ফির্‌কাহ নাজিয়া আবদুল হামীদ ফাইযী ৫৭ টি
ফির্‌কাহ নাজিয়া আবদুল হামীদ ফাইযী ৫৭ টি

আল্লাহ বিশ্বজগৎ রচনা করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য। বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য যুগে যুগে রসূল পাঠিয়েছেন। রসূলের প্রতি ঐশীগ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন, যাতে হক ও ন্যায়ের সাথে মানুষের মাঝে বিচার ও ফায়সালা হয়। যে বিচার-সংবিধান আল্লাহর বাণী ও রসূল (সা.)-এর উক্তিরূপে আমাদের নিকট মজুদ রয়েছে, যে বিধান ইবাদত, ব্যবহার, বিশ্বাস, ধর্মনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি মানুষের অন্যান্য কর্ম ও বিষয়ে পরিব্যাপ্ত।।

১- আকীদাহ বা বিশ্বাসের বিধানঃ রসূলগণ প্রথম যে বিষয় দ্বারা তাদের দাওয়াত আরম্ভ করেন, তা হল আকীদার সংশুদ্ধি এবং তওহীদ (একত্ববাদ)এর প্রতি মানুষকে আহ্বান। সুতরাং ইউসুফ ৭৫° কারাগারে তার দুই সঙ্গীকে তওহীদের প্রতি আহবান করলেন; যখন তারা তাদের স্বপ্নবৃত্তান্ত সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তখন বৃত্তান্ত বলার পূর্বে তিনি বললেন,

يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَأَرْبَابٌ مُّتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ * مَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنتُمْ وَآبَاؤُكُم مَّا أَنزَلَ اللَّهُ بِهَا مِن سُلْطَانٍ ۚ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۚ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

অর্থাৎ, হে কারা-সঙ্গীদ্বয়! ভিন্ন ভিন্ন বহু প্রতিপালক শ্রেয়, না এক পরাক্রমশালী আল্লাহ তাঁকে ছেড়ে তোমরা যাদের উপাসনা করছ, তা তো কতকগুলি নাম মাত্র, যা তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষরা রেখে নিয়েছে, যার কোন প্রমাণ আল্লাহ পাঠান নি। বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লাহরই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত আর কারো তোমরা উপাসনা করো না। এটিই সরল দ্বীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এ বিষয়ে অবগত নয়। (সূরা ইউসুফ ৩৯-৪০ আয়াত)

২ – ইবাদত সমূহে বিধানঃ নামায, যাকাত, রোযা, হজ্জ প্রভৃতি ইবাদতের যাবতীয় বিধান কুরআন ও সহীহ হাদীস হতে গ্রহণ করা আমাদের জন্য ওয়াজেব ও জরুরী। যেহেতু নবী (সা.) বলেন, “তোমরা সেই রূপে নামায পড় যে রূপে আমাকে পড়তে দেখেছ।” (বুখারী ও মুসলিম) “তোমরা আমার নিকট হতে হজ্জের বিধান গ্রহণ কর। (শিখে নাও।)”

আর সকল আয়েম্মায়ে মুজতাহেদীনগণ বলে গেছেন, হাদীস সহীহ হলে সেটাই আমার মযহাব।”

সুতরাং ইমামগণ কোন এক বিষয়ে পরস্পর মতভেদ করলে আমরা কারো উক্তির অন্ধ পক্ষপাতিত্ব করব না। বরং উদারচিত্তে তারই কথা ও মতের পক্ষপাতিত্ব করব যার কথার প্রমাণে কিতাব ও সুন্নাহ হতে সহীহ দলীল দেখব।*

৩। ক্রয়-বিক্রয়, লেন-দেন, ঋণ ও ভাড়া দেওয়া-নেওয়া প্রভৃতি ব্যবহারিক জীবনের বিধানও একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অধীনে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

অর্থাৎ, না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! ওরা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা ওদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-ভার তোমার উপর অর্পণ না করে, অতঃপর তোমার বিচারে ওদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে। তা মেনে নেয়। (সূরা নিসা ৬৫ আয়াত)

ব্যাখ্যাতাগণ এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ উল্লেখ করে বলেন যে, জমির সেচ নিয়ে দুই ব্যক্তি আপোসে কলহ-বিবাদ করে। এদের মধ্যে একজন ছিলেন নবী (সা.) -এর ফুফুতো ভাই যুবাইর। তারা রসূল (সা.) এর নিকট বিচারপ্রার্থী হলে তার বিচার যুবাইরের অনুকুলে হল। তিনি তাকেই তার প্রতিপক্ষের পুর্বে সেচের অধিকার দিলেন। অপর লোকটির প্রতিকূলে বিচার হলে সে তাকে বলল, 'ও আপনার ফুফুতো ভাই কিনা, তাই ওর সপক্ষে আপনি বিচার করলেন! এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হল। (বুখারী)। ৪। দন্ডবিধি ও সমপ্রতিশোধ দন্ডের বিধানও আল্লাহর। তিনি বলেন,

وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنفَ بِالْأَنفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ ۚ فَمَن تَصَدَّقَ بِهِ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَّهُ ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ

অর্থাৎ, আর আমি তাদের জন্য ওতে বিধান দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদল প্রাণ, চক্ষুর বদল চক্ষু, নাসিকার বদল নাসিকা, কর্ণের বদল কর্ণ, দন্তের বদল দন্ত এবং জখমের বদল অনুরূপ জখম। অতঃপর কেউ তা ক্ষমা করলে ওতে তারই পাপ মোচন হবে। আর আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই অত্যাচারী। (সূরা মায়েদাহ ৪৫ আয়াত)।

৫ - দ্বীন ও ধর্মনীতির বিধান দেবার সকল অধিকারও আল্লাহর। তিনি বলেন,

شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ

অর্থাৎ, তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন এমন দ্বীন যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি--- (সূরা শুরা ১৩ আয়াত)

মুশরিকরা দ্বীনি-বিধান রচনা করার ক্ষমতা গায়রুল্লাহকে দিয়েছিল, তাই আল্লাহ তাদের প্রতিবাদ করে বলেন,

أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُم مِّنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَن بِهِ اللَّهُ

অর্থাৎ, ওদের কি কতকগুলি অংশীদার (আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য উপাস্য) আছে যারা ওদের জন্য বিধান দিয়েছে এমন দ্বীনের, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? (সূরা শুরা ২১ আয়াত)

সারকথাঃ

সার কথা এই যে, কিতাব ও সহীহ সুন্নাহ দ্বারা জীবনের সকল সমস্যার সমাধান করা, তদনুসারে জীবন পরিচালনা করা এবং উভয়ের নিকট বিচারপ্রার্থী হওয়া সমস্ত মুসলিমের জন্য ওয়াজেব। যেহেতু আল্লাহর নির্দেশ,

وَأَنِ احْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ

অর্থাৎ, এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তুমি তদনুযায়ী ওদের মধ্যে বিচার-নিষ্পত্তি কর। (সূরা মায়েদাহ ৪৯ আয়াত)

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “--এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের নেতারা (শাসক গোষ্ঠী ও ইমামগণ) আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী বিধান (ও ফায়সালা) না দেয় এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা বরণ না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাদের মাঝে গৃহদ্বন্দ্ব বহাল রাখেন।” (হাসান ইবনে মাজাহ প্রভৃতি বর্ণনা করেছেন।

মুসলিমদের জন্য এও ওয়াজেব যে, তারা যেন নিজেদের দেশ ও রাষ্ট্র থেকে বিদেশী আইন যেমন ইউরোপীয়, ফরাসী প্রভৃতি কানুন - যা ইসলামী কানুনের পরিপন্থী তা বাতিল করে এবং সেই সমস্ত বিচারালয়ে বিচারপ্রার্থী না হয়। যেখানে ইসলামী আইনের পরিপন্থী আইন দ্বারা বিচার-মীমাংসা করা হয়। বরং আস্থাভাজন উলামাদের নিকট ইসলামী সংবিধানের কাছে নিজেদের বিবাদবিসম্বাদের বিচার প্রার্থনা করবে। আর এটাই তাদের জন্য শ্রেয়। কারণ ইসলাম তাদের মাঝে ন্যায্য বিচার করে প্রত্যেকের ন্যায্য প্রাপ্য প্রদান করবে।

আর এতে তাদের বহু অর্থ ও সময় বাচবে; যা রাষ্ট্রীয় আদালত সমূহে অনর্থক কোন উল্লেখযোগ্য উপকার ছাড়াই বিনষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া মানুষের মনগড়া কানুনের নিকট বিচারপ্রার্থী হওয়াতে কিয়ামতে বড় শাস্তি তো আছেই। কারণ তারা আল্লাহর ন্যায়পরায়ণ আইন ও বিচার হতে বৈমুখ্য প্রকাশ করে যালেম সৃষ্টির গড়া আইন ও বিচারের আশ্রয় নেয়।

* প্রকাশ যে, চার মযহাবের একটার তকলীদ (অন্ধানুকরণ) করা ওয়াজেব’-কথাটি ভিত্তিহীন। ইমামগণ নিজেরাই এর খন্ডন করে গেছেন। রাহেমাহুমুল্লহু আজমাঈন। এ বিষয়টি সাদিসম্মতও নয়। বরং এটা ছিল বিবাদ ও ফিতনা এড়াবার মানসে Principle of excluded middle- এর নীতি। -অনুবাদক।

মক্কা মুকারামার দারুল হাদীসে অনুষ্ঠিত এক ভাষণে মহান দ্বীন-প্রচারক মুহাম্মাদ কুতুব উক্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। মূল প্রশ্নটি নিম্নরূপঃ

প্রশ্ন - কিছু লোক বলে থাকে যে, ইসলামী শাসন-ব্যবস্থার মাধ্যমেই ইসলাম ফিরে আসবে। কিন্তু অন্য কিছু লোক বলে যে, আকীদাহর সংশুদ্ধি এবং সাধারণ তরবিয়তের মাধ্যমেই ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ সম্ভব হবে। এই দুই অভিমতের কোনটি সঠিক?

