ইমাম গাযালীর একটি কথা উল্লেখের মাধ্যমে শুরু করি। ইমাম গাযালী হাম্বলী মাযহাবের কোনো ব্যক্তির বরাত দিয়ে উল্লেখ করেন যে, ‘ইমাম আহমদ তিন জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও তাবিল করেননি। এ তিন জায়গা হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত তিনটি হাদীস:

الحجر الأسود يمين الله في الأرض

হজরে আসওয়াদ জমীনের বুকে আল্লাহর ডান হাত

قلوب العباد بين أصبعين من أصابع الرحمن

বান্দাদের অন্তরসমূহ দয়াময়ের আঙ্গুলসমূহের মধ্যে দু’আঙ্গুলের মাঝখানে।

إني أجد نفس الرحمن من قبل اليمن

নিশ্চয় আমি আল্লাহর (বান্দাদের) নাফস (বিপদমুক্তির বিষয়টি) ইয়েমেনবাসীদের দিকে পাই।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া উক্ত হাদীসগুলো ইমাম গাযালী থেকে বর্ণনা করে মাজমুউল ফাতাওয়ায় উল্লেখ করেছেন। (খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩৯৮)

এরপর তিনি বলেছেন, ‘এ ঘটনাটি ইমাম আহমদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার’।


প্রথম উদাহরণ: ‘হজরে আসওয়াদ পৃথিবীতে আল্লাহর ডান হাত’।

এর উত্তর: উক্ত হাদীসটি বাতিল হাদীস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে উক্ত হাদীসটি প্রমাণিত হয়নি। ইমাম ইবনুল জাওযী ‘আল ইলাল আল মুতানাহিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, ‘এ হাদীসটি সহীহ নয়’। ইবনুল আরাবী বলেন, ‘এটি একটি বাতিল হাদীস, যার প্রতি তাকানো হবে না।’ শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, ‘এ হাদীসটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অপ্রমাণিত সনদে বর্ণিত হয়েছে।’ অতএব এ হাদীসের অর্থ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। তবু শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন: ‘এটা প্রসিদ্ধ যে উক্ত হাদীস ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। আর পুরো হাদীসটি হলো এ রকম:

«الحجر الأسود يمين الله في الأرض، فمن صافحه وقبله، فكأنما صافح الله وقبل يمينه»

হজরে আসওয়াদ পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলার ডান হাত। যে তার সঙ্গে হাত মেলাল এবং চুম্বন করল, সে যেন আল্লাহর সঙ্গে মুসাফাহা করল এবং তাঁর ডান হাত চুম্বন করল।

যে ব্যক্তি উক্ত হাদীসের শব্দমালায় গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবে সে বুঝতে পারবে এর শব্দমালায় কোনো সমস্যা নেই; কেননা এতে বলা হয়েছে, ‘পৃথিবীতে আল্লাহর ডান হাত’। অর্থাৎ এখানে শব্দকে বন্ধনযুক্ত করে উল্লেখ করা হয়েছে, উন্মুক্তভাবে বলা হয়নি যে, ‘আল্লাহর ডান হাত’ বরং বলা হয়েছে, ‘পৃথিবীতে আল্লাহর ডান হাত’। আর কোনো শব্দকে উন্মুক্তভাবে উল্লেখ করা ও বন্ধনযুক্ত করে উল্লেখ করার মধ্যে অর্থগতভাবে পার্থক্য রয়েছে। এরপর তিনি বলেন: ‘যে তার সঙ্গে হাত মেলাল ও মুসাফাহা করল সে যেন আল্লাহর সঙ্গেই মুসাফাহা করল। অতএব হাদীসটি শুরুর অংশ এবং শেষের অংশ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, হজরে আসওয়াদ আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের মধ্যে শামিল নয়। প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্যই এ বিষয়টি পরিষ্কার। (মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৩৯৮)