সনদ মুত্তাসিল হওয়ার অর্থ, সনদে বিদ্যমান প্রত্যেক রাবি (বর্ণনাকারী) তার শায়খ (শিক্ষক) থেকে সরাসরি হাদিস শ্রবণ করেছেন প্রমাণিত হওয়া। যেমন গ্রন্থকার মুহাদ্দিস বললেন: আমার নিকট বর্ণনা করেছে অমুক (প্রথম উস্তাদ), তিনি বললেন: আমার নিকট বর্ণনা করেছে অমুক (দ্বিতীয় উস্তাদ), তিনি বললেন: আমার নিকট বর্ণনা করেছে অমুক (তৃতীয় উস্তাদ), তিনি বললেন: আমার নিকট বর্ণনা করেছে অমুক (চতুর্থ উস্তাদ)। এভাবে প্রত্যেক রাবি স্বীয় শায়খ থেকে শ্রবণ করেছে নিশ্চিত করলে সনদ মুত্তাসিল। শায়খের অনুমতি গ্রহণ করা, শায়খকে হাদিস শুনিয়ে সম্মতি নেওয়াকে সরাসরি শ্রবণ করা বলা হয়।

সনদ, মতন, রাবি, শায়খ ও মুহাদ্দিস পরিচিতি

 হাদিসের ছাত্র হিসেবে সনদ, মতন ইত্যাদি শব্দসমূহের অর্থ জানা জরুরি। তাই একটি উদাহরণ দ্বারা প্রত্যেকটি শব্দের অর্থ ও ব্যবহার স্পষ্ট করছি, যেন পাঠকবর্গ সহজে বুঝতে পারেন।

قال الإمام البخاري –رحمه الله- حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ يُوسُفَ، قَالَ: أَخْبَرَنَا مَالِكٌ، عَنْ أَبِي الزِّنَادِ، عَنِ الْأَعْرَجِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «لَوْلَا أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي أَوْ عَلَى النَّاسِ لَأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ مَعَ كُلِّ صَلَاةٍ»

এ হাদিস ইমাম বুখারি বর্ণনা করেছেন। এখানে দেখছি বুখারির (১৯৪-২৫৬হি.) উস্তাদ আব্দুল্লাহ ইব্‌ন ইউসুফ (২১৮হি.), তার উস্তাদ মালিক (৮৯-১৭৯হি.), তার উস্তাদ আবুয যিনাদ (৬৫-১৩১হি.), তার উস্তাদ আ‘রাজ (১১৭হি.), তার উস্তাদ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু (৫৭হি.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যদি আমার উম্মতের উপর কষ্ট না হত, অথবা [বলেছেন] মানুষের উপর, তাহলে আমি অবশ্যই তাদেরকে প্রত্যেক সালাতের সাথে মিসওয়াকের নির্দেশ দিতাম”।[1]

সনদ ও মতন: হাদিসের দু’টি প্রধান অংশ: একটি সনদ, অপরটি মতন। এ হাদিসে ইমাম বুখারির উস্তাদ আব্দুল্লাহ ইব্‌ন ইউসুফ থেকে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু পর্যন্ত অংশকে سَنَد ‘সনদ’ বলা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদিসের অবশিষ্ট অংশকে مَتْن ‘মতন’ বলা হয়। হাদিসের মতন ও সনদ একটির সাথে অপরটি ওতপ্রোত জড়িত। সনদ ব্যতীত মতন হয় না, মতন থাকলে অবশ্যই তার সনদ আছে। তবে একটি ‘সহি’ হলে অপরটি ‘সহি’ হওয়া জরুরি নয়। কখনো সনদ সহি হয়, কারণ সহির সকল শর্ত তাতে বিদ্যমান, যেমন সনদ মুত্তাসিল, রাবিগণ আদিল ও দ্বাবিত, তবে মতন শায বা ‘ইল্লতের কারণে সহি নয়। কখনো মতন সহি হয়, তবে রাবির দুর্বলতা বা ইনকিতা‘ (বর্ণনাপরম্পরা কাটা পড়া) এর কারণে সনদ সহি হয় না। সনদ ও মতন উভয় সহি হলে হাদিস সহি। এরূপ হাদিস সম্পর্কে আমরা দৃঢ়ভাবে বলব: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। গ্রন্থকারের উস্তাদকে সনদের শুরু এবং সাহাবিকে সনদের শেষ বলা হয়।