উত্তরঃ পৃথিবীর বুকে এই দ্বীনের শাসন-ব্যবস্থা কোথা হতে আসবে -যদি দাওয়াতপেশকারীরা আকীদাহর পরিশুদ্ধি সাধন না করে ও লোকেরা সঠিক ঈমানের মুমিন না হয়; যারা তাদের দ্বীনে ক্লিষ্ট হলে ধৈর্য ধারণ করবে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করবে? এরূপ হলে তবেই পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন (ইসলামী শাসন) প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। এতো খুব স্পষ্ট ব্যাপার। শাসক তো আর আকাশ হতে আসবে না, আকাশ হতে অবতীর্ণ হবে না। অবশ্য প্রত্যেক বস্তু তো আসমান (আল্লাহর তরফ ) হতেই আসে। কিন্তু তা মানুষের তদবীর ও প্রচেষ্টায়; যা আল্লাহ মানবজাতির উপর ফরয করেছেন। তিনি বলেন,

وَلَوْ يَشَاءُ اللَّهُ لَانتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَٰكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ

অর্থাৎ, আল্লাহ ইচ্ছা করলে (শাস্তি দিয়ে বা ধ্বংস করে) ওদের নিকট হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু যুদ্ধের বিধান দিয়ে তিনি এককে অপরের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান। (সূরা মুহাম্মদ ৪ আয়াত)

সুতরাং আকীদার পরিশুদ্ধি এবং বিশুদ্ধ আকীদার উপর জনগোষ্ঠীর তরবিয়ত ও প্রশিক্ষণ সর্বাগ্রে শুরু করা আমাদের জন্য জরুরী। যাতে এমন জনগণ তৈরী হয় যারা নিপীড়িত ও বিপদগ্রস্ত হলে অকাতরে সহিষ্ণুতার পরিচয় দেবে যেমন আমাদের প্রথম (পূর্ব)পুরুষ (সাহাবাগণ) সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে গেছেন।

শির্ক আকবর (বড় শির্ক) তখন হবে যখন আপনি কাউকে আল্লাহর সমতুল্য বা সমকক্ষ (শরীক) স্থাপন করবেন। তাকে আপনি ডাকবেন; যেমন আল্লাহকে ডাকেন অথবা কোন প্রকার ইবাদত -যেমন বিপদে সাহায্য প্রার্থনা, যবেহ, ন্যর-নিয়াজ প্রভৃতি তার জন্য নিবেদন করবেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে ইবনে মসউদ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (সা.) -কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, কোন পাপ সর্বপেক্ষা বড়?” উত্তরে তিনি বললেন, “তোমার আল্লাহর সমকক্ষ স্থাপন করা অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” (সমকক্ষ অর্থাৎ সমতুল্য ও অংশীদার)।

শির্কে আকবরের প্রকারভেদ

১ দুআয় (প্রার্থনা ও ডাকার) শির্কঃ- রুজী অনুসন্ধান, রোগ নিরাময় প্রভৃতির উদ্দেশ্যে আম্বিয়া, আওলিয়া ইত্যাদি গায়রুল্লাহকে ডাকলে বা প্রার্থনা করলে এই শির্ক হয়। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تَدْعُ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ ۖ فَإِن فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِّنَ الظَّالِمِينَ

অর্থাৎ, তুমি আল্লাহ ব্যতীত এমন কাউকে আহবান করো না যে তোমার কোন উপকার করে না এবং অপকারও করে না। যদি তা কর, তাহলে তুমি যালেম (মুশরিক)দের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা ইউনুস ১০৬ আয়াত)

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে কোন শরীক (উপাস্য) কে ডাকা অবস্থায় মারা যায় সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (বুখারী)

আল্লাহ ব্যতীত মৃত বা জীবিতদেরকে (বিপদে) ডাকা বা তাদের নিকট কিছু প্রার্থনা করা (যা তাদের দেবার সাধ্য নেই) শির্ক। এ কথার দলীল আল্লাহ তাআলার এই বাণী,

وَالَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِهِ مَا يَمْلِكُونَ مِن قِطْمِيرٍ * إِن تَدْعُوهُمْ لَا يَسْمَعُوا دُعَاءَكُمْ وَلَوْ سَمِعُوا مَا اسْتَجَابُوا لَكُمْ ۖ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُونَ بِشِرْكِكُمْ ۚ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيرٍ

অর্থাৎ, এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা অতি তুচ্ছ। (খেজুরের আঁটির উপর পাতলা আবরণেরও) মালিক নয়। তোমরা তাদেরকে আহবান করলে তোমাদের আহবান তারা শুনবে না, আর শুনলেও তোমাদেরকে সাড়া দেবে না। তোমাদেরকে কিছুও দান করতে পারে না)। কিয়ামতের দিন তোমাদের ঐ শির্ককে তারা অস্বীকার করবে। সর্বজ্ঞ। (আল্লাহর) ন্যায় তোমাকে কেউই অবহিত করতে পারবে না। (সূরা ফাতির ১৩-১৪ আয়াত)

২। আল্লাহর গুণাবলীতে শিকঃযেমন এই বিশ্বাস যে, আম্বিয়া ও আওলিয়াগণ গায়েব (অদৃশ্যের খবর) জানেন। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ

অর্থাৎ- তাঁর নিকটেই গায়েবের চাবি। তিনি ব্যতীত তা আর কেউ জানে। না। (সূরা আনআম ৫৯ আয়াত)

৩। মহব্বতের শির্কঃ তা হল, আওলিয়া প্রভৃতিকে এমন ভালোবাসা ও ভক্তি করা যেমন আল্লাহকে ভালোবাসা ও ভক্তি করা হয়। এর দলীল আল্লাহ তাআলার এই বাণী,

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللَّهِ أَندَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ ۖ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِّلَّهِ

অর্থাৎ, কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর পরিবতে (তার) বিভিন্ন সমকক্ষ স্থির করে তাদেরকে এমন ভালোবাসে; যেমন আল্লাহকে বাসা হয়। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহর ভালোবাসায় সুদৃঢ়। (সূরা বাক্বারাহ ১৬৫ আয়াত)

৪৷ আনুগত্যের শির্কঃ

তা হল বৈধ মনে করে আল্লাহর অবাধ্যাচরণে (নাফরমানী করে) উলামা (ইমাম) ও পীর-বুযুর্গদের আনুগত্য করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ

অর্থাৎ, তারা আল্লাহর পরিবর্তে ওদের পন্ডিত (পাদরী) ও সংসার বিরাগীদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে। (সূরা তাওবাহ ৩১ আয়াত)

ওরা ওদের এক প্রকার উপাসনা করত। যে উপাসনার ব্যাখ্যা হল, আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা হালাল করে এবং তিনি যা হালাল করেছেন তা হারাম করে পাপ কাজে তাদের আনুগত্য করা।

মহানবী (সা.) বলেন, “স্রষ্টার অবাধ্যাচরণ করে কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই।” (সহীহ মুসনাদে আহমদ)

৫। সর্বেশ্বরবাদের শির্কঃ

অর্থাৎ এই বিশ্বাস যে, আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিতে আবির্ভূত। এই বিশ্বাস দেমাঙ্কে সমাধিস্থ সুফী ইবনে আরাবীর। এমনকি সে বলেছে,

প্রভু তো দাস, আর দাস হল প্রভু,

হায় যদি আমি জানতে পারতাম, ‘মুকাল্লাফ’

(শরীয়তের আজ্ঞাপ্রাপ্ত) কে ?!’

