উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর উক্তির ব্যাখ্যা

তবে তোমাদের অন্তরে একটি পোকা রয়েছে বলে আমি অনুভব করি যে বলে, আমীরুল মুমিনীন উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কথার কী উত্তর দেবেন? যখন তিনি উবাই ইবন কা‘ব ও তামীম আদ-দারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে নির্দেশ দেন যে, রমযান মাসে তারা যেন মানুষের সালাতের ইমামতি করেন। তারপর তিনি বের হয়ে দেখলেন মানুষ তাদের ইমামের পিছনে একত্র। তখন তিনি বললেন,

«نعمت البدعة هذه والتي ينامون عنها أفضل من التي يقومون»

“এটি কতই না উত্তম বিদ‘আত, তবে যে সালাত থেকে তারা ঘুমিয়ে থাকে (অর্থাৎ শেষ রাতের সালাত), তা সেটা থেকে উত্তম যার কিয়াম তারা করে থাকে। (অর্থাৎ প্রথম রাতের সালাত)”[1]

এ প্রশ্নের উত্তর দুইভাবে দেওয়া যেতে পারে:

এক- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথাকে কোনো মানুষের কথা দ্বারা মুকাবিলা করা জায়েয নেই। এমনকি আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, যিনি নবীদের পর এ উম্মতের সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, যিনি নবীদের পর এ উম্মতের দ্বিতীয় ব্যক্তি, উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, যিনি এ উম্মতের তৃতীয় ব্যক্তি এবং আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, যিনি নবীদের পর এ উম্মতের চতুর্থ ব্যক্তি প্রমুখদের কথা দ্বারাও রাসূলের কথার মুকাবিলা করা যাবে না। এদের ছাড়া অন্য কারোও কথা দ্বারা মুকাবিলা করার প্রশ্নই আসে না। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ فَلۡيَحۡذَرِ ٱلَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنۡ أَمۡرِهِۦٓ أَن تُصِيبَهُمۡ فِتۡنَةٌ أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٦٣﴾ [النور : ٦٣]

“অতএব যারা তাঁর নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা যেন তাদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসা অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাব পৌঁছার ভয় করে”। [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৬৩]

(আয়াতের ব্যাখ্যায়) ইমাম আহমদ রহ, বলেন, তোমরা কি জান ফিতনা কী? ফিতনা হলো শির্ক। হতে পারে যখন কোনো ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো কথা প্রতাখ্যান করে, তখন তার অন্তরে কিছুটা হলেও বক্রতা দেখা দেয়। ফলে সে ধ্বংস হয়।

আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন,

«يوشك أن تنزل عليكم حجارة من السماء أقول قال رسول الله صلى الله عليه وسلّم وتقولون قال أبو بكر وعمر».

“আমি আশঙ্কা করছি যে, তোমাদের ওপর আসমান থেকে পাথর বর্ষিত হবে। আমি তোমাদের বলি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আর তোমরা বল আবু বকর ও উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন”।

দুই- আমরা এ কথা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, আমীরুল মুমিনীন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আল্লাহ তা‘আলা ও তার রাসূলের কথার সম্মান দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দৃঢ় ও কঠোর। আল্লাহর নির্দেশের সামনে মাথা নত করা ও মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি একজন সু-প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। এমনকি তাকে আল্লাহর কথার সামনে অবনতকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হত।