[1] বুখারি: (৮৮৭), মুসলিম: (২৫৪)

রাবি: ‘রাবি’ আরবি শব্দ, বাংলা অর্থ বর্ণনাকারী ও উদ্ধৃতকারী। হাদিসের পরিভাষায় সনদে বিদ্যমান প্রত্যেক ব্যক্তিকে رَاوِيْ বলা হয়। সাহাবি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তাবে‘ঈ সাহাবি থেকে বর্ণনা করেন, এভাবে গ্রন্থকার পর্যন্ত সবাই বর্ণনা করেন, তাই সনদে বিদ্যমান প্রত্যেক ব্যক্তি রাবি। উদাহরণে পেশ করা মিসওয়াকের হাদিসে পাঁচজন রাবি রয়েছে। ১-‘রাবি’ সাহাবি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, ২-‘রাবি’ তাবে‘ঈ আ‘রাজ, ৩-‘রাবি’ তাবে‘ঈ আবুয যিনাদ, ৪-‘রাবি’ মালিক (ইমাম), ৫-‘রাবি’ আব্দুল্লাহ ইব্‌ন ইউসুফ। তিনি ইমাম বুখারির উস্তাদ।

শায়খ’ আরবি শব্দ, বাংলা অর্থ বৃদ্ধ ও বয়স্ক। সাধারণত পঞ্চাশ ঊর্দ্ধ বয়স হলে شَيْخ বলা হয়। আরবরা বয়স্ক ও সম্মানিত ব্যক্তিকে শায়খ বলেন, অনুরূপ উস্তাদকেও তারা শায়খ বলেন। হাদিসের ছাত্ররা তাদের হাদিসবিশারদ উস্তাদকে শায়খ বলেন। আমরা শায়খ দ্বারা হাদিসের উস্তাদ ও রাবি দ্বারা শায়খের ছাত্রকে বুঝিয়েছি। শায়খ ও রাবি আপেক্ষিক শব্দ। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন হিসেবে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাবি, তাবে‘ঈ আ‘রাজ হিসেবে তিনি শায়খ। হাদিস শাস্ত্রে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী, দীর্ঘ দিন হাদিসের পঠন ও পাঠনে নিরত শায়খকে কেউ ‘শায়খুল হাদিস’ বলেন। ভারত উপমহাদেশে বুখারি শরীফের পাঠদানকারীকে ‘শায়খুল হাদিস’ বলা হয়। হাদিসে তার দক্ষতা থাক বা না-থাক। আবার হাদিসে পারঙ্গম হওয়া সত্ত্বেও যদি বুখারির দরস না দেন, তাহলে তিনি শায়খুল হাদিস নন। এ পরিভাষা ঠিক নয়। তাই আমাদের সমাজে ‘শায়খুল হাদিস’ একটি পদের নাম, যোগ্যতার পরিচায়ক উপাধি নয়।

মুহাদ্দিস: ‘মুহাদ্দিস’ আরবি শব্দ, বাংলা অর্থ বর্ণনাকারী বা বক্তা। হাদিসের পঠন-পাঠনকে যারা পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন, তাদেরকে পরিভাষায় مُحَدِّث ‘মুহাদ্দিস’ বলা হয়। ‘মুহাদ্দিস’ কর্তাবাচক বিশেষ্য, এ শব্দের আদেশসূচক ক্রিয়া দ্বারা আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে:

﴿ وَأَمَّا بِنِعۡمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثۡ ١١ ﴾ [الضحى: ١١]