সর্বেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ভিন্ন এক সুফী কবি বলেছে,

‘কুকুর-শুকরও আমাদের উপাস্যই,

আল্লাহ তো গীর্জায় অবস্থানকারী পাদরীও!’(*)

৬ - নিয়ন্ত্রণকর্মের শির্কঃ এই বিশ্বাস যে, কিছু আওলিয়ার বিশ্ব-নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আছে, যারা বিশ্বকর্ম পরিচালনা করে থাকেন! যাঁদেরকে ‘কুতুব’ বলা হয়।

অথচ আল্লাহ তাআলা প্রাচীন মুশরিকদেরকে এই বলে প্রশ্ন করেন,

وَمَن يُدَبِّرُ الْأَمْرَ ۚ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ

অর্থাৎ,---এবং কে সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে?’ তখন তারা বলবে, ‘আল্লাহ।' (সূরা ইউনুস ৩১আয়াত)।

৭- ভয়ের শির্কঃ

এই বিশ্বাস যে, কিছু মৃত অথবা অনুপস্থিত আওলিয়ার প্রভাব ও অনিষ্ট করার ক্ষমতা আছে যা ঐ বিশ্বাসীর মনে ভয় সঞ্চার করে ফলে ওদেরকে ভয় করে। এই বিশ্বাস ছিল মুশরিকদের। এর প্রতি সতর্ক করে কুরআন বলে,

أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ ۖ وَيُخَوِّفُونَكَ بِالَّذِينَ مِن دُونِهِ

অর্থাৎ, আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন? অথচ তারা তোমাদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে অন্যের ভয় দেখায়। (সূরা যুমার ৩৬ আয়াত)

অবশ্য হিংস্র জন্তু এবং জীবিত কোন অত্যাচারী ব্যক্তি হতে প্রকৃতিগত ভয় শির্কের পর্যায়ভুক্ত নয়।

৮ - বিধান রচনার শির্কঃ

(৮) এই মতবাদে বিশ্বাসী জনৈক কবি এক জলাশয়ের প্রান্তে বসে থেকে দেখল যে,পদাপাতার উপর একটি ব্যাঙ বসে আছে। ইতিমধ্যে একটি সাপ তাকে আক্রমণ করতে চাইলে সে পানির মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। এ দৃশ্য দেখে সে গায়,

‘হরির উপরে হরি হরি শোভা পায়,

হরিকে দেখিয়া হরি হরিতে লুকায়!’-অনুবাদক

যে ব্যক্তি ইসলাম-পরিপন্থী বিধান প্রণয়ন ও প্রচলন করে মানুষের মনগড়া কানুনকে মানা বৈধ মনে করে অথবা ইসলামী সংবিধানকে অচল ভাবে তার এই শির্ক হয়। এতে শাসক ও শাসনাধীন ব্যক্তি এবং বিচারক ও বিচারাধীন ব্যক্তি সকলেই এই শির্কের পর্যায়ভুক্ত হবে, যদি বিচারাধীন ব্যক্তি ঐ কানুনে বিশ্বাসী ও ঐ বিচারে সন্তুষ্ট হয় তবে।

৯ - শির্কে আকবর আমল বিধংস করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

অর্থাৎ, অবশ্যই তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে যে, যদি তুমি শির্ক কর তাহলে নিশ্চয় তোমার আমল (সৎকর্ম) নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা যুমার ৬৫ আয়াত)

১০। সম্পূর্ণরূপে শির্ক ত্যাগ করে তওবা না করা পর্যন্ত আল্লাহ শির্কে আকবরের পাপ ক্ষমা করবেন না। তিনি বলেন,

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ ۚ وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا

অর্থাৎ, নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সহিত শির্ক করার পাপ ক্ষমা করেন না, এ ছাড়া অন্যান্য পাপ যার জন্য ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে দেন। আর যে আল্লাহর সহিত শির্ক করে, সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়। (সূরা নিসা ১১৬ আয়াত)।

১১। শির্ক বহু প্রকারের। যার কিছু শির্কে আকবর এবং কিছু আসগর; যা থেকে সতর্ক থাকা ওয়াজেব। রসূল ঐ আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, আমরা যেন এই দুআ করি,

اللهم إنا نعوذ بك من أن نشرك بك شيئا نعلمه و نستغفرك لما لا تعلم

উচ্চারণঃ- আল্লাহুম্মা ইন্না নাউযু বিকা মিন আন নুশরিকা বিকা শাইআন না’লামুহ, অনাস্তাগফিরুকা লিমা লা নালাম।

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমরা তোমার সহিত আমাদের কোন জানা বিষয়ে শরীক করা হতে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং অজানা বিষয়ে শির্কের পাপ হতে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। (ইমাম আহমাদ হাদীসটিকে হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন।)

১। আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوا لَهُ ۚ إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ لَن يَخْلُقُوا ذُبَابًا وَلَوِ اجْتَمَعُوا لَهُ ۖ وَإِن يَسْلُبْهُمُ الذُّبَابُ شَيْئًا لَّا يَسْتَنقِذُوهُ مِنْهُ ۚ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْمَطْلُوبُ

অর্থাৎ, হে মানুষ! একটি উপমা দেওয়া হচ্ছে, তোমরা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর ? তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক, তারা তো কক্ষনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না -যদিও তারা এ উদ্দেশ্যে সকলে একত্রিত হয়। আবার মাছি যদি তাদের নিকট হতে কিছু নিয়ে চলে যায়, তবে তাও তারা তার নিকট হতে উদ্ধার করতে পারবে না। প্রার্থী ও প্রার্থিত উভয়ই অক্ষম। (সূরা হজ্জ ৭৩ আয়াত)

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে সম্বোধন করে মহান উপমাটি মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করতে আদেশ করেন। তিনি বলেন, ঐ আওলিয়া, সালেহীন প্রভৃতিগণ; যাদেরকে তোমরা বিপদে সাহায্য লাভের জন্য আহবান করছ তারা তোমাদের সাহায্য করতে অক্ষম। বরং তারা কোনও এক সৃষ্টি যেমন একটি মাছিও সৃজন করতে অসমর্থ। আবার মাছি যদি তাদের খাদ্য অথবা পানীয়র কিছু অংশ নিয়ে চলে যেতে চায়, তবে তাও ফিরিয়ে আনতে তারা সক্ষম হবে না। এ তাদের দুর্বলতা ও অক্ষমতার এবং মাছিরও হীনতা ও ক্ষীণতার দলীল। সুতরাং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা তাদেরকে কি ভেবে আহবান করছ ? অত্র উপমায় তাদের বিরুদ্ধে ঘোর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে যারা আম্বিয়া, আওলিয়া প্রভৃতি গায়রুল্লাহকে বিপদে ডেকে থাকে।

২। আল্লাহ তাআলা বলেন,

لَهُ دَعْوَةُ الْحَقِّ ۖ وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِن دُونِهِ لَا يَسْتَجِيبُونَ لَهُم بِشَيْءٍ إِلَّا كَبَاسِطِ كَفَّيْهِ إِلَى الْمَاءِ لِيَبْلُغَ فَاهُ وَمَا هُوَ بِبَالِغِهِ ۚ وَمَا دُعَاءُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ

অর্থাৎ, সত্য আহবান তারই। যারা তাঁকে ব্যতীত অন্যকে আহবান করে ওরা তাদেরকে কোন সাড়াই দেয় না, তাদের দৃষ্টান্ত সেই (পিপাসার্ত) ব্যক্তির মত, যে তার মুখে পানি পৌছবে এই আশায় তার হস্তদ্বয় এমন পানির দিকে প্রসারিত করে যা তার মুখে পৌছবার নয়। কাফেরদের আহবান তো নিষ্ফল। (সূরা রা'দ ১৪ আয়াত)

উক্ত আয়াতে এ কথাই বুঝানো হয়েছে যে, দুআ (আহবান ও প্রার্থনা), যা মুল ইবাদত তা একমাত্র আল্লাহরই জন্য নিবেদিত হওয়া উচিত। ওরা যে। আল্লাহকে ছেড়ে অপরকে আহবান করছে তাতে ওরা ওদের নিকট কোন উপকার লাভ করবে না। আর ওল্লাও (গায়রুল্লাহ) ওদেরকে কোন প্রকার সাড়াও দেবে না, কোন সাহায্যও করতে পারবে না। তাদের উপমা সেই তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির ন্যায়, যে এক কুঁয়ার উপর দন্ডায়মান থেকে হাত বাড়িয়ে পানি নিয়ে মুখে দেওয়ার অপচেষ্টা করে; যা তার সাধ্যে নয়। (যেহেতু সে পানি তার নাগালের বাইরে।)