ঐ মহিলার ঘটনা (যদি তা বিশুদ্ধ হয়ে থাকে) যে মহিলা মোহরানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিরোধিতা করেছিল তা অধিকাংশের নিকট অজ্ঞাত নয়। ঐ ঘটনায় মহিলা আল্লাহ তা‘আলার বাণী— ﴿وَكَيۡفَ تَأۡخُذُونَهُۥ وَقَدۡ أَفۡضَىٰ بَعۡضُكُمۡ إِلَىٰ بَعۡضٖ وَأَخَذۡنَ مِنكُم مِّيثَٰقًا غَلِيظٗا ٢١﴾ [النساء : ٢١] “আর তোমরা তা কীভাবে নেবে অথচ তোমরা একে অপরের সাথে একান্তে মিলিত হয়েছ; আর তারা তোমাদের থেকে নিয়েছিল দৃঢ় অঙ্গীকার?” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২১] দ্বারা উমার রাদিয়াল্লাহ ‘আনহুর বিরোধিতা করেন। অতঃপর উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু মোহরানা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকেন। তবে এ ঘটনার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে প্রশ্ন রয়েছে। সুতরাং উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তিনি যেই হোক না কেন তার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথার বিরোধিতা করা এবং কোনো একটি বিদ‘আতকে যে বিদ‘আত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম «كل بدعة ضلالة» “প্রত্যেক বিদ‘আত গোমরাহী” বলেছেন «نعمة البدعة» “কত সুন্দর বিদ‘আত” বলা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়। বরং উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে «نعمة البدعة» “কত সুন্দর বিদ‘আত” বলেছেন, তার কথাকে এমন বিদ‘আতের ওপর প্রয়োগ করতে হবে যেটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী «كل بدعة ضلالة» “প্রত্যেক বিদ‘আত গোমরাহী” -এর উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে না। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার কথা «نعمة البدعة هذه» “কত সুন্দর বিদ‘আত” দ্বারা বিক্ষিপ্ত লোকগুলো এক ইমামের পেছনে একত্র করার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। অন্যথায় রমযানে কিয়ামুল-লাইল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ থেকেই ছিল। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে হাদীস বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের সাথে তিন রাত কিয়াম করেন। চতুর্থ রাত্রিতে তিনি দেরি করে বের হন এবং বলেন,

«إني خشيت أن تفرض عليكم فتعجزوا عنها»

“আমি আশঙ্কা করেছি যে তোমাদের ওপর ফরয করে দেবে ফলে তা তোমরা আদায় করতে অক্ষম হবে”।[2] রমযান মাসে কিয়ামুল-লাইল করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরই সুন্নাত। আর উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে বিদ‘আত বলে নাম রেখেছেন এ হিসেবে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কিয়াম ছেড়ে দিয়েছেন লোকেরা বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছেন। কেউ কেউ মসজিদে একা কিয়াম করতেন। আবার কেউ কেউ কিয়াম করতেন তার সাথে একজন মানুষ থাকতেন। আবার কেউ কেউ কিয়াম করতেন তার সাথে দুইজন বা তিনজন মানুষ থাকত। আবার কারো সাথে এক জামা‘আত থাকত। আমীরুল মুমিনীন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার সঠিক ও নির্ভুল মতামত দ্বারা তাদের সবাইকে একজন ইমামের পেছনে একত্র করা ভালো মনে করলেন। সুতরাং তার এ কর্মটি ইতঃপূর্বে লোকেরা বিক্ষিপ্ত হওয়ার দিক বিবেচনায় বিদ‘আত ছিল। সুতরাং এটি একটি তুলনামুলক ও শাব্দিক বিদ‘আত, এটি নব আবিষ্কৃত কোনো বিদ‘আত নয়, যাকে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবিষ্কার করেছেন। কারণ, এ সুন্নাতটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে ছিল। এ কারণেই কিয়ামুল-লাইল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগের সুন্নাত। তবে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এর যুগ পর্যন্ত এ সুন্নতটি পরিত্যাক্ত ছিল আর উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তা আবার চালু করলেন। এ বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পর বিদ‘আতীদের জন্য উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কথা থেকে, তারা যে বিদ‘আতকে ভালো ও সুন্দর মনে করে সেটার সপক্ষে, কোনো দলীল-প্রমাণ বের করার পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে না।

>
[1] বর্ণনায় সহীহ আল-বুখারী, তারাবীর সালাত অধ্যায়, পরিচ্ছেদ-রমযান মাসে কিয়ামুললাইল করা প্রসঙ্গে। হাদীস নং ২০১০।

[2] বর্ণনায় সহীহ বুখারী তারাবীর সালাত অধ্যায়, পরিচ্ছেদ- রমযান মাসে কিয়ামুল-লাইল করার ফযীলত, হাদীস নং ২০১০; সহীহ মুসলিম, মুসাফিরের সালাত অধ্যায়, পরিচ্ছেদ- রমযান মাসে কিয়ামুল-লাইল করার প্রতি উৎসাহ প্রদান প্রসেঙ্গ। হাদীস নং ৭৬১