“আর আপনার রবের অনুগ্রহ আপনি বর্ণনা করুন”।[1] অর্থাৎ রিসালাত ও নবুওয়ত সবচেয়ে বড় নিয়ামত, অতএব যে রিসালাত দিয়ে আপনাকে প্রেরণ করা হয়েছে তা পৌঁছে দিন, আর যে নবুওয়ত আপনাকে দেওয়া হয়েছে তা বর্ণনা করুন।[2]

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘মুহাদ্দিস’, কারণ তিনি কুরআন ও হাদিস বর্ণনা করে রিসালাত ও নবুওয়তের দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। পরবর্তীতে শুধু হাদিস বর্ণনাকারীদের মুহাদ্দিস বলা হয়। এ পরিভাষা সাহাবিদের যুগেও ছিল, আব্দুল্লাহ ইব্‌ন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলেন:

وَقَدْ بَلَغَنِي أَنَّكَ مُحَدِّثٌ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي ذَلِكَ.

“আমার নিকট পৌঁছেছে যে, আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অমুক বিষয়ে বর্ণনা করেন”?[3] অতএব সনদে বিদ্যমান সকল রাবি মুহাদ্দিস। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা, কর্ম, সমর্থন ও গুণগানকে যথাযথ সংরক্ষণ ও বর্ণনা করেন। ভারত উপমহাদেশে বুখারি শরীফ ব্যতীত হাদিসের অন্যান্য কিতাব পাঠদানকারীকে মুহাদ্দিস বলা হয়। এ পরিভাষা সঠিক নয়।

[1] সূরা আদ-দোহা: (১১)

[2] লিসানুল আরব: حَدّث ধাতু দেখুন।

[3] মুসনাদে আহমদ: (১১২৩৩)

উক্ত হাদিসের সনদ মুত্তাসিল ও অবিচ্ছিন্ন। এতে কোথাও ছেদ বা ইনকিতা‘ নেই। সাহাবি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে আ‘রাজ, তার থেকে আবুয যিনাদ, তার থেকে মালিক, তার থেকে আব্দুল্লাহ ইব্‌ন ইউসুফ এবং তার থেকে ইমাম বুখারি হাদিস শ্রবণ করেছেন। প্রত্যেক শায়খের সাথে তার রাবির সাক্ষাত প্রমাণিত। শায়খ ও রাবির জন্ম-মৃত্যু তারিখ, অবস্থান ও ভ্রমণ, পাঠগ্রহণ ও পাঠদান তাদের সাক্ষাত প্রমাণ করে। সনদে উল্লেখিত কোনো শায়খ ও রাবির সাক্ষাত সম্পর্কে কোনো ইমাম আপত্তি করেননি। দ্বিতীয়ত ইত্তেসালের বিপরীত ত্রুটিগুলো এখানে নেই, যেমন সনদ মুরসাল নয়, কারণ সাহাবির উল্লেখ আছে; সনদ থেকে এক বা একাধিক রাবি বাদ পড়েনি, তাই মুনকাতি‘ ও মু‘দ্বাল নয়; আবার ইমাম বুখারির উস্তাদ উল্লেখ আছে তাই মু‘আল্লাক নয়। অতএব সনদ মুত্তাসিল, সহি হাদিসের প্রথমশর্ত এতে বিদ্যমান।

ইত্তেসালের শর্তারোপের কারণে ইনকেতা‘ এর সকল প্রকার ‘সহি’ হাদিস থেকে বাদ পড়ল, যেমন মুনকাতি‘, মু‘আল্লাক, মুরসাল, মু‘দ্বাল, তাদলিস ও ইরসালে খফি। অতএব ইনকিতা‘ এর কোনো প্রকার সহি নয়।

[1] মুত্তাসিল ও ইত্তিসাল: ‘মুত্তাসিল’ কর্তাবাচক বিশেষ্য, অর্থ মিলিত। ‘সনদ মুত্তাসিল’ অর্থ সনদটি মিলিত ও অবিচ্ছিন্ন। ‘ইত্তিসাল’ ক্রিয়াবিশেষ্য, অর্থ মিল। ‘সনদে ইত্তিসাল’ নেই অর্থ সনদটি বিচ্ছিন্ন ও ছেদ বিশিষ্ট।