মুজাহিদ বলেন, সে নিজের জিহ্বা দ্বারা পানিকে ডাকে এবং ইশারা করে কিন্তু পানি কক্ষনোই মুখে এসে পৌছে না।” (ইবনে কাসীর) অতঃপর যারা আল্লাহর পরিবর্তে অপরকে ডাকে তাদের সম্পর্কে তিনি ফায়সালা দেন যে, তারা কাফের এবং তাদের ঐ আহবান ভ্রষ্টতা ও নিষ্ফল। যেহেতু তিনি বলেন, কাফেরদের আহবান তো নিষ্ফল।

অতএব ভাই মুসলিম! গায়রুল্লাহকে ডেকে কাফের ও ভ্রষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে সাবধান হন। আর একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহকেই ডাকুন। এতে আপনি তওহীদবাদী মুমেনদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।

তিন প্রকার শির্ক দূর না করে আল্লাহর সহিত শির্ক দূর করা সম্পন্ন ও সম্ভব হবে নাঃ

১। প্রতিপালকের কর্মসমূহে শির্কঃ এই বিশ্বাস যে, আল্লাহর সহায়ক কোন ভিন্ন সৃষ্টিকর্তা অথবা নিয়ন্তা আছে। যেমন কিছু সুফীপন্থী মনে করে যে, আল্লাহ তাআলা কিছু বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ-ভার তার কিছু আওলিয়া ও কুতুবকে সমর্পণ করেছেন! যে বিশ্বাসের বিশ্বাসী প্রাক, ইসলাম যুগের মুশরিকরাও ছিল না। তাই তাদেরকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলেও তারা ওদের মত উত্তর দেয়নি। আল্লাহ বলেন,

وَمَن يُدَبِّرُ الْأَمْرَ ۚ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ

অর্থাৎ, কে সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে? তারা বলবে, আল্লাহ।' (সূরা ইউনুস ৩১ আয়াত)

এক সুফী লেখকের বই ‘আলকা-ফী ফিরদ্দি আলাল অহহা-বীতে পড়েছি, লেখক বলেন, 'আল্লাহর এমন অনেক বান্দা আছে যারা কোন কিছুর উদ্দেশ্যে হও’ বললে সাথে সাথে তা হয়ে যায়! অথচ কুরআন তার এই কথার মিথ্যায়ন ও খন্ডন করে। আল্লাহ বলেন,

إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَن يَقُولَ لَهُ كُن فَيَكُونُ

অর্থাৎ, তিনি যখন কিছু করতে ইচ্ছা করেন, তখন (তার প্রতি ইঙ্গিত করে) কেবল হও’ বললে তা হয়ে যায়। (সূরা ইয়াসীন ৮২ আয়াত)

অন্যত্রে তিনি বলেন, (أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ) অর্থাৎ জেনে রাখ, সৃষ্টি করা ও নির্দেশ দান কেবল তারই কাজ। (সূরা আরাফ ৫৪ আয়াত)

২। ইবাদত ও দুআতে শির্কঃ আল্লাহর ইবাদত করা ও তাকে ডাকার সাথে সাথে অন্যান্য আম্বিয়া আওলিয়া ও সালেহীনদেরকেও ডাকা। যেমন তাদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা বিপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে তাদেরকে আহবান করা। দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, এই শির্ক বর্তমান উম্মাহর মাঝে বহুল প্রচলিত। এই মহাপাপের অধিকাংশ বহন করবেন সেই পীর বুযুর্গ ও আলেমরা যারা অসীলার নামে এই ধরনের শির্ককে সমর্থন করে থাকেন এবং তাকে ভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকেন। যেহেতু অসীলা মানা হল কাউকে মাধ্যম করে আল্লাহরই নিকট প্রার্থনা করা। কিন্তু ওরা যা করে থাকে তা তো সরাসরি গায়রুল্লাহর নিকটেই প্রার্থনা করা। যেমন ওরা বলে, মদদ ইয়া রাসূলাল্লাহ!’ ‘মদদ ইয়া জীলানী! অথবা মদদ ইয়া বদবী!’ (মদদ ইয়া খাজা! মদদ ইয়া আলী!) আর এই যাচনাই হল গায়রুল্লাহর উপাসনা। যেহেতু তা দুআ ও ফরিয়াদ। আর নবী (সা.) বলেন, “দুআই তো ইবাদত (উপাসনা)।” (তিরমিযী, এব তিনি হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। পক্ষান্তরে মদদ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট চাওয়া বৈধ নয়। তিনি বলেন,

وَيُمْدِدْكُم بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ

অর্থাৎ, তিনি তোমাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা মদদ (সমৃদ্ধ) করবেন। (সূরা নূহ ১২ আয়াত)

৩ শাসন ও বিচারের শির্কঃ ইবাদতের শির্কের পর্যায়ভুক্ত যদি শাসক বা বিচারক অথবা শাসনাধীন বা বিচারাধীন ব্যক্তি আল্লাহর বিধান ও কানুনকে অচল মনে করে অথবা তার বিধান ও কানুন ব্যতীত অন্য বিধান ও কানুন অনুযায়ী শাসন ও বিচার বৈধ মনে করে।

৪। আল্লাহর গুণাবলীতে শির্কঃ

আল্লাহর কোন কোন সৃষ্টি যেমন আম্বিয়া, আওলিয়া প্রভৃতিকে আল্লাহ আযযা অজাল্লার বিশিষ্ট কোন কোন গুণ দ্বারা গুণান্বিত করা। যেমন উদাহরণ স্বরূপ, গায়েবী খবর জানা।

এই প্রকার শির্ক সূফীপন্থী এবং এদের দ্বারা প্রভাবান্বিত লোকদের মাঝে ব্যাপক প্রচলিত। যেমন বুসীরী নবী (সা.) প্ল-এর প্রশংসা করে বলেছে, ‘হে নবী (সা.) পৃথিবী ও তার অফুরন্ত সম্পদ তোমার বদান্যতারই অংশ, লওহে মাহফুয ও কলমের ইলমও তোমার অগাধ ইলমের অন্তর্ভুক্ত!! এখান হতেই কিছু ধর্মজী দাজ্জালদের ভ্রষ্টতার প্রাদুর্ভাব ঘটে। যারা ধারণা করে যে, তারা রসূল -কে জাগ্রতাবস্থায় দেখে থাকে এবং তাদের। সহচরবর্গকে তাদের কোন কোন বিষয়ে দায়িত্বভার দেবার পূর্বে তাকে ওদের অন্তস্তলের গুপ্ত রহস্য প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করে। অথচ রসূল ঐ তার জীবদ্দশায় এ ধরনের রহস্য জানতে পারতেন না। যেমন তাঁর তরফ থেকে কুরআন বলে,

وَلَوْ كُنتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ

অর্থাৎ, আমি যদি গায়েব (অদৃশ্যের খবর) জানতাম, তবে তো আমি প্রভূত। কল্যাণ লাভ করতাম এবং অকল্যাণ আমাকে স্পর্শই করত না। (সূরা আরাফ ১৮৮৮)

সুতরাং ইহকাল ত্যাগ করার পর এবং সুমহান বন্ধুর নিকট চলে যাওয়ার পর তিনি গায়েবের খবর কি রূপে জানতে পারেন? তিনি এক বালিকাকে যখন কবিতায় বলতে শুনলেন, “আমাদের মাঝে এমন নবী (সা.) আছেন; যিনি আগামীকালের অবস্থা জানেন।” তখন তিনি বললেন, “এই কথাটি ছেড়ে দাও (বলো না) বাকী যেগুলি বলছিলে সেগুলি বল।”

অবশ্য আল্লাহ তাআলা তাঁর রসূলগণকে কোন কোন গায়েবী বিষয়ে অবহিত করে থাকেন। যেমন তিনি বলেন,

عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَىٰ غَيْبِهِ أَحَدًا * إِلَّا مَنِ ارْتَضَىٰ مِن رَّسُولٍ

অর্থাৎ, তিনি অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, তিনি তাঁর অদৃশ্যের (গায়েবী) জ্ঞান। কারো নিকট প্রকাশ করেন না। তার মনোনীত রসূল ব্যতীত। (সূরা জিন ২৬-২৭)

উক্ত তিন প্রকার শির্ক থেকে আল্লাহকে যে পবিত্র করবে এবং তার সত্তা, ইবাদত, দুআ, এবং গুণাবলীতে তাকে একক ও অদ্বিতীয় মানবে সেই হল। তওহীদবাদী। তার জন্য রয়েছে তওহীদবাদীদের মত বিশিষ্ট মর্যাদা। আর যে ব্যক্তি ঐ তিন প্রকার শির্কের কোন এক প্রকার আল্লাহর জন্য স্থাপন করবে সে। তওহীবাদী হবে না। বরং তার পক্ষে আল্লাহ তাআলার এই বাণী সঙ্গত হবে। তিনি বলেন,

وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ

অর্থাৎ, ওরা যদি শির্ক করত তাহলে ওদের সমস্ত কৃতকর্ম পণ্ড হয়ে যেত। (সূরা আনআম ৮৮ আয়াত)

তিনি আরো বলেন,

لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

অর্থাৎ, তুমি যদি শির্ক কর তবে তোমার আমল নিষ্ফল হবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা যুমার ৬৫ আয়াত)

কিন্তু যদি সে তওবা করে আল্লাহকে শরীক থেকে পবিত্র করে, তাহলে সে তওহীদবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে তওহীদবাদীদের শ্রেণীভুক্ত কর এবং মুশরিক (অংশীবাদী)দের দলভুক্ত করো না।

প্রত্যেক সেই মাধ্যম ও উপায় (কর্ম) যা শির্কে আকবরের কাছে পৌছে দেয়। আর যা ইবাদতের মর্যাদায় না পৌছে তা শির্কে আসগর (ছোট শির্ক)। এ ধরনের শির্ককারী ইসলাম হতে বহির্ভূত হয়ে যায় না। তবে তা কাবীরাহ গোনাহ (মহাপাপ) অবশ্যই বটে। যেমনঃ

১ কিঞ্চিৎ রিয়া (লোক প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ইবাদত করা) ও সৃষ্টির দৃষ্টি ও মন আকর্ষণের উদ্দেশ্যে ইবাদতকে সুশোভিত করা। যেমন এক মুসলিম আল্লাহর উদ্দেশ্যে সৎকর্ম করে, আল্লাহর জন্য নামায পড়ে। কিন্তু লোকের সামনে তাদের প্রশংসা লুটার উদ্দেশ্যে তার সৎকর্ম ও নামাযকে সুন্দররূপে সুশোভিত করে - এরূপ কর্ম ছোট শির্ক। আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَمَن كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا

অর্থাৎ, সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকর্ম। করে এবং তার প্রভুর ইবাদতে কাউকে শরীক না করে। (সূরা কাহফ ১১০

মহানবী (সা.) বলেন, “আমি তোমাদের জন্য যা অধিক ভয় করি, তা হল ছোট শির্ক; রিয়া। আল্লাহ কিয়ামতে যখন সকল মানুষকে তাদের নিজ নিজ আমলের প্রতিদান দেবেন তখন তিনি বলবেন, তাদের নিকট যাও যাদেরকে প্রদর্শন করে তোমরা কর্ম করতে অতঃপর দেখ, তাদের নিকট কোন প্রতিদান পাও কি না!’ (সহীহ মুসনাদে আহমদ)

২। আল্লাহ বতীত অন্য কারো নামে কসম (শপথ, হলফ বা কিরে) করা। নবী (সা.) ঐ বলেন, “যে ব্যক্তি গায়রুল্লাহর নামে কসম করে সে শির্ক করে।” (সহীহ মুসনাদে আহমদ)

আবার গায়রুল্লাহর নামে শপথ করা শির্কে আকবরও হতে পারে যদি শপথকারী এই বিশ্বাস রাখে যে, ওলী (বা যার নামে শপথ করেছে তার) এমন ইচ্ছাশক্তি আছে যে, তাঁর নামে মিথ্যা শপথ করলে তিনি তার ক্ষতি করবেন।

৩৷ শির্ক খাফী (অস্পষ্ট বা গুপ্ত শির্ক) আর তা ইবনে আব্বাসের ব্যাখ্যানুযায়ী কোন ব্যক্তির তার সঙ্গীকে ‘আল্লাহ ও আপনি যা চেয়েছেন (তাই হয়েছে)’ বলা।

তদনুরূপ যদি আল্লাহ এবং অমুক না থাকত (তাহলে আমার এই হত) বলা। অবশ্য যদি আল্লাহ তারপর অমুক না থাকত (তাহলে আমার এই হত) বলা বৈধ।

রসূল (সা.) বলেন, “তোমরা আল্লাহ এবং অমুক যা চেয়েছে’ বলো না বরং ‘আল্লাহ তারপর অমুক যা চেয়েছে’ বল।” (সহীহ মুসনাদে আহমদ প্রভৃতি)

বর্তমানে মুসলিম-বিশ্বে ব্যাপক আকারে প্রচলিত শির্কের সমারোহই মুসলিমদের দুর্দশা এবং ফিতনা ফাসাদ, ভূমিকম্প, যুদ্ধ প্রভৃতি আযাবে নিষ্পেষিত হওয়ার প্রধান কারণ। যা তাদের তওহীদ হতে বিমুখ এবং তাদের বিশ্বাস ও আচরণে শির্ক বহিঃপ্রকাশ হওয়ার কারণে আল্লাহ তাআলা তাদের উপর অবতীর্ণ করেছেন। অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে নানা প্রকার শির্কের ঘটা দেখা যায় যাকে বহু মুসলিম ইসলাম (বা ধর্ম) বলে মনে করে তা উক্ত কথারই প্রমাণ। আর তা ধর্ম মনে করে বলেই তারা তাকে মন্দ জানে না। অথচ তারা জানে যে, শিকী রীতি ও কর্মকে এবং শির্কের যাবতীয় অসীলা ও উপকরণকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই ইসলামের আবির্ভাব।

প্রধান প্রধান প্রচলিত শির্ক যেমনঃ

১৷ গায়রুল্লাহকে ডাকা (তাদের নিকট কিছু চাওয়া)। এই শির্কের বহিঃপ্রকাশ সাধারণতঃ অধিকাংশ নাত, গজল-গীতি ও কাওয়ালী প্রভৃতিতে ঘটে থাকে; যা নবী (সা.) দিবস, উরস এবং ঐতিহাসিক কোন স্মরণীয় দিবস উপলক্ষে আবৃত্তি করা ও গাওয়া হয়। আমি স্বয়ং ওদেরকে গাইতে শুনেছি,

‘হে রসূলদের ইমাম, হে আমার অবলম্বন!

আপনি আল্লাহর দরজা ও আমার ভরসাস্থল।

আমার ইহকালে ও আমার পরকালে

হে আল্লাহর রসূল (সা.)! আপনি আমার হাত ধরুন।

আমার কষ্টকে স্বস্তিতে আপনি ব্যতীত

আর কেউ পরিণত করতে পারে না, হে সম্মানের মুকুট!

এ ধরনের স্তুতিবাদ যদি রসূলও শুনতেন তবে নিশ্চয় তিনি এতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন। যেহেতু একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কষ্টকে স্বস্তিতে পরিণত করতে (মুশকিল আসান করতে) কেউই পারে না।। তদনুরূপ সেই সমস্ত গজল ও কবিতা যা পত্র-পত্রিকা ও বই-পুস্তকে লিখা হয়, যাতে রসূল আওলিয়া এবং সালেহীনদের নিকট মদদ, সাহায্য ও সহযোগিতা প্রার্থনা করা হয় যা মঞ্জুর করতে তারা সক্ষম নন।

২। আওলিয়া ও সালেহীনদেরকে মসজিদে দাফন (সমাধিস্থ করা। সুতরাং অধিকাংশ মুসলিম দেশে আপনি প্রায় মসজিদে কবর দেখতে পাবেন, যার কিছুর উপরে কুব্বা, গম্বুজ বা মাযারও নির্মিত আছে। কিছু লোক আল্লাহকে ছেড়ে সে সমস্ত কবরের কাছে নিজেদের প্রয়োজন ভিক্ষা করে। অথচ রসূল (সা.) প্লঃ কবরকে মসজিদ বানাতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, “আল্লাহ ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদেরকে অভিসম্পাত করুন; তারা তাদের আম্বিয়াদের কবরসমূহকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে।” (বুখারী ও মুসলিম)

অতএব আম্বিয়াগণকে যদি মসজিদে দাফন করা অবিধেয় হয় তাহলে কোন পীর বা আলেমকে তাতে দাফন করা কি করে বৈধ হতে পারে? পরন্তু বিদিত। যে, ঐ সমাধিস্থ ব্যক্তিকে আল্লাহর পরিবর্তে ডাকাও হতে পারে। যা শির্ক সংঘটনের কারণ হয়ে বসবে। অথচ ইসলাম শির্ক এবং তার দিকে পৌছে দেয় এমন সমস্ত উপায়-উপকরণকে হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

৩। আওলিয়াদের নামে নযর মানা। কিছু লোক আছে, যারা অমুক অলীর নামে কোন পশু (মুরগী, খাসি বা শিরনী মিঠাই) ইত্যাদির নযর (মানত বা মানসিক) মেনে থাকে। অথচ এইরূপ ন্যর মানা শির্ক, যা পুরণ করা হারাম।। যেহেতু ন্যর মানা এক ইবাদত। যা একমাত্র আল্লাহর জন্য ও উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

يُوفُونَ بِالنَّذْرِ وَيَخَافُونَ يَوْمًا كَانَ شَرُّهُ مُسْتَطِيرًا

অর্থাৎ, তারা তাদের ন্যর পূর্ণ করে এবং সেদিনকে ভয় করে যেদিনের ধ্বংসলীলা হবে ব্যাপক। (সূরা দাহর ৭ আয়াত)