সহি হাদিসের দ্বিতীয় শর্ত রাবির ‘আদল’ হওয়া। عدل ‘আদ্‌ল’ শব্দের অর্থ সোজা ও বক্রতাহীন রাস্তা, যেমন বলা হয় طريق عدل ‘সোজা রাস্তা’। পাপ পরিহারকারী ও সুস্থরুচি সম্পন্ন ব্যক্তি ন্যায় ও সোজা রাস্তার অনুসরণ করে, তাই তাকে ‘আদ্‌ল’ বা ‘আদিল’ বলা হয়। عادل কর্তাবাচক বিশেষ্য, অর্থ ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি। হাদিসের পরিভাষায় দীনদারী ও সুস্থরুচিকে عدالة বলা হয়।

‘আদিল’ এর পারিভাষিক সংজ্ঞা: মুসলিম, বিবেকী, সাবালক, দীন বিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত ও সুস্থ রুচির অধিকারী ব্যক্তিকে উসুলে হাদিসের পরিভাষায় ‘আদিল’ বলা হয়। নিম্নে প্রত্যেকটি শর্ত প্রসঙ্গে আলোকপাত করছি:

মুসলিম: রাবির ‘আদিল হওয়ার জন্য মুসলিম হওয়া জরুরি। অতএব কাফের ‘আদিল’ নয়, তার হাদিস সহি নয়। কাফের কুফরি অবস্থায় হাদিস শ্রবণ করে যদি মুসলিম হয়ে বর্ণনা করে, তাহলে তার হাদিস গ্রহণযোগ্য। কারণ সে সংবাদ দেওয়ার সময় আদিল, যদিও গ্রহণ করার সময় আদিল ছিল না। যেমন জুবাইর ইব্‌ন মুতয়িম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

«سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ فِي الْمَغْرِبِ بِالطُّورِ»

“আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাগরিবের সালাতে সূরা তূর পড়তে শুনেছি”। তিনি শুনেছেন কাফের অবস্থায়, আর বর্ণনা করেছেন মুসলিম অবস্থায়।[1]

সাবালিগ: রাবির আদিল হওয়ার জন্য সাবালিগ হওয়া জরুরি। কেউ শৈশবে হাদিস শ্রবণ করে যদি সাবালিগ হয়ে বর্ণনা করে, তাহলে তার হাদিস গ্রহণযোগ্য, সাবালিগ হওয়ার পূর্বে তার হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়। কতক সাহাবির ক্ষেত্রে এ শর্ত প্রযোজ্য নয়, যেমন ইব্‌ন আব্বাস, ইব্‌ন যুবায়ের ও নুমান ইব্‌ন বাশির প্রমুখ, তাদের হাদিস শৈশাবস্থায় গ্রহণ করা হয়েছে।

বিবেকী: রাবির আদিল হওয়ার জন্য বিবেক সম্পন্ন হওয়া জরুরি। বিবেকহীন ও পাগল ব্যক্তির বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। পাগল দু’প্রকার: স্থায়ী পাগল ও অস্থায়ী পাগল। স্থায়ী পাগলের হাদিস কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়। অস্থায়ী পাগলের মধ্যে যদি সুস্থাবস্থায় সহির অন্যান্য শর্ত বিদ্যমান থাকে, তাহলে তার হাদিস গ্রহণযোগ্য, তবে শ্রবণ করা ও বর্ণনা করা উভয় অবস্থায় সুস্থ থাকা জরুরি।

দীনদারী: রাবির ‘আদিল হওয়ার জন্য দীনদার হওয়া জরুরি, তাই পাপের উপর অটল ব্যক্তি আদিল নয়। পাপ হলেই ‘আদল বিনষ্ট হবে না, কারণ মুসলিম নিষ্পাপ নয়, তবে বারবার পাপ করা কিংবা কবিরা গুনায় লিপ্ত থাকা ‘আদল পরিপন্থী। দীনের অপব্যাখ্যাকারী, তাতে সন্দেহ পোষণকারী ও বিদ‘আতির হাদিস গ্রহণ করা সম্পর্কে আহলে ইলমগণ বিভিন্ন শর্তারোপ করেছেন।