৪। আম্বিয়া ও আওলিয়াদের কবর সমীপে পশু যবেহ করা যদিও নিয়ত আল্লাহর নামে ও উদ্দেশ্যেই যবেহ করা হয়। যেহেতু উক্ত কর্ম মুশরিকদের; যারা তাদের আওলিয়ারূপী মূর্তিসমূহের সন্নিকটে পশু যবেহ (বলিদান) করত।

রসূল ৪ বলেন, “আল্লাহ তাকে অভিশাপ করেন, যে গায়রুল্লাহর উদ্দেশ্যে যবেহ করে।” (মুসলিম)

৫৷ আম্বিয়া এবং আওলিয়া যেমন; জীলানী, রিফায়ী, বদবী, হুসাইন (নিযামুদ্দীন, মুঈনুদ্দীন চিশতী, শাহ জালাল, খান জাহান, দাতা সাহেব) বা

অন্য কারো কবরের তওয়াফ করা। যেহেতু তওয়াফ করা এক ইবাদত। যা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে কাবা শরীফকে কেন্দ্র করেই করা বিধেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, (وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ)। অর্থাৎ, এবং তারা যেন প্রাচীন গৃহের তওয়াফ করে।” (সূরা হজ্জ ২৯ আয়াত)

৬। কবরের দিকে মুখ করে নামায পড়া। এরূপ অবৈধ। মহানবী (সা.) & বলেন, “তোমরা কবরের উপর বসো না এবং তার প্রতি সম্মুখ করে। নামায পড়ো না।”

৭। কবর দ্বারা বৰ্কত অর্জনের (তাবারুকের) উদ্দেশ্যে অথবা তার নিকট নামায পড়ার উদ্দেশ্যে সফর (তীর্থযাত্রা) করা। এটাও বৈধ নয়। যেহেতু নবী (সা.) বলেন, “তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন স্থানের প্রতি সফর করা হবে না; মসজিদে হারাম, আমার এই মসজিদ (নববী) এবং মসজিদে আকসা।”

সুতরাং আমরা মদীনা নববিয়্যা যাবার ইচ্ছা করলে বলব, মসজিদে নববীর যিয়ারত ও নবী (সা.) এর প্রতি সালাম পড়তে মদীনা যাব।”

৮। আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানের পরিবর্তে অন্য বিধান দ্বারা জীবনও রাষ্ট্র পরিচালনা এবং বিচার-আচার করা। যেমন মানুষের মনগড়া কানুন দ্বারা বিচার করা যা কুরআন কারীম এবং সহীহ সুন্নাহর পরিপন্থী। যদি ঐ সমস্ত কানুন মান্য ও কার্যকর করা বৈধ মনে করে (তবে তা এক প্রকার কুফরী)।

তদনুরূপ সেই সমস্ত ফতোয়া যা কিছু উলামা প্রকাশ করে থাকেন অথচ তা ইসলামের স্পষ্ট উক্তির পরিপন্থী। যেমন (ইচ্ছাকৃত কোন ব্যাখ্যা না থাকা সত্ত্বেও) সুদ হালালের ফতোয়া। অথচ আল্লাহ সুদখোরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।

৯। কুরআন অথবা সহীহ সুন্নাহর স্পষ্ট উক্তির পরিপন্থী বিষয়ে শাসক, রাষ্ট্রনেতা উলামা ও বুযুর্গদের আনুগত্য। যাকে ‘শিকুতু-ত্বাআহ’ (আনুগত্যের শির্ক) বলা হয়।* নবী (সা.) বলেন, “স্রষ্টার অবাধ্যতা করে কোন সৃষ্টির জন্য আনুগত্য নেই।” (সহীহ মুসনাদে আহমদ)

আল্লাহ তাআলা বলেন,

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ لَّا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ

অর্থাৎ, ওরা ওদের পন্ডিতগণকে, সংসারবিরাগীদেরকে এবং মারয়্যাম তনয় মাসীহকেও আল্লাহর পরিবর্তে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে। অথচ ওরা কেবল একই উপাস্যের উপাসনা করতে আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ব্যতীত কেউ সত্য উপাস্য নেই। ওদের শির্ক হতে তিনি পবিত্র। (সূরা তাওবাহ ৩১ আয়াত)।

উক্ত আয়াতে ইবাদত (উপাসনা)র ব্যাখ্যায় হুযাইফাহ (রাঃ) বলেন, “তা হল ইয়াহুদদের উলামারা যা তাদের জন্য হালাল করেছে অথবা হারাম করেছে। তাতে ওদের আনুগত্য করা।

* যদি অনুগত ব্যক্তি অবাধ্যতা ও পাপে তাদের আনুগত্য করার বৈধতার বিশ্বাসী হয়।

বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে - যেমন, সিরিয়া, ইরাক, মিসর প্রভৃতি দেশে যে সব দুর্গা আমরা দেখতে পাই তা ইসলামী শিক্ষা ও নির্দেশের পরিপন্থী। যেহেতু নবী (সা.) ঐক্ত কবরের উপর ইমারত নির্মাণ করতে নিষেধ করেছেন। সহীহ হাদীসে বর্ণিত, “রসূল (সা.) কবর চুনকাম করা, তার উপর বসা এবং তার উপর ইমারত নির্মাণ করা হতে নিষেধ করেছেন।” (মুসলিম)

যে কোন প্রকার রং দ্বারা রঞ্জিত করা চুনকামের পর্যায়ভুক্ত।। তিরমিযীর এক সহীহ বর্ণনায় আরো বলা হয়েছে যে, “এবং কবরের উপর (কুরআনের আয়াত, কবিতা ইত্যাদি) লিখা হতেও তিনি নিষেধ করেছেন।”

১। এই মাযারসমূহের বেশীর ভাগই ঝুটা ও অলীক। সুতরাং হুসাইন বিন আলী ৬ ইরাকে শহীদ হন। তিনি (বা তার শবদেহ) মিসর পৌঁছেননি। অতএব মিসরে তাঁর কবর সত্য নয়। আর একথার বড় দলীল এই যে, ইরাক, মিসর ও সিরিয়ায় তার কবর বর্তমান! এবং দ্বিতীয় দলীল এই যে, সাহাবাগণ। মসজিদে কোন মৃত সমাধিস্থ করতেন না। কারণ রসূল (সা.) বলেন,“আল্লাহ

ইয়াহুদকে ধ্বংস করুন, তারা তাদের আম্বিয়াগণের কবর সমুহকে মসজিদরূপে গ্রহণ করেছে।” (বুখারী ও মুসলিম)

আর এর পশ্চাতে হিকমত ও যুক্তি এই যে, এতে মসজিদসমূহ শির্ক হতে মুক্ত থাকবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَأَنَّ الْمَسَاجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدْعُوا مَعَ اللَّهِ أَحَدًا

অর্থাৎ, মসজিদসমূহ আল্লাহর জন্য। সুতরাং তোমরা আল্লাহর সহিত অন্য কাউকেও আহবান করো না। (সূরা জিন ১৮ আয়াত)

প্রমাণসিদ্ধ যে, রসূল (সা.) তার স্বগৃহে সমাধিস্থ হয়েছেন, মসজিদে তাকে দাফন করা হয়নি। কিন্তু উমাবীরা যখন মসজিদ প্রশস্ত করেন তখন কবরকে মসজিদে শামিল করে নেন। হায়! যদি তারা একাজ না করতেন!

হুসাইন (রাঃ)-এর কবর বর্তমানে মসজিদের ভিতরে। কিছু লোক তার তওয়াফ করে এবং তার নিকট তাদের প্রয়োজন ভিক্ষা করে; যা আল্লাহ ব্যতীত আর কারো নিকট চাওয়া যায় না। যেমন, রোগ নিরাময়, সঙ্কট দূরীকরণ প্রভৃতি। আমাদের দ্বীন আমাদেরকে এসব কিছু কেবল আল্লাহরই নিকট যাজ্ঞা করতে এবং শুধু কা’বারই তওয়াফ করতে আদেশ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, (وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ) অর্থাৎ, এবং তারা যেন প্রাচীন গৃহের তওয়াফ করে। (সূরা হজ ২৯ আয়াত)

২। মিসর ও দামেস্কে সাইয়েদা যয়নাব বিনতে আলীর দর্গা সত্য নয়। কারণ তাঁর মুত্যু না মিসরে হয়েছে না সিরিয়ায়। এর দলীল এই যে, উভয় স্থানেই তার দর্গা বিদ্যমান রয়েছে!!

৩। কবরের উপর গম্বুজ বা কুব্বা নির্মাণে এবং সত্যি হলেও মসজিদের ভিতর কবর দেওয়ায় ইসলাম স্বীকৃতি জানায় না। যেমন ইরাকে হুসাইনের, বাগদাদে আব্দুল কাদের জীলানীর, মিসরের শাফেয়ীর কবর রয়েছে, যাতে ইসলামের অনুমতি নেই। যেহেতু এ বিষয়ে সাধারণ নিষেধাজ্ঞা এসেছে - যেমন পুর্বেই উল্লেখিত হয়েছে।

এক সত্যবাদী আমাকে বর্ণনা করেন যে, তিনি এক ব্যক্তিকে কেবলার পরিবর্তে জীলানীর কবরের প্রতি সম্মুখ করে নামায পড়তে দেখলে তাঁকে নসীহত করেন। কিন্তু লোকটি তা উপেক্ষা করে তাকে বলে, তুমি ওয়াহাবী!’ যেন সে রসূল (সা.)-এর এই বাণী শুনেনি, “তোমরা কবরের উপর উপবেশন করো না এবং তার প্রতি সম্মুখ করে নামায পড়ো না।” (মুসলিম)

৪। মিসরের অধিকাংশ দর্গাসমূহকে ফাতেমিয়্যাহ[১] নামক সরকার নির্মাণ করেছে। ইবনে কাসীর তাঁর গ্রন্থ আল-বিদায়াহ অন নিহায়াহ’ ১১খন্ডের ৩৪৬ পৃষ্ঠায় তাদের প্রসঙ্গে বলেন, “(ফাতেমী শাসকগোষ্ঠী) কাফের, ফাসেক, পাপাচার, ধর্মধ্বজী, ধর্মদ্রোহী, আল্লাহর সিফাত (গুণাবলী) অস্বীকারকারী ও ইসলাম অস্বীকারকারী মজুসী ধর্ম-বিশ্বাসী ছিল।”

ঐ কাফেরদল তখন শঙ্কিত হল যখন দেখল যে, সমস্ত মসজিদ নামাযীতে পরিপূর্ণ হচ্ছে অথচ তারা নিজেরা নামায পড়ে না, হজ্জ করে না এবং মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। তাই তারা মানুষকে মসজিদ হতে বিমুখ করার জন্য ফন্দী আঁটল। নির্মাণ করল বহু গম্বুজ, দুর্গা এবং মিথ্যা মাযার; ধারণা করল যে, ঐ সবে হুসাইন বিন আলী এবং যয়নাব বিনতে আলী আছেন। দুর্গার দিকে মানুষকে আকর্ষণের উদ্দেশ্যে সেখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান (উরস, মেলা প্রভৃতি) উদ্যাপন আরম্ভ করল। এবং নিজেদের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে গুপ্ত থেকে নিজেদের নাম ‘ফাতেমী’ রাখল। অতঃপর মুসলিমরা তাদের নিকট হতে ঐ সমস্ত বিদআত গ্রহণ করল, যা তাদেরকে শির্কে নিপতিত করল এবং ঐ সবের পশ্চাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে লাগল। অথচ তাদের দ্বীন ও সম্ভ্রমের প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্র-শস্ত্র ক্রয় করতে ঐ অর্থ তাদের একান্ত প্রয়োজনীয় ছিল।।

৫। মুসলিমরা যে অর্থ দৰ্গা, মাযার, আস্তানা প্রভৃতি নির্মাণের উদ্দেশ্যে খরচ করে থাকে তা মৃত (সমাধিস্থ) ব্যক্তির কোন উপকার সাধন করে না। অথচ ঐ অর্থ যদি তারা দরিদ্রদেরকে দান করত, তাহলে জীবিত ও মৃত সকলেই উপকৃত হত। পরন্তু বিদিত যে, কবরের উপর ইমারত নির্মাণকে ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে; যেমন পুর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

মহানবী (সা.) আলী (রাঃ)-কে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “কোনও মুর্তি না ভেঙ্গে এবং কোন উচু কবর (ভূমি) বরাবর না করে ছেড়ো না।” (মুসলিম) (অর্থাৎ কোন সুউচ্চ কবর না ভেঙ্গে এবং ভূমি বরাবর সমান না করে ছেড়ো।) অবশ্য চেনার জন্য কবরকে বিঘত পরিমাণ উঁচু করতে ইসলাম অনুমতি দিয়েছে।।

৬। যে সমস্ত ন্যর-নিয়ায মৃতদের নামে পেশ করা হয় তা শির্কে আকবর। দর্গার খাদিমরা তা ভক্ষণ করে। হয়তো বা পাপাচারে ও প্রবৃত্তি পূজাতেও তা ব্যয় করে থাকে। যাতে ন্যর পেশকারী ও দাতা ঐ খাদিমের পাপের ভাগী হয়।

পক্ষান্তরে যদি সে ঐ অর্থ সকার নামে গরীবদেরকে দান করে, তাহলে মৃত ও জীবিত সকলেই উপকৃত হয় এবং সদকাদাতারও প্রয়োজন পূর্ণ হয়।

হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে সত্যকে সত্যরূপে দেখাও এবং তার অনুসরণ করার প্রেরণা দাও ও তার প্রতি আমাদের মাঝে প্রেম সৃষ্টি কর। আর বাতিলকে বাতিলরূপে দেখাও এবং তা বর্জন করার প্রেরণা দাও ও তার প্রতি আমাদের মাঝে ঘৃণা সৃষ্টি কর।

[১]. এদের আসল নাম ‘উবাইদিয়ুন। উবাইদ বিন সা’দ এর প্রতি সম্বদ্ধ। ইবনে কাসীর এই নামটি তাঁর গ্রন্থ আল-বিদাআহ অন-নিহায়াহ’ (১১/৩৪৬) তে উল্লেখ করেছেন।

ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে শির্কের বহু সংখ্যক বিপত্তি ও অপকারিতা রয়েছে। যার মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিপত্তিগুলো নিম্নরূপঃ

১- শির্ক মানবতার অপমান। শির্ক মানুষের সম্মানহানি করে এবং তার কদর ও মর্যাদা অধঃপাতিত করে দেয়। যেহেতু আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিরূপে প্রেরণ বা সৃষ্টি করেছেন, তাকে যথার্থ মর্যাদা দান করেছেন, যাবতীয় বিষয়ের নাম শিক্ষা। দিয়েছেন, তাঁর তরফ হতে তিনি তার জন্য আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সকল বস্তুকে অধীনস্থ করে দিয়েছেন এবং এ বিশ্বচরাচরের সকল কিছুর উপর তাকে কর্তৃত্ব দান করেছেন। কিন্তু সে আত্মমর্যাদা বিস্মৃত করে এই বিশ্বেরই কিছু

উপাদানকে নিজের পূজ্য উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে; যার সম্মুখে সে প্রণত ও অবনত হয়! এর চেয়ে মানুষের অধিক হীনতা আর কি হতে পারে যে, আজও পর্যন্ত কোটি-কোটি লোক গাভীর উপাসনা করে, যাকে আল্লাহ জীবিতাবস্থায় মানুষের সেবার জন্য এবং যবেহ করে তার মাংস ভক্ষণের জন্য সৃষ্টি করেছেন!

আবার কত শত মুসলিমকে আপনি দেখবেন তারা মৃতের কবরের উদ্দেশ্যে ধ্যানরত হয়। মূতের নিকট নিজেদের প্রয়োজন ভিক্ষা করে। অথচ তারাও তাদেরই মত আল্লাহর দাস, যারা নিজেদের মঙ্গলামঙ্গলের উপর কোন ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং হুসাইন (রাঃ) নিজের উপর থেকে হত্যা প্রতিহত করতে পারেন নি, অতএব অপরের নিকট থেকে বিপদ কিরূপে দূর করতে পারেন। এবং তার উপকার সাধন করতে পারেন?

পক্ষান্তরে পরলোকগত মানুষরা জীবিত মানুষদের দুআর মুখাপেক্ষী। সুতরাং আমরা তাদের জন্যই দুআ করব এবং আল্লাহর পরিবর্তে তাদের নিকটে দুআ (প্রার্থনা) করব না বা বিপদে তাদেরকে আহবান করব না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ لَا يَخْلُقُونَ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ * أَمْوَاتٌ غَيْرُ أَحْيَاءٍ ۖ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ

অর্থাৎ, ওরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে আহবান করে তারা কিছু সৃষ্টি করে না বরং তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়। তারা নিপ্রাণ এবং তাদেরকে কবে পুনরুত্থিত করা হবে সে বিষয়ে তাদের কোন চেতনা নেই। (সূরা নাহল ২০-২১ আয়াত)

তিনি আরো বলেন,

وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ

অর্থাৎ, এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর অংশী স্থাপন করে সে যেন আকাশ হতে পড়ে, অতঃপর পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় অথবা বায় তাকে উড়িয়ে নিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করে। (সূরা হজ্জ ৩১ আয়াত)

২ - শির্ক কুসংস্কার ও অমুলক বিশ্বাসের বাসা।

কারণ যে ব্যক্তি বিশ্বাস রাখে যে, এই বিশ্বে আল্লাহ ব্যতীত কোন নক্ষত্র, জিন, ব্যক্তিত্ব বা রূহেরও প্রভাব-ক্ষমতা আছে সে ব্যক্তির মন ও মস্তিষ্ক প্রত্যেক কুসংস্কারকে স্থান দেবার জন্য এবং প্রত্যেক দাজ্জাল ও প্রতারক ধর্মধজীকে বিশ্বাস করার জন্য প্রস্তুত থাকে। যার ফলে সমাজে শির্ক এবং আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানতে পারে না এমন গায়েবী (অদৃশ্য) খবরের দাবীদার গণক, ভবিষ্যদ্বক্তা, যাদুকর, জ্যোতিষী এবং অনুরূপ অন্যান্য মানুষদের বেসাতি বিস্তার লাভ করে। যেমন এই ধরনের পরিবেশে ঘটনার পশ্চাতে হেতু ও যুক্তি এবং সৃষ্টিগত নিয়মকে উপেক্ষা করার প্রবণতাও ব্যাপক আকার ধারণ করে।

৩ - শির্ক এক বড় অন্যায়। বাস্তবতা ও প্রকৃতত্বের প্রতি অন্যায়। যেহেতু সর্ববৃহৎ প্রকৃতত্ব এই যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ সত্য উপাস্য নেই, তিনি ব্যতীত কেউ প্রতিপালক ও প্রভু নেই এবং তিনি ছাড়া কেউ বিধানদাতা ও শাসক নেই। কিন্তু মুশরিক গায়রুল্লাহকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে এবং অপরকে বিধাতা মেনে থাকে।

শির্ক আত্মার প্রতি অন্যায়। যেহেতু মুশরিক নিজেকে তারই মত অথবা তার চেয়ে নিম্মমানের কোন সৃষ্টির দাস বানিয়ে দেয়। অথচ আল্লাহ তাকে স্বাধীনরূপে সৃষ্টি করেছেন। শির্ক অপরের প্রতি অন্যায়। যেহেতু যে ব্যক্তি আল্লাহর সহিত কাউকে অংশী স্থাপন করে, সে ব্যক্তি ঐ অংশীর প্রতি অন্যায় করে, কারণ সে তাকে সেই অধিকার দান করে যা তার প্রাপ্য নয়।

৪। শির্ক ভয় ও অমূলক ধারণা এবং সন্দেহের উৎপত্তিস্থল। যেহেতু যে ব্যক্তি বিভিন্ন কুসংস্কার গ্রহণ করবে এবং অদ্ভুত কর্মকান্ড বিশ্বাস করে নেবে সে নানান দিক থেকে ভীত-শঙ্কিত হবে। কারণ সে একাধিক উপাস্য ও প্রভুর উপর ভরসা রাখে, যাদের প্রত্যেকটাই নিজেদের স্বার্থেও মঙ্গল আনয়ন এবং অমঙ্গল দূরীকরণে অসমর্থ। যার কারণে শির্কী পরিবেশে বাহ্যিক কোন কারণ ব্যতিরেকেই অশুভ ধারণা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,

سَنُلْقِي فِي قُلُوبِ الَّذِينَ كَفَرُوا الرُّعْبَ بِمَا أَشْرَكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا ۖ وَمَأْوَاهُمُ النَّارُ ۚ وَبِئْسَ مَثْوَى الظَّالِمِينَ

অর্থাৎ, কাফেরদের অন্তরে আমি আতঙ্ক সঞ্চার করব, যেহেতু তারা আল্লাহর সহিত শির্ক (অংশী স্থাপন করেছে যার সপক্ষে আল্লাহ কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। জাহান্নাম তাদের নিবাস এবং অনাচারীদের আবাসস্থল অতি নিকৃষ্ট। (সূরা আলে ইমরান ১৫১ আয়াত)।

৫৷ শির্ক ফলপ্রসূ আমল (কর্ম) ব্যাহত করে। যেহেতু শির্ক তার অনুসারীদেরকে মাধ্যম ও সুপারিশকারীদের উপর ভরসা ও নির্ভর করতে শিক্ষা দেয়। ফলে তারা সৎকর্ম ত্যাগ করে বসে এবং পাপকর্মে লিপ্ত থাকে, আর বিশ্বাস এই রাখে যে, ওরা তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবে। এই বিশ্বাস ছিল ইসলামের পূর্বে আরবদের। যাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,

وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَٰؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِندَ اللَّهِ ۚ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ ۚ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ

অর্থাৎ, এবং ওরা আল্লাহর পরিবর্তে যার উপাসনা করে তা তাদের ক্ষতি করে না উপকারও করে না। (এই অন্যায় কাজের কৈফিয়ত হিসেবে) ওরা বলে, 'এগুলি আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী।” বল, তোমরা কি আল্লাহকে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর এমন কিছুর সংবাদ দেবে যা তিনি জানেন না? তিনি মহান পবিত্র এবং ওদের শির্ক হতে তিনি বহু ঊর্ধ্বে। (সূরা ইউনুস ১৮)

ঐ খ্রিষ্টানরা, যারা বিশ্বাস রাখে যে, মাসীহকে যখন ক্রুশবিদ্ধ করা হয় যেমন ওরা মনে করে তখন তিনি তাদের সমস্ত পাপ স্খলন বা ক্ষমা করে গেছেন। ফলে তারা বিভিন্ন অসৎ ও নোংরা কর্ম এই বিশ্বাসে করে থাকে। কিছু মুসলিমও আছে, যারা ওয়াজেব কর্মাদি ত্যাগ করে ও হারাম কর্মাদি করে থাকে আর জান্নাত প্রবেশের জন্য তাদের রসূলের ‘শাফাআত’ (সুপারিশের) উপর ভরসা রাখে। অথচ রসূল কারীম (সা.) তার কন্যা ফাতেমার উদ্দেশে বলেন, “হে মুহাম্মাদের বেটী ফাতেমা! আমার সম্পদ হতে যা তোমার ইচ্ছা চেয়ে নাও, আমি আল্লাহর দরবারে তোমার কোন উপকার করতে পারব না।” (বুখারী)

৬। শির্ক চিরকাল জাহান্নামে স্থায়ী হওয়ার কারণ। শির্ক পৃথিবীতে মানুষের ভ্রষ্ট হওয়ার এবং আখেরাতে চিরস্থায়ী আযাব উপভোগের কারণ। আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّهُ مَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ ۖ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ

অর্থাৎ, যে আল্লাহর সহিত শির্ক করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত নিষিদ্ধ করে দেবেন, তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম এবং অনাচারীদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়েদাহ ৭২ আয়াত)

রসূল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে (স্থাপিত) কোন শরীককে ডাকা অবস্থায় মারা যাবে সে জাহান্নাম প্রবেশ করবে।” (বুখারী) উক্ত হাদীসে নিদ্দ্‌ (সমকক্ষ) এর অর্থ ও সমতুল ও অংশী।

৭। শির্ক উম্মাহকে বিচ্ছিন্ন করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ * مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا ۖ كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ

অর্থাৎ, তোমরা মুশরিকদের দলভুক্ত হয়ো না; যারা তাদের দ্বীনকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। প্রত্যেক দল নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে সন্তুষ্ট। (সূরা রূম ৩১ আয়াত)*

(সারকথা )

পূর্ববর্তী পরিচ্ছেদগুলি একথাই সুস্পষ্টরূপে নির্দেশ করে যে, শির্ক এমন এক ভয়ানক আপদ যা থেকে বাচা, সুদূরে থাকা এবং তাতে আপতিত হওয়ার ভয় করা ওয়াজেব। কারণ শির্ক সর্বাপেক্ষা বড় পাপ; যা বান্দার কৃত সমস্ত সৎকর্মকে পণ্ড ও ধ্বংস করে ফেলে -যে কর্ম জাতীয় কল্যাণ ও মানবিক সেবার উপযোগী হলেও হতে পারে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَقَدِمْنَا إِلَىٰ مَا عَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَّنثُورًا

অর্থাৎ, আমি ওদের (মুশরিকদের) কৃতকর্মের প্রতি অভিমুখ করে তা উড়ন্ত ধূলিকণার ন্যায় (নিষ্ফল) করে ফেলব। (সূরা ফুরকান ২৩ আয়াত)

(শায়খ আব্দুল্লাহ আব্দুল গনী খাইরাত্ব এর পুস্তক “দলীলুল মুসলিম ফিল ইতিকাদ’ হতে সমুদ্ভূত।)

* ডক্টর ইউসূফ কারযাবীর গ্রন্থ ‘হাক্বীক্বাতুত তাওহীদ’ হতে সংক্ষিপ্তভাবে সংগৃহীত।
দেখানো হচ্ছেঃ ২১ থেকে ৩০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৫৭ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 5 6 পরের পাতা »