সুস্থ রুচিবোধ: রাবির ‘আদল হওয়ার জন্য সুস্থ রুচিবোধ সম্পন্ন হওয়া জরুরি। সুস্থ রুচিবোধের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। প্রত্যেক সমাজের নির্দিষ্ট প্রথা, সে সমাজের জন্য মাপকাঠি, যা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নানা প্রকার হয়। সাধারণত সৌন্দর্য বিকাশ ও আভিজাত্য প্রকাশকারী কর্মসমূহ সম্পাদন করা এবং তুচ্ছ ও হেয় প্রতিপন্নকারী কর্মসমূহ পরিত্যাগ করাকে সুস্থ রুচিবোধের পরিচায়ক বলা হয়।

হাফেয ইব্‌ন হাজার রাহিমাহুল্লাহ ‘আদল’ এর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন: ‘আদল’ ব্যক্তির মধ্যে এমন যোগ্যতা, যা তাকে তাকওয়া ও রুচিবোধ আঁকড়ে থাকতে বাধ্য করে”।[2]

অতএব ফাসেক ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ‘আদিল’ নয়, যদিও সে সত্যবাদী। জামাত ত্যাগকারী ‘আদিল’ নয়, যদিও সে সত্যবাদী, সুতরাং তাদের বর্ণনাকৃত হাদিস সহি নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن جَآءَكُمۡ فَاسِقُۢ بِنَبَإٖ فَتَبَيَّنُوٓاْ أَن تُصِيبُواْ قَوۡمَۢا بِجَهَٰلَةٖ فَتُصۡبِحُواْ عَلَىٰ مَا فَعَلۡتُمۡ نَٰدِمِينَ ٦﴾ [الحجرات: ٦]

“হে ঈমানদারগণ, যদি কোনো ফাসেক তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও। এ আশঙ্কায় যে, তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো কওমকে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে”।[3] ফাসেক ব্যক্তির সংবাদ যাচাই ব্যতীত গ্রহণ করা যাবে না, পক্ষান্তরে আদিল ব্যক্তির সংবাদ গ্রহণযোগ্য। আল্লাহ বলেন:

﴿ وَأَشۡهِدُواْ ذَوَيۡ عَدۡلٖ مِّنكُمۡ وَأَقِيمُواْ ٱلشَّهَٰدَةَ لِلَّهِۚ ٢ ﴾ [الطلاق : ٢]

“আর তোমাদের মধ্য থেকে ন্যায়পরায়ণ দু’জন সাক্ষী বানাবে। আর আল্লাহর জন্য সঠিক সাক্ষ্য দেবে।”।[4] এ আয়াতে আল্লাহ ‘আদিল’ ব্যক্তিদের সাক্ষীরূপে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

সারাংশ: ‘আদিল’ ব্যক্তির মধ্যে দু’টি গুণ থাকা জরুরি: দীনদারী ও সঠিক রুচিবোধ। এ দু’টি গুণকে ‘আদালত’ বলা হয়। কখনো ‘আদিল’ ব্যক্তির জন্য ক্রিয়াবিশেষ্য ‘আদ্‌ল’ শব্দ ব্যবহার করা হয়, যেমন লেখক বলেছেন: يرويه عدل এখানে ‘আদ্‌ল’ অর্থ ‘আদিল’। অত্র গ্রন্থে আমরা আদিল, আদালত ও আদ্‌ল শব্দগুলো অধিক ব্যবহার করব, তাই পাঠকবর্গ ভালো করে স্মরণ রাখুন।

[1] হাদিসটি মুত্তাফাকুন আলাইহি।

[2] দেখুন: আন-নুয্‌হাহ: (পৃ.৮৩)

[3] সূরা হুজুরাত: (৬)

[4] সূরা তালাক: (২)

রাবির আদালত বর্ণনার ক্ষেত্রে কেউ কড়াকড়ি করেন, কেউ শিথিলতা করেন। যিনি কড়াকড়ি করেন তার আদালতের স্বীকৃতি অধিক গ্রহণযোগ্য, যদিও ইনসাফের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকাই উত্তম, কারণ কড়াকড়ির ফলে যেরূপ সহি হাদিস পরিত্যাজ্য হতে পারে, অনুরূপ শিথিলতার কারণে দুর্বল হাদিস সহি বলে ধরা হয়ে যেতে পারে। কতক সময় দেখা যায় কারো আদালত সম্পর্কে আলেমগণ দ্বিমত পোষণ করেন, যেমন কেউ বলেন: তার কোনো সমস্যা নেই। কেউ বলেন: তিনি নির্ভরযোগ্য। কেউ বলেন: তার হাদিস আমি ছুড়ে ফেলি, সে কোনো বিষয় নয় ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে অধিক গ্রহণযোগ্য মতটি গ্রহণ করব। এ বিষয়ে আরো জানার জন্য বড় কিতাব দেখুন।

উদাহরণে পেশ করা মিসওয়াকের হাদিসে ইমাম বুখারির উস্তাদ আব্দুল্লাহ ইব্‌ন ইউসুফ, তার উস্তাদ মালিক, তার উস্তাদ আবুয যিনাদ এবং তার উস্তাদ আ‘রাজ সবাই আদিল। একাধিক মুহাদ্দিস তাদের আদালত সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। অতএব সনদে বিদ্যমান সকল রাবির মধ্যে দ্বিতীয় শর্ত বিদ্যমান। উল্লেখ্য, সকল সাহাবি আদিল, কারণ তাদের আদালত প্রসঙ্গে আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাক্ষী দিয়েছেন, তাদের সাক্ষীর পর কারো সাক্ষীর প্রয়োজন নেই।

ضبط ক্রিয়াবিশেষ্য, আভিধানিক অর্থ নিয়ন্ত্রণ। এ থেকে যিনি শায়খ থেকে হাদিস শ্রবণ করে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হন, তাকে ضابط বলা হয়। ‘দ্বাবিত’ কর্তাবাচক বিশেষ্য, অর্থ সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণকারী।

দ্বাবত এর পারিভাষিক অর্থ: শায়খ থেকে শ্রবণ করা হাদিস হ্রাস, বৃদ্ধি ও বিকৃতি ব্যতীত অপরের নিকট পৌঁছে দেওয়াই দ্বাবত।

দ্বাবত দুই অবস্থায় থাকা জরুরি: শ্রবণ করার সময় ও বর্ণনা করার সময়। শ্রবণ করার সময় দ্বাবত যেমন, শায়খের হাদিস মনোযোগসহ শ্রবণ করা ও তার মুখ নিঃসৃত প্রতিটি শব্দ যথাযথ সংরক্ষণ করা। এ প্রকার দ্বাবতকে ضبط عند التحمل বলা হয়, অর্থাৎ হাদিস গ্রহণ করার সময় দ্বাবত। বর্ণনা করার সময় দ্বাবত যেমন, শায়খ থেকে শ্রবণকৃত হাদিস রাবির নিকট কোনো প্রকার হ্রাস, বৃদ্ধি ও বিকৃতি ব্যতীত বর্ণনা করা, ভুল হলেও কম। এ প্রকার দ্বাবতকে ضبط عند الأداء বলা হয়, তথা বর্ণনা করার সময় দ্বাবত। এ দুই অবস্থায় দ্বাবত সম্পন্ন রাবিকে দ্বাবিত বলা হয়।

অতএব শায়খের দরসে উদাসীন থাকা রাবি, কিংবা বর্ণনা করার সময় অধিক ভুলকারী রাবি দ্বাবিত নয়, তাই তাদের হাদিস সহি নয়। দ্বাবিত রাবির কখনো ভুল হবে না জরুরি নয়, কারণ এরূপ শর্তারোপ করা হলে এক দশমাংশ সহি হাদিস গ্রহণ করাও মুশকিল হবে।

দ্বাবত দু’প্রকার: স্মৃতি শক্তির দ্বাবত ও খাতায় লিখে দ্বাবত। সাহাবি ও প্রথম যুগের তাবে‘ঈগণ স্মৃতি শক্তির উপর নির্ভর করতেন, পরবর্তীতে লেখার ব্যাপক প্রচলন হয়। তখন থেকে স্মৃতি শক্তি অপেক্ষা লেখার উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়, তবে লিখিত পাণ্ডুলিপি নিজ দায়িত্বে সংরক্ষণ করা জরুরি। লিখে রাখার ফলে ভুল ও বিকৃতি থেকে নিষ্কৃতি মিলে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ ٱقۡرَأۡ بِٱسۡمِ رَبِّكَ ٱلَّذِي خَلَقَ ١ خَلَقَ ٱلۡإِنسَٰنَ مِنۡ عَلَقٍ ٢ ٱقۡرَأۡ وَرَبُّكَ ٱلۡأَكۡرَمُ ٣ ٱلَّذِي عَلَّمَ بِٱلۡقَلَمِ ٤ ﴾ [العلق: ١، ٤]

“পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক থেকে। পড়, আর তোমার রব মহামহিম। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন”।[1]

আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে প্রথম বলেছেন পড়, অতঃপর বলেছেন: “যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন”। অর্থাৎ তোমরা স্মৃতি শক্তি থেকে পড়, যদি স্মৃতি শক্তিতে না থাকে, তাহলে তোমার লিখনি থেকে পড়।[2]

এ আলোচনা থেকে আমরা ‘দ্বাবত’ ও ‘দ্বাবিত’ দু’টি শব্দ জানলাম। দ্বাবত অর্থ সংরক্ষণ করা; আর যিনি সংরক্ষণ করেন তাকে বলা হয় দ্বাবিত, অর্থাৎ সংরক্ষণকারী। দ্বাবত ও দ্বাবিত শব্দ দু’টি আমরা অধিকহারে প্রয়োগ করব, তাই পাঠককুল খুব স্মরণ রাখুন।

[1] সূরা আলাক: (১-৪)

[2] শারহুল মানযুমাহ, লি ইবন উসাইমিন রহ.

সকল রাবির দ্বাবত ও আদালত সমান নয়, তাই সকল সহি হাদিসের মান সমান নয়। দ্বাবত ও আদালতের তফাতের কারণে সহি হাদিস সাত ভাগে ভাগ হয়: ১. বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হাদিস। ২. শুধু বুখারিতে বর্ণিত হাদিস। ৩. শুধু মুসলিমে বর্ণিত হাদিস। ৪. বুখারি ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক হাদিস। ৫. শুধু বুখারির শর্ত মোতাবেক হাদিস। ৬. শুধু মুসলিমের শর্ত মোতাবেক হাদিস। ৭. অন্যান্য মুহাদ্দিসের শর্ত মোতাবেক সহি। উল্লেখ্য, সহি ইব্‌ন খুযাইমাহ সহি ইব্‌ন হিব্বান অপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধ।


يَرْوِيهِ عَدْلٌ ضابِطٌ عَنْ مِثْلِهِ অর্থ আদিল ও দ্বাবিত রাবি তার ন্যায় আদিল ও দ্বাবিত রাবি থেকে বর্ণনা করবে। সহি হাদিসের জন্য গ্রন্থকার থেকে সাহাবি পর্যন্ত সকল রাবির মধ্যে দ্বাবত ও আদালত থাকা জরুরি। অতএব ফাসেক রাবি থেকে আদিল রাবির বর্ণিত হাদিস সহি নয়। অনুরূপ দুর্বল স্মৃতি শক্তি সম্পন্ন রাবি কিংবা অধিক ভুলকারী রাবি থেকে প্রখর স্মৃতি শক্তি সম্পন্ন রাবির বর্ণিত হাদিস সহি নয়, কারণ আদালত ও দ্বাবত সম্পন্ন রাবি তার ন্যায় আদালত ও দ্বাবত সম্পন্ন রাবি থেকে বর্ণনা করেনি।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »