ফির্‌কাহ নাজিয়া আবদুল হামীদ ফাইযী ৫৭ টি
ফির্‌কাহ নাজিয়া আবদুল হামীদ ফাইযী ৫৭ টি

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যখন তুমি কিছু চাইবে তখন আল্লাহরই নিকট চাও। এবং যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহরই নিকট কর।” (তিরমিযী এবং তিনি হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।)

১। ইমাম নববী ও হাইতামী এই হাদীসের ব্যাখ্যায় যা বলেন তার সারাংশ এই যে, যখন তুমি তোমার ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কোন বিষয়ে সাহায্য চাইবে তখন আল্লাহরই নিকট চাও। বিশেষ করে সেই সকল বিষয়ে আল্লাহর নিকট সাহায্য-ভিক্ষা কর, যে সব বিষয়ে তিনি ব্যতীত অন্য কেউ সাহায্য করতে সক্ষম নয়। যেমন, রোগ-নিরাময়, রুজী ও হেদায়াত প্রার্থনা প্রভৃতি; যে সব দান কেবল আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَإِن يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ

অর্থাৎ, আর যদি আল্লাহ তোমাকে ক্লেশ দান করেন, তবে তিনি ব্যতীত আর কেউ তার মোচনকারী নেই। (সূরা আনআম ১৭ আয়াত)

২। যে ব্যক্তি হুজ্জত ও দলীল চায় তার জন্য কুরআন যথেষ্ট, যে ব্যক্তি রক্ষা ও সাহায্যকারী চায় তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, যে ব্যক্তি উপদেষ্টা চায় তার জন্য মৃত্যুই যথেষ্ট। আর যে ব্যক্তির জন্য এ সবের কিছুই যথেষ্ট নয়, তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেন, (أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ) অর্থাৎ-আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন? (সূরা যুমার ৩৬ আয়াত)

৩। শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী আল-ফাতহুর রাব্বানী’তে বলেন, “আল্লাহর নিকটেই প্রার্থনা কর এবং তিনি ব্যতীত অন্যের নিকট প্রার্থনা করো

ও কেবল আল্লাহর নিকটেই সাহায্য চাও এবং তিনি ব্যতীত আর কারো নিকট সাহায্য চেয়ো না। ধিক তোমাকে! তুমি কোন মুখ নিয়ে কাল তার সহিত সাক্ষাৎ করবে, অথচ দুনিয়াতে তুমি তার বিরুদ্ধে কলহে লিপ্ত রয়েছ, তার থেকে বিমুখ রয়েছ, তার সৃষ্টির মুখাপেক্ষী হচ্ছ, তার সহিত তাদেরকে শরীক (শির্ক) করছ, তাদের নিকট নিজের প্রয়োজন ভিক্ষা করছ এবং সংকটাপন্ন কর্মসমুহে তাদের উপর ভরসা করছ?! তোমাদের এবং আল্লাহর মাঝে সমস্ত মাধ্যম ও অসীলা তুলে ফেল; কারণ ওদের সহিত তোমাদের অবস্থান (বা ওদের পিছন ধরে থাকা) মুখতা। একমাত্র ‘হক’ (সত্য) আল্লাহ আযযা অজাল্ল ব্যতীত আর কারো জন্য কোন রাজত্ব, কোন আধিপত্য, কোন স্বনির্ভরতা, কোন সম্মান নেই। সৃষ্টিকে ছেড়ে স্রষ্টা হকে’র দিকে হয়ে যাও। (অর্থাৎ, আল্লাহর সৃষ্টির মধ্য হতে কাউকে মাধ্যম না করেই সরাসরি তাকে ডেকে তার দিকে হয়ে যাও।)”

৪। বিধিসম্মত সাহায্য ভিক্ষা এই যে, নিজের বিপদ ও সংকট দূর করার জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য চাওয়া। আর অবৈধ শির্কী সাহায্য ভিক্ষা এই যে, বিপদ দূর করার জন্য গায়রুল্লাহ; যেমন, আম্বিয়া, মৃত অথবা জীবিত আওলিয়ার-নিকট সাহায্য চাওয়া। যেহেতু তারা ইষ্ট বা অনিষ্ট কিছুরই মালিক নন এবং তারা প্রার্থনা শুনতেও পান না। পক্ষান্তরে যদি শুনতেও পান তথাপিও তাঁরা আমাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করতে পারেন না। যেমন এ বিষয়ে কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। (সূরা ফাত্রির ১৪ আয়াত দ্রঃ)

পরন্তু উপস্থিত জীবিত ব্যক্তিবর্গের নিকট তাদের সাধ্যভূক্ত কর্মে; যেমন, মসজিদ নির্মাণ, আর্থিক অনটন প্রভৃতিতে সাহায্য প্রার্থনা করা বৈধ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ

অর্থাৎ, তোমরা সৎ ও আল্লাহ-ভীতির কর্মে একে অন্যের সহায়তা কর। (সূরা মায়েদাহ ২ আয়াত)

আর মহানবী (সা.) বলেন, “আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভায়ের সাহায্যে থাকে।” (মুসলিম)

উপস্থিত জীবিত ব্যক্তির নিকট সাহায্য প্রার্থনা করার আরো দৃষ্টান্ত; যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَاسْتَغَاثَهُ الَّذِي مِن شِيعَتِهِ عَلَى الَّذِي مِنْ عَدُوِّهِ

অর্থাৎ, মুসার দলের লোকটি ওর শত্ৰুদলের লোকটির বিরুদ্ধে তার (মুসার) সাহায্য প্রার্থনা করল। (সূরা কাসাস ১৫ আয়াত)

ইয়াজুজ ও মাজুজের ক্ষতি হতে বাঁচতে প্রাচীর নির্মাণকল্পে লোকদের নিকট যুল ক্বারনাইনের শ্রম চাওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ বলেন,

فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ

অর্থাৎ, (যুল ক্বারনাইন বলল,) ---সুতরাং তোমরা আমাকে শ্রম দ্বারা সাহায্য কর।' (সূরা কাহফ ৯৫ আয়াত)।

বহু সংখ্যক আয়াত, হাদীস এবং সলফের উক্তি আল্লাহর সৃষ্টির উর্ধে থাকার কথা প্রমাণ করে।

১। আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَالْعَمَلُ الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ

অর্থাৎ, তাঁর প্রতিই সৎবাক্য আরোহণ করে এবং সৎকর্মকে তিনি উখিত করেন। (সূরা ফাতুির ১০ আয়াত)

২। তিনি আরো বলেন,

ذِي الْمَعَارِجِ تَعْرُجُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ

অর্থাৎ, ---যিনি সোপান-শ্রেণীর মালিক। ফিরিস্তা এবং রূহ তাঁর প্রতি ঊর্ধ্বগামী হবে---। (সূরা মাআরিজ ৩-৪ আয়াত)

৩। তিনি অন্যত্রে বলেন, (سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى) অর্থাৎ, তুমি তোমার সুউচ্চ প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘোষণা কর। (সূরা আ’লা ১ আয়াত)

৪। বুখারী (তার সহীহ গ্রন্থে) কিতাবুত তাওহীদে আবুল আলিয়াহ ও মুজাহিদ হতে (নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছেনঃ (ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ) (অতঃপর তিনি আকাশের প্রতি আরোহণ করেন) অর্থাৎ উর্ধে হন এবং উপরে উঠেন।

৫। আল্লাহ তাআলা বলেন, (الرَّحْمَٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَىٰ) অর্থাৎ, দয়াময় আরশে আরোহণ করলেন। (সূরা ত্বা-হা ৫ আয়াত)* এর অর্থও (তিনি আরশের) ঊর্ধ্বে আছেন এবং (তার উপরে) উঠেছেন; যেমন তফসীরে ত্বাবারীতে এ কথার উল্লেখ এসেছে।

৬। বিদায়ী হজ্জে আরাফার দিনে আল্লাহর রসূল (সা.) তার ভাষণে বলেন, “শুনো! আমি কি পৌছে দিলাম?” সকলে বলল, 'হ্যা। (অতঃপর) তিনি আকাশের দিকে অঙ্গুলী উত্তোলন করে এবং সকলের প্রতি তা নত করে বলেন, “হে আল্লাহ সাক্ষী থাকুন।” (মুসলিম)

৭। প্রিয় নবী (সা.) আরো বলেন, “আল্লাহ সৃষ্টি সৃজন করার পুর্বে এক কিতাব লিখেছেন। (যাতে আছে) আমার ক্রোধ অপেক্ষা আমার করুণা অগ্রগামী।” সুতরাং তা তার নিকট আরশের উপর লিপিবদ্ধ রয়েছে।”

৮। “তোমরা আমাকে বিশ্বাস কর না কি? অথচ আমি তার নিকট বিশ্বস্ত যিনি আকাশে আছেন। আমার নিকট সকাল ও সন্ধ্যায় আকাশের খবর । আসে।” (বুখারী ও মুসলিম)

৯। ইমাম আওযায়ী বলেন, বহু সংখ্যক তাবেঈন বর্তমান থাকা কালীন সময়েও আমরা বলতাম, “আল্লাহ জাল্লা যিকরুহ আরশের উপরে আছেন। তার যে সমস্ত সিফাত (গুণাবলী)র বর্ণনা সুন্নাহতে (হাদীসে) এসেছে আমরা। তাতে ঈমান (বিশ্বাস) রাখি। (এটিকে বাইহাক্বী সহীহ সনদ দ্বারা বর্ণনা করেছেন, দেখুন ফতহুল বারী)।

১০। ইমাম শাফেয়ী বলেন, 'আল্লাহ তাআলা আকাশে আরশের উপর আছেন। যেভাবে ইচ্ছা তিনি সৃষ্টির নিকটবর্তী হন এবং আল্লাহ যেভাবে চান। পৃথিবীর আকাশের প্রতি অবতরণ করেন। (এটিকে হাকাব ‘আকীদাতুশ শাফেয়ী’তে বর্ণনা করেছেন।}

১১। ইমাম আবু হানীফাহ বলেন, যে ব্যক্তি বলে যে, জানি না আমার প্রতিপালক আকাশে আছেন নাকি পৃথিবীতে সে অবশ্যই কাফের হয়ে যায়। যেহেতু আল্লাহ বলেন, (الرَّحْمَٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَىٰ)। অর্থাৎ, “দয়াময় আরশে আরোহণ করলেন।” আর তার আরশ সপ্তাকাশের উপরে। আবার সে যদি বলে, তিনি আরশের উপরেই আছেন, কিন্তু বলে, জানি না যে, আরশ আকাশে আছে নাকি পৃথিবীতে’-তাহলেও সে কাফের। কারণ সে একথা অস্বীকার করে যে তিনি আকাশে আছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তার আকাশে থাকার কথা অস্বীকার করে সে অবশ্যই কাফের হয়ে যায়। যেহেতু আল্লাহ সকল সৃষ্টির উর্ধে আছেন এবং উপর দিকে মুখ করেই তাঁকে ডাকা হয় (দুআ করা হয়), নিচের দিকে মুখ করে নয়।' (শারহুল আকীদাতিত্ব তাহাবিয়্যাহ ৩১২ পৃঃ)

১২। আল্লাহ কিভাবে আরশে সমারূঢ়?’ -এ বিষয়ে ইমাম মালেক জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলেছিলেন, 'আরোহণ করা বিদিত, এর কেমনত্ব অবিদিত, এর প্রতি ঈমান (বিশ্বাস) রাখা ওয়াজেব এবং এর কেমনত্ব প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলা বিদআত। আর এই (প্রশ্নকারী) বিদআতীকে (আমার মজলিস থেকে) বের করে দাও।

১৩। (استوى) ইসতাওয়া (আরোহণ করেছেন) এর তফসীর ও ব্যাখ্যা (استولي) ‘ইসতাওলা’ (ক্ষমতাসীন বা আধিপত্য বিস্তার করেছেন) করা বৈধ নয়। কারণ এরূপ ব্যাখ্যা সলফ কর্তৃক বর্ণিত হয়নি। আর তাদের নীতি ও পথ অধিকতম নিরাপদ, নিখুঁত, জ্ঞানগর্ভ, বলিষ্ট ও প্রজ্ঞাময়।

ইবনুল কাইয়েম আল-জাওযিয়্যাহ বলেন, “আল্লাহ ইয়াহুদকে (حطة) ‘হিত্তাহ’ বলতে আদেশ করেছিলেন, কিন্তু ইয়াহুদ তা বিকৃত করে (حنطة) হিনত্বাহ’ বলেছিল। আল্লাহ আমাদেরকে জানিয়েছেন যে তিনি (استوي علي العرش) 'ইসতাওয়া আলাল আরশ' (আরশে আরোহণ করেন)। কিন্তু অপব্যাখ্যাকারীরা বলে, (استولي) ‘ইসতাওলা’ (ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তার করেন)! সুতরাং লক্ষ্য করুন, এদের বর্ধিত ل এর সহিত ইয়াহুদীদের বর্ধিত ن এর কি সুন্দর মিল রয়েছে!!” (এটিকে মুহাম্মাদ আল আমীন শানকীত্বী ইবনে কাইয়েম আল-জাওযিয়্যাহ থেকে নকল করেছেন)।

* আরশে আরোহণ করার কথা কুরআনে ৭ বার পুনরাবৃত্তি হয়েছে, যা এ বিষয়ে গুরুত্ব নির্দেশ করে।

১। আল্লাহ বিশ্বজগৎ রচনা করেছেন তার ইবাদতের জন্য। তিনি বহু রসূল প্রেরণ করেছেন মানুষকে তার তওহীদ (একত্ববাদের) প্রতি আহবান করার জন্য। কুরআন কারীম তার অধিকাংশ সূরাসমূহে তওহীদের আকীদাহ বর্ণনায় যত্নবান। বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তি ও সমাজের জন্য শির্কের অপকারিতা বিবৃত করেছে, যে শির্ক ইহকালে মানুষের ধ্বংসের এবং পরকালে জাহান্নামে চিরস্থায়ী হওয়ার কারণ।

২। সমস্ত রসূল প্রথমে তওহীদের দিকেই মানুষকে আহবান (দাওয়াত) করতে শুরু করেছেন; যে তওহীদ লোকমাঝে প্রচার ও তবলীগ করার জন্য আল্লাহ তাদেরকে আদেশ করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ

অর্থাৎ, আমি তোমার পুর্বে যে রসূলই প্রেরণ করেছি তার প্রতি এই প্রত্যাদেশই করেছি যে, আমি ছাড়া অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। সুতরাং তোমরা আমারই উপাসনা কর।” (সূরা আম্বিয়া ২৫ আয়াত)

আমাদের প্রিয় নবী (সা.) মক্কায় ২৩ বছর অবস্থান করে নিজ সম্প্রদায়কে আল্লাহর তওহীদ এবং সব কিছু ত্যাগ করে কেবল তাকেই ডাকা (ও কেবল তারই নিকট প্রার্থনা করা)র প্রতি আহবান করেন। তাঁর প্রতি আল্লাহর অবতীর্ণ প্রত্যাদেশ ছিল,

قُلْ إِنَّمَا أَدْعُو رَبِّي وَلَا أُشْرِكُ بِهِ أَحَدًا

অর্থাৎ, বল, আমি কেবল আমার প্রতিপালককেই ডাকি এবং তার সহিত কাউকে শরীক করি না।' (সূরা জিন ২০ আয়াত)।

রসূল (সা.) তার অনুসারীবর্গকে শুরু ও শৈশব থেকেই তওহীদের উপর তরবিয়ত ও ট্রেনিং দিতে থাকলেন। তাই তো তিনি কিশোর পিতৃব্য-পুত্র আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস -কে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “যখন তুমি চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চেয়ো এবং যখন তুমি সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহর নিকটেই সাহায্য প্রার্থনা করো।” (তিরমিযী)।

এই তওহীদই হল দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয় এবং তার বুনিয়াদ। যে। তওহীদ ব্যতিরেকে আল্লাহ অন্য কিছু কারো নিকট হতে গ্রহণ করবেন না।

৩। রসূল (সা.) নিজ সাহাবা ও সহচরবৃন্দকে শিখিয়ে ছিলেন যে, তারা যেন মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার সময় তওহীদকে সর্বাগ্রে পেশ করে। তাই মুআয (রাঃ)-কে ইয়ামান প্রেরণ করার সময় বলেছিলেন, “তাদেরকে তোমার দাওয়াতের প্রথম পর্যায় যেন “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ” (আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্য মাবুদ নেই) এর সাক্ষ্যদান হয়।” অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, “(তোমার প্রথম দাওয়াত যেন) আল্লাহর তওহীদের প্রতি হয়।” (বুখারী ও মুসলিম)

৪। “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদূর রাসুলুল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য মাবুদ নেই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রসূল বা দূত) এই বাণীর সাক্ষ্য দানে তওহীদের প্রকৃত রূপ প্রস্ফুটিত হয়। এ বাণীর অর্থ হল, আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই এবং আল্লাহর রসূলের আনীত বিষয় ব্যতীত অন্য কিছু ইবাদত বা উপাসনা নয়। এই সেই বাণী ও সাক্ষ্য যার দ্বারা কাফের ইসলামে প্রবেশ করতে পারে। যেহেতু এই কলেমাই হচ্ছে জান্নাতের কুঞ্চিকা। এই কলেমা তার পাঠকারীকে জান্নাতে প্রবেশ করায় যদি সে নিজ কর্ম দ্বারা তা পণ্ড করে তবে।

৫। কুরাইশের কাফের দল রসূল (সা.) এর নিকট তওহীদের দাওয়াত ও মুর্তির বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য ত্যাগ করার বিনিময়ে রাজ-সিংহাসন, অর্থ, বিবাহের জন্য সুন্দরীশ্রেষ্ঠা রমণী পেশ করেছিল। কিন্তু এতে তিনি সম্মত না হয়ে নিজ দাওয়াতে অটল ও নির্বিচল থাকলেন এবং নিজ সাহাবাবৃন্দ সহ নানা কেশ সহ্য করলেন। অতঃপর ১৩ বছর পরে তওহীদের দাওয়াত বিজয়ী। হল। এর পর মক্কা বিজয় হল এবং প্রতিমা ধ্বংস করা হল; যখন তিনি এই আয়াত পাঠ করেছিলেন,

جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ ۚ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا

অর্থাৎ, সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, নিশ্চয় মিথ্যা বিলীয়মান। (সূরা ইসরা’ ৮১ আয়াত)

৬। তওহীদ মুসলিমের জীবনে এক প্রধান কর্ম ও সাধনা। তাই তার জীবন শুরু করে তওহীদ দ্বারা আর তওহীদের মাধ্যমেই জীবনকে বিদায় করে। জীবনে তার ব্রত হল, তওহীদ প্রতিষ্ঠা এবং তওহীদের প্রতি মানুষকে আহবান। যেহেতু তওহীদই মুমিন সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং তওহীদী বাণীর পতাকাতলে মানুষকে সমবেত করে।।

আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন কলেমা তওহীদকে ইহলোক ত্যাগের সময় আমাদের শেষ বাক্য করেন। (আমীন)।

১। আল্লাহ তাআলা বলেন,

الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ أُولَٰئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُونَ

অর্থাৎ, যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলম দ্বারা কলুষিত করেনি, তাদের জন্যই নিরাপত্তা এবং তারাই সৎপথপ্রাপ্ত। (সূরা আনআম ৮২ আয়াত)।

আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন। এই আয়াত যখন অবতীর্ণ হল, তখন মুসলিমদের নিকট বিষয়টি কঠিন মনে হল। বলল, ‘আমাদের মধ্যে কে আছে যে নিজের উপর যুলম (অন্যায়) করে না?” তা শুনে রসূল প্রিন্ট বললেন, তোমরা যে যুম মনে করছ) তা নয়। বরং তা (সবচেয়ে বড় যুগ্ম) কেবলমাত্র শির্ক। তোমরা কি পুত্রকে সম্বোধন করে লুকমানের উক্তি শ্রবণ করনি? (তিনি তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন),

يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ ۖ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ

অর্থাৎ, হে বৎস! আল্লাহর সহিত শির্ক করো না, নিশ্চয় শির্ক বড় যুলম। (বুখারী ও মুসলিম)

অত্র আয়াতটি সেই তওহীদবাদী মুসলিমদেরকে সুসংবাদ দেয়, যারা তাদের ঈমানকে শির্ক দ্বারা কলুষিত করেনি। সেই সুসংবাদ এই যে, তাদের জন্য রয়েছে পরকালে আল্লাহর শাস্তি হতে পূর্ণ নিরাপত্তা এবং তারাই ইহকালে সুপথ প্রাপ্ত।

২। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “ঈমান যাঠাধিক শাখাবিশিষ্ট। এর সর্বোত্তম শাখা লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ব্যতীত কেউ সত্য উপাস্য নেই) বলা এবং সর্বনিম্ন শাখা পথ হতে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করা।” (মুসলিম)।

৩। মহামান্য শায়খ আব্দুল্লাহ খাইয়াত্বের গ্রন্থ “দলীলুল মুসলিম ফিল ইতিক্বাদি অত্তাত্বহীর”-এ নিম্নরূপ বলা হয়েছেঃ

তওহীদ সুখের মূল কারণ এবং পাপ খালনকারী কোন ব্যক্তি যেহেতু সে মানুষ এবং নিষ্পাপ নয়- সেহেতু তার পদস্খলন ঘটতেই পারে ও আল্লাহর অবাধ্যাচরণে আপতিত হতেই পারে। পরন্তু সে যদি শির্কের কলুষমুক্ত বিশুদ্ধ তওহীদবাদী হয়, তাহলে তার আল্লাহর জন্য তাওহীদ এবং “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলায় তার ইখলাস (বিশুদ্ধ-চিত্ত) তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, পাপ মোচন এবং গোনাহর প্রায়শ্চিত্তের বৃহত্তম সহায়ক হবে। যেমন হাদীস শরীফে রসূল (সা.) এক্স বলেন, “যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ (সত্য) উপাস্য নেই, তিনি একক, তার কোন অংশী নেই, মুহাম্মাদ তাঁর দাস ও দুত (রসূল), ঈসাও আল্লাহর দাস, দুত এবং তার বাণী যা মারয়্যামের প্রতি প্রক্ষিপ্ত হয়েছিল এবং তাঁর তরফ হতে (বিশিষ্ট) রূহ, জান্নাত সত্য এবং জাহান্নাম সত্য - সে ব্যক্তি যে আমলই করে থাকুক, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।” (বুখারী ও মুসলিম)

অর্থাৎ, এই সাক্ষ্যবাণীর সমষ্টি যা মুসলিম উক্ত মৌলিক বিষয়সমূহ উল্লেখ করে উচ্চারিত করে থাকে তা তার সুখদায়ক জান্নাত প্রবেশের কারণ অবশ্যই হবে- যদিও তার কিছু কর্ম ত্রুটি ও অবহেলাপূর্ণ হয়। যেমন হাদীসে কুদসীতে এর বর্ণনা এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে আদম সন্তান! তুমি যদি প্রায় পৃথিবী-পুর্ণ পাপ নিয়ে আমার নিকট উপস্থিত হও আর আমার সহিত কোন কিছুকে শরীক না করে আমার সাথে সাক্ষাৎ কর, তবে আমিও প্রায় পৃথিবীবরাবর ক্ষমা নিয়ে তোমার নিকট উপস্থিত হব।” (হাসান, তিরমিযী ও যিয়া)

অর্থাৎ, তুমি যদি প্রায় পৃথিবী-পুর্ণ পাপ ও অন্যায় করে থাক, কিন্তু তোমার মরণ তওহীদের উপর হলে আমি তোমার সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেব।

অন্য এক হাদীসে এসেছে যে, “যে ব্যক্তি কোন কিছুকে আল্লাহর শরীক না করে তার সহিত সাক্ষাৎ করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং যে ব্যক্তি কোন কিছুকে আল্লাহর শরীক করে তাঁর সহিত সাক্ষাৎ করে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (মুসলিম)

উক্ত হাদীসসমূহের প্রত্যেকটি হতে তওহীদের মাহাত্ম ও গুরুত্ব প্রতীয়মান হয় এবং এ কথা স্পষ্ট হয় যে, তওহীদ বান্দার চিরসুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য লাভের বৃহত্তম সহায়ক এবং পাপক্ষালনের শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম।

ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে বিশুদ্ধ তওহীদ বাস্তবায়িত হলে তাতে উৎকৃষ্টতম ফল লাভ হয়। এর কিছু ফল নিম্নরূপ :

১। আল্লাহ ছাড়া বিভিন্ন বস্তু, ব্যক্তি বা সৃষ্টির পদানতি ও দাসত্ব থেকে মানুষের মুক্তি'; যে সৃষ্টি কোন কিছু সৃজন করতে পারে না বরং তারা নিজেই সৃষ্ট; যারা নিজেদের মঙ্গলামঙ্গলের মালিক নয় এবং জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের উপরেও কোন ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং তওহীদ সুঠাম আকৃতিতে সৃষ্টিকর্তা প্রতিপালক ছাড়া অন্য সকল কিছুর দাসত্ব হতে মানুষকে স্বাধীনতা দান করে। বাতিল চিন্ত-ধারা ও কুসংস্কার হতে মস্তিষ্ক মুক্ত করে। পদানতি, হীনতা ও পরবশ্যতা হতে হৃদয়-মনকে অব্যাহতি দেয় এবং সর্বপ্রকার ফেরাউন, বাতিল প্রভু, গণকদল ও আল্লাহর বান্দাদের উপর খোদায়ী দাবীদারদের আধিপত্য। হতে মানব জীবনকে নিস্কৃতি দেয়। তাই তো মুশরিক (অংশীবাদী)দের দলপতিরা এবং জাহেলিয়াতের দুর্দম স্বেচ্ছাচারীরা সাধারণভাবে সকল আম্বিয়ার ও বিশেষভাবে শেষ রসূল (সা.) এর দাওয়াতের ঘোর বিরোধিতা করেছে এবং তা প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। যেহেতু তারা জানত যে, ‘লা ইলাহার অর্থই হচ্ছে মানুষের মুক্তি, মিথ্যা সিংহাসন হতে পরাক্রমশালীদেরকে বিচ্যুতকরণ এবং মুমিনদের সেই ললাটসমুহ সুউন্নতকরণের এক সাধারণ ঘোষণা, যে ললাটসমূহ একমাত্র বিশ্বজাহানের মহান প্রতিপালক ছাড়া অন্য কিছুর নিকট অবনত হয় না।

২। ভারসাম্যপূর্ণ সুসমঞ্জস ব্যক্তিত্ব গঠন। তওহীদ সুসমঞ্জস ব্যক্তিত্ব-গঠনে। সহায়তা করে; যে ব্যক্তিত্বের গতিমুখ ও লক্ষ্য জীবনে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং যার উদ্দেশ্য ও গন্তব্যস্থলও একটাই। তাই তার একক উপাস্য ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই। নির্জনে ও প্রকাশ্যে সে যার অভিমুখী এবং সুখে ও দুখে যাকে সে আহবান করে থাকে। পক্ষান্তরে মুশরিক, যার অন্তরকে অসংখ্য উপাস্য ও মাবুদ বিভক্ত করে নিয়েছে। ফলে কখনো সে জীবিতের মুখাপেক্ষী হয় আবার কখনো মৃতের। এরই দিকে লক্ষ্য করে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম বলেছিলেন,

يَا صَاحِبَيِ السِّجْنِ أَأَرْبَابٌ مُّتَفَرِّقُونَ خَيْرٌ أَمِ اللَّهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ

অর্থাৎ, হে কারা-সঙ্গীদ্বয়! ভিন্ন ভিন্ন একাধিক প্রতিপালক শ্রেয়, নাকি এক পরাক্রমশালী আল্লাহ? (সূরা ইউসুফ ৩৯ আয়াত)

সুতরাং মুমিন একই উপাস্যের উপাসনা করে। সে জানে যে, কি তাকে সন্তুষ্ট করে এবং কি অসন্তুষ্ট করে। তাই সে ঐ কর্মই করে, যাতে তিনি সন্তুষ্ট এবং এতে তার হৃদয় প্রশান্ত থাকে। আর মুশরিক বহু সংখ্যক মাবুদের ইবাদত করে; একজন তাকে ডানে নিয়ে যেতে চায় এবং অপরজন বামে। ফলে সে সবার মাঝে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ও অস্বচ্ছন্দ হয়ে পড়ে, যার কোন স্থিরতা থাকে না।

৩। তওহীদ নিরাপত্তার উৎস। যেহেতু তওহীদ তওহীদবাদীর হৃদয়কে নিরাপত্তা ও শান্তিতে পরিপূর্ণ করে দেয়। তাই সে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেও ভয় করে না। রুজী-রুটি, নিজের আত্মা ও আত্মীয়-পরিজনের উপর ভয়ের সমস্ত ছিদ্রপথ সে বন্ধ করে থাকে। মানুষ, জিন, মৃত্যু ইত্যাদি হতে ভয় এবং আরো অন্যান্য সকল ভয় হতে সে নির্ভয় থাকে। কারণ তওহীদবাদী মুমিন একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেও ভয় করে না। তাই আপনি তাকে দেখবেন যে, মানুষ যখন ভীত-সন্ত্রস্ত তখন সে অকুতোভয় এবং সকলে যখন উদ্বিগ্ন ও অস্থির তখন সে প্রশান্ত ও স্থিরচিত্ত।

এই অর্থের প্রতিই কুরআন করীমে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ أُولَٰئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُونَ

অর্থাৎ, যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে অন্যায় (শিক) দ্বারা কলুষিত করেনি তাদের জন্যই তো রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই সুপথপ্রাপ্ত। (সূরা আনআম ৮২ আয়াত)

অবশ্য এই নির্বিঘ্নতা চিত্তের অভ্যন্তর হতে নিঃসৃত ও অনুভূত হয়, প্রহরীর প্রহরা হতে নয়। আর এটা হল ইহলৌকিক নিরাপত্তা। পরন্তু পারলৌকিক নিরাপত্তা তো সর্ববৃহৎ ও চিরস্থায়ী। কারণ তারা কেবল আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ ও বিশুদ্ধ-চিত্ত এবং তারা তাদের তওহীদকে শির্কের কলুষ দ্বারা সংমিশ্রিত করেনি। যেহেতু শির্ক করা বড় যুম্ন।

৪। তওহীদ আত্মিক শক্তির উৎপত্তিস্থল। যেহেতু তওহীদ তওহীদবাদীকে দুর্দান্ত আধ্যাত্মিক ও সামাজিক বল দান করে। কারণ তার আত্মা-মন আল্লাহর সকাশে আশা, আস্থা, ভরসা, তার লিখিত ভাগ্যের উপর সন্তুষ্টি, তাঁর তরফ হতে আগত বিপদের উপর ধৈর্য, তার সৃষ্টি হতে অমুখাপেক্ষিতা দ্বারা পরিব্যাপ্ত। তাই সে পর্বতের ন্যায় সুদৃঢ় অটল। পরন্তু যখন তার উপর কোন বিপদ আসে তখন সে স্বীয় প্রভুর নিকট তা হতে উদ্ধার চায়। আর কোন মৃতের নিকট বিপদ মুক্তি চায় না। যেহেতু তার আদর্শ বচন হল, নবী (সা.) ঐক-এর এই বাণী “যখন তুমি কিছু চাইবে তখন আল্লাহরই নিকট চাও এবং সাহায্য। প্রার্থনা করলে আল্লাহরই নিকট কর।” (তিরমিযী, তিনি বলেন, হাসান সহীহ) এবং আল্লাহ তাআলার এই বাণী,

وَإِن يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ

অর্থাৎ, আর আল্লাহ যদি তোমাকে বিপদে ফেলেন তাহলে তিনি ছাড়া তা মোচনকারী আর কেউ নেই। (সূরা আনআম ১৭ আয়াত)

৫। তওহীদ ভ্রাতৃত্ব এবং সাম্যের মূল ভিত্তি। যেহেতু তওহীদ তওহীদবাদীদেরকে একথার অনুমতি দেয় না যে, তারা আল্লাহকে ছেড়ে একে অপরকে নিজেরদের প্রভু বানিয়ে নিক। কারণ উপাস্যত্বের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ এবং সমগ্রমানবকুল ও তার শীর্ষস্থানে মুহাম্মদ ও তাঁর রসূল (সা.) এবং নির্বাচিত ও মনোনীত নবী (সা.) ও তাঁর দাস। (ডক্টর ইউসূফ আল-কারযাবীর গ্রন্থ ‘হাকীকাতুত তাওহীদ’ হতে কিছু রদবদলের সহিত সংগৃহীত)

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا

অর্থাৎ, এরূপে শয়তান মানুষ ও জিনদেরকে আমি প্রত্যেক নবী (সা.)র শত্রু করেছি, যারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে একে অন্যকে চমকপ্রদ বাক্য দ্বারা প্ররোচিত করে থাকে। (সূরা আনআম ১১২ আয়াত)।

আল্লাহর হিকমত চেয়েছে যে, তিনি আম্বিয়া ও তওহীদের দাওয়াত পেশকারীদের বিরুদ্ধে কিছু শয়তান জিনকে শত্রু নির্ধারণ করেছেন যারা ভ্রষ্টতা, অমঙ্গল ও বাতিল কথা দ্বারা শয়তান মানুষদেরকে প্ররোচিত করে থাকে। যাতে তারা মানুষকে ভ্রষ্ট করে দেয় এবং তাদেরকে সেই তওহীদ হতে ব্যাহত করে; যার প্রতি আম্বিয়াগণ স্ব-স্ব সম্প্রদায়কে সর্বপ্রথম আহবান করেছেন। কারণ এই তওহীদ হল সেই আসল বুনিয়াদ, যার উপর ইসলামী দাওয়াত প্রতিষ্ঠিত।

কিন্তু আশ্চর্যের কথা যে, কিছু লোক তওহীদের দাওয়াতকে উম্মাহর মাঝে বিছিন্নতা সৃষ্টির কারণ বলে গণ্য করে। অথচ তওহীদই উম্মাহর মাঝে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টির কারণ। তওহীদ (একত্ববাদ)এর নামই সেই কথার নির্দেশ করে।

পক্ষান্তরে মুশরিকদল যারা তাওহীদূর রবুবিয়্যাহ’ (প্রতিপালকের একত্ববাদ)কে স্বীকার করেছিল এবং মেনে নিয়েছিল যে, আল্লাহই তাদের সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ’ (উপাস্যত্বের একত্ববাদ)কে অর্থাৎ কেবলমাত্র আল্লাকেই ডাকতে অস্বীকার করেছিল এবং তারা তাদের আওলিয়াকে ডাকা ও তাদের নিকট প্রার্থনা করা বর্জন করেনি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম তাদেরকে দুআ ও ইবাদতে আল্লাহর তওহীদ (একত্ববাদ)কে স্বীকার করতে ও মেনে নিতে আহবান করলে তারা তার সম্পর্কে বলেছিল,

أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ

অর্থাৎ, সে কি সমস্ত উপাস্যকে এক উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে ? এতো এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার! (সূরা স্বা-দ ৫ আয়াত)

পূর্ববর্তী উম্মতদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,

كَذَٰلِكَ مَا أَتَى الَّذِينَ مِن قَبْلِهِم مِّن رَّسُولٍ إِلَّا قَالُوا سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ * أَتَوَاصَوْا بِهِ ۚ بَلْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُونَ

অর্থাৎ, এরূপে এদের পূর্ববর্তীদের নিকট যখনই কোন রসূল এসেছে ওরা তাকে বলেছে, (তুমি তো) এক যাদুকর অথবা পাগল! ওরা কি একে অপরকে এই মন্ত্রণাই দিয়ে এসেছে? বরং ওরা সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। (সূরা যারিয়াত ৫২ আয়াত)

মুশরিকদের চরিত্র এই যে, তারা যখন এক আল্লাহকেই ডাকার কথা শোনে, তখন তাদের হৃদয় সংকীর্ণ হয়ে যায় এবং অনীহ ও চকিত হয়ে উঠে। ফলে (তওহীদবাদীদেরকেই) কাফের বলে অভিহিত করে এবং তাদেরকে বাধা দিতে প্রয়াস পায়। পক্ষান্তরে যখন তারা শির্ক এবং আল্লাহ ভিন্ন অন্য কাউকে ডাকার কথা শোনে, তখন তারা উৎফুল্ল ও আনন্দিত হয়। আল্লাহ তাআলা ঐ মুশরিকদের অবস্থা বর্ণনা করে বলেন,

وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ ۖ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِن دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ

অর্থাৎ, যখন আল্লাহ এক’ এ কথার উল্লেখ করা হয়, তখন যারা পরকালে বিশ্বাসী নয় তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয় এবং আল্লাহর পরিবর্তে অন্যান্য বাতিল উপাস্যদের উল্লেখ করা হলে তারা আনন্দে উল্লসিত হয়। (সূরা যুমার ৪৫ আয়াত)

তওহীদ অস্বীকারকারী মুশরিকদের অবস্থা বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন,

ذَٰلِكُم بِأَنَّهُ إِذَا دُعِيَ اللَّهُ وَحْدَهُ كَفَرْتُمْ ۖ وَإِن يُشْرَكْ بِهِ تُؤْمِنُوا ۚ فَالْحُكْمُ لِلَّهِ الْعَلِيِّ الْكَبِيرِ

অর্থাৎ, তোমাদের এ শাস্তি তো এজন্য যে, যখন আল্লাহ ছাড়া কেউ সত্য উপাস্য নেই’ বলা হয়েছে তখন তোমরা অবিশ্বাস করেছ এবং তার সহিত শরীক করা হলে তা বিশ্বাস করেছ, সুতরাং সুউচ্চ, সুমহান আল্লাহরই সমস্ত কর্তৃত্ব। (সূরা মু’মিনঃ ১২ আয়াত)

অত্র আয়াতগুলি কাফেরদের প্রসঙ্গে হলেও তা সেই ইসলামের দাবীদারদের উপরেও প্রযোজ্য যারা ওদের গুণে গুণান্বিত। যারা তওহীদের দাওয়াত পেশকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তাদের উপর মিথ্যা অপবাদ দেয় এবং ঘৃণ্য খেতাবে তাঁদেরকে অভিহিত করে; যাতে তাদের নিকট হতে মানুষকে দুরে রাখতে সক্ষম হয় এবং সেই তওহীদ হতে মানুষকে সাবধান করে ও দুরে রাখে, যে তওহীদের কারণেই আল্লাহ তার সমস্ত রসূল প্রেরণ করেছেন। ওদের মধ্যে এমনও ব্যক্তি আছে যারা আল্লাহর নিকট দুআ ও প্রার্থনা করতে শুনলে বিনত হয় না অথচ তিনি ছাড়া অন্য কারো নিকট দুআ ও প্রার্থনা করতে শুনলে; যেমন রসূল বা আওলিয়াদের নিকট মদদ চাইতে শুনলে বিনয়াবনত ও উল্লসিত হয়। সুতরাং তারা যা করে তা কত নিকৃষ্ট!

উলামা আম্বিয়ার উত্তরাধিকারী। সকল নবী (সা.) প্রথম যে কথার প্রতি আহবান করেন তা হল তওহীদ। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

অর্থাৎ, অবশ্যই আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রসূল প্রেরণ করেছি এই নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহরই ইবাদত কর এবং তাগুত বর্জন কর। (সূরা নাহল ৩৬ আয়াত)

(তাগুত বলা হয় প্রত্যেক সেই ব্যক্তিকে, যাকে আল্লাহর পরিবর্তে পূজা ও মান্য করা হয় এবং সে উক্ত পূজায় সম্মত ও সন্তুষ্ট থাকে।)

এই জন্যই আলেম সমাজের উচিত তাই দিয়ে দাওয়াত শুরু করা; যা দিয়ে রসূলগণ করেছিলেন। অতএব দাওয়াতের প্রারম্ভে মানুষকে সকল প্রকার ইবাদতে বিশেষ করে দুআ ও প্রার্থনা করাতে আল্লাহর তওহীদের (আল্লাহকে একক উপাস্য মানার) প্রতি আহবান করা কর্তব্য। যেহেতু দুআ সম্পর্কে আল্লাহর রসূল (সা.) বলেন, “দুআই তো ইবাদত।” (তিরিমযী এবং তিনি এটিকে হাসান বলছেন)।

বর্তমানযুগে অধিকাংশ মুসলমান শির্ক এবং গায়রুল্লাহকে ডাকাতে এবং তাদের নিকট প্রার্থনা ও আবেদন করাতে অভ্যাসী হয়ে পড়েছে। যা তাদের এবং পূর্ববর্তী জাতির দুর্দশার মূল কারণ। যে সব জাতি সমূহকে আল্লাহর পরিবর্তে আওলিয়াগণকে ডাকার কারণে তিনি ধ্বংস করে দিয়েছেন।

তওহীদ প্রতিষ্ঠা এবং শির্ক উচ্ছেদকরণের প্রতি উলামাগণের বিভিন্ন প্রকার ভূমিকা পরিদৃষ্ট হয়ঃ

১। প্রথম প্রকার উলামা যারা তওহীদ, তার গুরুত্ব ও প্রকারভেদ উপলদ্ধি করেছেন, শির্ক ও তার প্রকারভেদ জেনেছেন। অতঃপর তারা তাদের কর্তব্য পালনে সক্রিয় হয়েছেন। তওহীদ ও শির্ক মানুষের নিকট খোলাখুলি ও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। যাদের দলীল কুরআন কারীম এবং সহীহ সুন্নাহ (হাদীস)। এই শ্রেণীর উলামাগণ মিথ্যা অপবাদের সম্মুখীন হয়েছেন যেমন আম্বিয়াগণ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা পশ্চাৎপদ না হয়ে ধৈর্যের সাথে স্বকর্তব্য পালন করেছেন। তাঁদের আদর্শ নীতিবাক্য হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার বাণী,

وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا يَقُولُونَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيلًا

অর্থাৎ, লোকে যা বলে, তাতে তুমি ধৈর্য ধারণ কর এবং সৌজন্য সহকারে ওদেরকে উপেক্ষা করে চল। (সূরা মুযযাম্মিল ১০ আয়াত)

প্রাচীনকালে লুকমান হাকীম তাঁর পুত্রকে অসিয়ত করে বলেছিলেন,

يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنكَرِ وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا أَصَابَكَ ۖ إِنَّ ذَٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ

অর্থাৎ, হে বৎস! যথাযথভাবে নামায পড়বে, সৎকাজের নির্দেশ দেবে, অসৎকাজে বাধা দান করবে এবং বিপদে ও কষ্টে ধৈর্য ধারণ করবে। নিশ্চয় এসব দৃঢ় সংকল্পের কাজ। (সূরা লুকমানঃ ১৭ আয়াত)

২। দ্বিতীয় প্রকার উলামা যারা তওহীদের প্রতি দাওয়াতকে উপেক্ষা ও অবহেলা করেছেন, যে তওহীদ হল ইসলামের মূল বুনিয়াদ। ফলে তারা মুসলিমদের আকীদাহ ও বিশ্বাস সংশোধন না করে তাদেরকে নামাযে যত্নবান হতে, আল্লাহর বিধান রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা (কল্পে সংগঠন) করতে এবং তাঁর পথে জিহাদ করতে আহ্বান করেছেন। (অর্থাৎ বিনা ভিত্তিতে ইমারত গড়ার প্রচেষ্টা করেছেন। যেন তাঁরা আল্লাহ তাআলার এই বাণী শ্রবণ করেননি,

وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ

অর্থাৎ, ওরা যদি শির্ক করত, তবে ওদের সকল কৃতকর্ম পন্ড হয়ে যেত। (সূরা আনআম ৮৮ আয়াত)

অথচ তারা যদি রসূলগণের মত অন্যান্য আমলের পুর্বে তওহীদকে অগ্রণী করতেন তাহলে তাদের দাওয়াত সাফল্যমন্ডিত হত এবং আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতেন যেমন নবী ও রসূলগণকে তিনি সাহায্য করেছেন। তিনি বলেন,

وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَىٰ لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّن بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا ۚ يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا ۚ وَمَن كَفَرَ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ

অর্থাৎ, তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে আল্লাহ তাদেরকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি অবশ্যই পৃথিবীতে তাদেরকে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন যেমন তিনি তাদের পূর্ববর্তীদেরকে প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন। তিনি অবশ্যই তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে -যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন সুদৃঢ় করবেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার উপাসনা করবে, আর আমার সহিত কিছুকে অংশী স্থাপন করবে না। অতঃপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারাই সত্যত্যাগী (ফাসেক)। (সূরা নূর ৫৫ আয়াত)

সুতরাং বিজয়ের বুনিয়াদী শর্ত হল তওহীদ প্রতিষ্ঠাকরণ।

৩। তৃতীয় প্রকার উলামা ও দাওয়াত পেশকারী, যারা লোকেদের আক্রমণের ভয়ে অথবা নিজ চাকুরী, পদ বা গদি যাবার ভয়ে তওহীদের প্রতিষ্ঠা ও শির্ক উমুলনকল্পে দাওয়াত ত্যাগ করে বসেছেন। আর এতে তারা সেই ইলম (জ্ঞান) গুপ্ত করেছেন যা মানুষের মাঝে প্রচার করতে আদিষ্ট ছিলেন। ফলে আল্লাহর এই বাণী তাদের জন্য নিরূপিত হয়েছে,

إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَىٰ مِن بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ ۙ أُولَٰئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ

অর্থাৎ, আমি যেসব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথ-নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, মানুষের জন্য খোলাখুলিভাবে কিতাবে আমার ব্যক্ত করার পরও যারা ঐ সকল গোপন রাখে। আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ দেন এবং অভিশাপদাতারাও তাদেরকে অভিশাপ দেয়। (সূরা বাক্বারাহ ১৫৯ আয়াত)

যারা দ্বীনের দাওয়াত দেন তাদের বাঞ্ছনীয় গুণ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,

الَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالَاتِ اللَّهِ وَيَخْشَوْنَهُ وَلَا يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلَّا اللَّهَ

অর্থাৎ, যারা আল্লাহর বাণী প্রচার করে, তাকে ভয় করে এবং আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে ও ভয় করে না। (সূরা আহযাব ৩৯ আয়াত)

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন ইলম (জ্ঞান) গোপন করে আল্লাহ তার মুখে আগুনের লাগাম দেবেন।” (সহীহ মুসনাদে আহমদ)

৪। চতুর্থ প্রকার উলামা ও পীরের দল; যারা তওহীদের প্রতি দাওয়াত, একমাত্র আল্লাকেই ডাকা এবং তিনি ছাড়া অন্য কোন নবী (সা.), ওলী বা মৃতকে না ডাকার নীতির বিরোধিতা করেন। কারণ এঁদের নিকট নবী (সা.)-ওলীকে ডাকা (অসীলা করা) বৈধ তাই। যে আয়াতে গায়রুল্লাহকে ডাকতে নিষিদ্ধ ও সাবধান করা হয়েছে সেই আয়াতকে এঁরা কেবল (অমুলিম) মুশরিকদের জন্য নিরূপিত করেন এবং মনে করেন যে, মুসলমানদের মধ্যে মুশরিকদের পর্যায়ভুক্ত কেউ নেই! যেন তাঁরা আল্লাহ তাআলার এই বাণী শ্রবণ করেননি,

الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ أُولَٰئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُونَ

অর্থাৎ, যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে কোন যুম দ্বারা কলুষিত করেনি তাদের জন্যই রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই সৎপথপ্রাপ্ত। (সূরা আনআম ৮২ আয়াত)

উক্ত আয়াতে যুলমের অর্থ হল শির্ক। এর দলীল আল্লাহর এই বাণী,

إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ

অর্থাৎ, অবশ্যই শির্ক মহা যুলম। (সূরা লুকমান ১৩ আয়াত)

সুতরাং উল্লেখিত আয়াতে একথাই সুস্পষ্ট হয় যে, মুসলিম এবং মু'মিনও শির্কে আপতিত হয়; যেমন বহু মুসলিম বিশ্বের মুসলিমদের বর্তমান পরিস্থিতি। পক্ষান্তরে ওঁরা, যারা নবী (সা.)-ওলীকে বিপদে ডাকা বা অসীলা মানা বৈধ বলে মানুষকে ফতোয়া দেন, মসজিদের ভিতর মৃত সমাধিস্ত করা, কোন ওলীর কবরের তওয়াফ করা, আওলিয়াদের নামে নর-নিয়ায পেশ করা প্রভৃতি বিদআত ও শরীয়ত-বিরোধী আচরণকে বৈধ ও সমীচীন বলে ঘোষণা করেন - তাদের ব্যাপারে রসূল ধ্রুকু মুসলিমকে সাবধান ও সতর্ক করেছেন; তিনি বলেন, “আমি আমার উম্মতের উপর ভ্ৰষ্টকারী ইমাম (আলেম ও নেতা প্রভৃতি)র দলকেই ভয় করি।” (সহীহ তিরমিযী) আযহারের এক প্রয়াত ওস্তাদকে কবরের প্রতি সম্মুখ করে নামায বৈধতার প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'কবরের প্রতি সম্মুখ করে নামায বৈধ হবে না কেন? এই দ্যাখেন না, রসুলুল্লাহর কবর মসজিদের ভিতরেই এবং লোকেরা তাঁর কবরের প্রতি মুখ করে নামায পড়ে থাকে?

অথচ রসূল (সা.) এর দাফন মসজিদের ভিতর হয়নি বরং আয়েশা (রাঃ) এর। হুজরায় তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। পরন্তু তিনি কবরের প্রতি সম্মুখ করে নামায পড়তে নিষেধ করে গেছেন। রসূল (সা.) দুআ করতেন,

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لاَ يَنْفَعُ

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমি সেই ইম হতে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যা কোন লাভ দেয় না। (মুসলিম) (অর্থাৎ এমন ইলম হতে পানাহ চাচ্ছি যা আমি অপরকে শিখাই না, যার উপর আমল করি না এবং যার দ্বারা আমার চরিত্রও পরিবর্তিত হয় না।)

৫। যারা আপন মুরশিদ ও হুজুরদের কথাই অন্ধভাবে মান্য করে থাকে এবং আল্লাহর অবাধ্যাচরণ করে তাদের আনুগত্য ও অনুকরণ করে বস্তুতঃ তারা। রসূল (সা.) এর এই বাণীর বিরুদ্ধাচরণ করে। তিনি বলেন, “স্রষ্টার অবাধ্যতা করে কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই।” (সহীহ, মুসনাদে আহমদ)

অবশ্যই এই আনুগত্যের দরুন তারা কিয়ামতে লাঞ্ছিত হবে। আর তখন লাঞ্ছনা কোন উপকার দেবে না। কাফেরদল ও তাদের পথ অনুসরণকারীদের শাস্তি বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন,

يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا * وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا * رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا

অর্থাৎ, যেদিন অগ্নিতে ওদের মুখমণ্ডল উল্টে-পাল্টে দগ্ধ করা হবে সেদিন ওরা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করতাম।” তারা আরো বলবে, হে আমাদের প্রভু! আমরা আমাদের নেতা ও বুযুর্গদের আনুগত্য করেছিলাম এবং ওরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল ; হে আমাদের। প্রতিপালক! ওদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং মহা-অভিসম্পাত করুন। (সূরা আহযাব ৬৬-৬৮ আয়াত)

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে কাসীর বলেন, “অর্থাৎ, আমরা আমাদের আমীর (নেতা) এবং উলামা ও পীর-বুযুর্গদের অনুকরণ, আর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলাম। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম যে, ওদের নিকট কিছু আছে এবং ওরা কিছুর উপর প্রতিষ্ঠিত আছে। (অর্থাৎ প্রকৃত সত্য ওদের নিকটেই আছে এবং ওব্রা প্রকৃত সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আজ দেখছি,) ওরা কিছুরই উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না।”

লোকেরা প্রত্যেক সেই ব্যক্তিকেই ওয়াহাবী’ বলে অভিহিত করে থাকে, যে ব্যক্তি তাদের প্রথা ও অভ্যাস, বিশ্বাস ও বিদআতের বিরোধিতা করে যদিও তাদের ঐ সকল বিশ্বাস অমূলক ও ভ্রষ্ট; যা কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীস সমুহের পরিপন্থী। বিশেষ করে তওহীদের কথা বললে এবং অন্যান্যকে ছেড়ে কেবল একমাত্র আল্লাহকে ডাকতে নির্দেশ দিলে তারা ঐ খেতাব দিয়ে থাকে।

একদা এক আলেমের নিকট ‘আল-আরবাঈন আন-নববীয়্যাহ’ গ্রন্থ হতে ইবনে আব্বাসের এই হাদীস পড়েছিলাম; নবী (সা.) বলেন, “যখন চাইবে, তখন আল্লাহরই নিকট চাও এবং যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে, তখন আল্লাহরই নিকট কর।” (তিরমিযী, এবং তিনি এটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।) নবীর ব্যাখ্যা আমার বড় পছন্দ হল; তিনি বলেন, '--- অতঃপর যে প্রয়োজন মানুষ ভিক্ষা করে তা পূরণ করার ক্ষমতা যদি সৃষ্টির হাতে না থাকে, যেমন সুপথ (হেদায়াত) ও ইলম (জ্ঞান) প্রার্থনা, আরোগ্য ও নিরাপত্তা ভিক্ষা ইত্যাদি, তাহলে তা প্রতিপালকের নিকটই চাইবে। পক্ষান্তরে সৃষ্টির নিকট চাওয়া এবং তাদের উপর ভরসা করা নিন্দনীয়।

অতঃপর আমি ঐ মওলানাকে বললাম, 'এই হাদীস এবং এর ব্যাখ্যা গায়রুল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা অবৈধ হওয়ার প্রতি নির্দেশ করে। তিনি আমাকে বললেন, 'বরং (গায়রুল্লাহর নিকটেও সাহায্য ভিক্ষা করা) বৈধ। আমি বললাম, আপনার দলীল কি? এতে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে উচ্চ কণ্ঠে। বললেন, 'আমার ফুফু বলেন, “হে (বাবা) শায়খ সা’দ সাহেব!’ (অথচ তিনি তার মসজিদে সমাধিস্ত, ফুফু তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন।) আমি তাকে বলি, ফুফুজান! (বাবা) শায়খ সা’দ সাহেব কি আপনার উপকার করতে পারবেন? ফুফু বলেন, 'আমি উনার নিকট প্রার্থনা করি। উনি এ ব্যাপারে আল্লাহর প্রতি মধ্যস্থতা করেন, যাতে তিনি আমাকে রোগমুক্ত করে দেন!! আমি শায়েখকে বললাম, আপনি একজন আলেম মানুষ! বই পঠন-পাঠনে বয়স অতিবাহিত করে ফেলেছেন, তা সত্ত্বেও এসব কিছুর পরে আপনি আপনার অজ্ঞ ফুফুর নিকট আকীদাহ গ্রহণ করেছেন?!’ তখন তিনি আমাকে বললেন, 'তোমার নিকট ওয়াহাবী চিন্তাধারা আছে। তুমি ওমরা করতে যাও, আর ওয়াহাবী বই পুস্তক বয়ে নিয়ে আস!

আমি অবশ্য ওয়াহাবী সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। তবে হুজুরদের মুখে বহুবার বলতে শুনেছি। হুজুররা তাদের সম্পর্কে বলেন, ওয়াহাবীরা সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে, ওরা আওলিয়া এবং তাদের কারামতকে বিশ্বাস করে না,

রসূলের প্রতি ওদের মহব্বত নেই’ ইত্যাদি মিথ্যা অপবাদ! তখন আমি মনে মনে বলতাম, ওয়াহাবীরা যদি একমাত্র আল্লাহর নিকটেই সাহায্য ভিক্ষা করাতে এবং আরোগ্যদাতা একমাত্র আল্লাহ -এই কথাতে বিশ্বাসী হন, তাহলে তাঁদের সম্পর্কে পরিচয় লাভ করা আমার একান্ত জরুরী। সে জামাআত কোথায় জিজ্ঞাসা করলে সকলে বলল, ওদের এক নির্দিষ্ট স্থান আছে, যেখানে ওরা প্রত্যেক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জমায়েত হয়ে তফসীর, হাদীস ও ফিকহ অধ্যয়ন করে।

আমি আমার ছেলেদেরকে সঙ্গে নিয়ে কয়েকটি শিক্ষিত যুবককে সাথে করে তাদের নিকট গিয়ে উপস্থিত হলাম। এক বৃহৎ কক্ষে প্রবেশ করে দর্সের অপেক্ষায় বসলাম। ক্ষণেক পরেই এক বয়স্ক শায়খ কক্ষে প্রবেশ করতেই আমাদেরকে সালাম দিলেন এবং তার ডান দিকে হতে শুরু করে সকলের সাথে মুসাফাহা করলেন। অতঃপর তিনি তাঁর বসার স্থানে বসলেন। তার জন্য কেউই উঠে দণ্ডায়মান হয়নি। আমি মনে মনে বললাম, “ইনি তো বড় বিনয়ী শায়খ, দন্ডায়মান হওয়া (কিয়াম) পছন্দ করেন না বুঝি।” অতঃপরঃ

إن الحمد لله نحمده ونستعينه ونستغفر

বলে তিনি তার দর্স শুরু করলেন। খুতবাটি শেষ পর্যন্ত পাঠ করলেন, যে খুতবা রসূল ধ্র পাঠ করে তাঁর ভাষণ ও দর্স আরম্ভ করতেন। অতঃপর আরবী ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন। হাদীস উল্লেখ করলে তার শুদ্ধঅশুদ্ধতা এবং বর্ণনাকারীর অবস্থা বর্ণনা করেন। নবী (সা.) এর নাম এলেই তাঁর উপর দরূদ পাঠ করেন। পরিশেষে কাগজে লিখিত কতকগুলি প্রশ্ন তাকে করা হল। তিনি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে উদ্ধৃত দলীল সহ উত্তর দিলেন। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ তার সহিত বাদানুবাদও করলেন। কোন প্রশ্নকারীকে উত্তর না দিয়ে তিনি ফিরিয়ে দিলেন না। অতঃপর দর্সের শেষে বললেন, ‘আল্লাহর শত প্রশংসা যে, আমরা মুসলিম ও সালাফী।* কিছু লোক বলে থাকে আমরা ওয়াহাবী। অথচ এটা হল নামের খেতাব বের করা যা থেকে আল্লাহ আমাদেরকে নিষেধ করেছেন; তিনি বলেন,

(وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ) অর্থাৎ, আর তোমরা এক অপরের মন্দ খেতাব বের করো না। (সূরা হুজুরাত ১১ আয়াত)

পূর্ব যুগে লোকেরা ইমাম শাফেয়ীকে রাফেযী* বলে অপবাদ দিলে তিনি তাদের প্রতিবাদে বলেছিলেন,

‘মুহাম্মদের বংশধরের প্রতি ভালবাসা রাখা

যদি ‘রফয’ (রাফেযী হওয়া) হয়।

তাহলে মানব-দানব সাক্ষী থাকুক যে, আমি রাফেযী।” তদনুরূপ আমাদেরকে যারা ওয়াহাবী বলে অপবাদ দেয় তাদের প্রতিবাদে এক কবির মত বলি যে,

‘আহমদের (সা.) অনুসারী যদি ওয়াহাবী হয়,

তাহলে আমি স্বীকার করছি যে, আমি একজন ওয়াহাবী।” অতঃপর দর্স শেষ হলে কিছু যুবকের সহিত আমরা বের হয়ে এলাম। তার ইলম ও বিনয় দেখে আমরা বিস্মিত হলাম। এক যুবককে বলতে শুনলাম, ‘উনিই হচ্ছেন প্রকৃত শায়খ!”

তওহীদের দুশমনরা তওহীদবাদীকে ‘ওয়াহাবী’ বলে অভিহিত করে। এতে তারা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব এর প্রতি সম্বন্ধ করে। অথচ সত্য ও সঠিক বললে তাঁর নাম মুহাম্মাদ এর প্রতি সম্বন্ধ জুড়ে ‘মুহাম্মদী’ বলত। আল্লাহর ইচ্ছা তাই ওয়াহহাবী” ওয়াহহাব’ এর প্রতি সম্বদ্ধ হয়েছে; যা। আল্লাহর সন্দরতম নামাবলীর অন্যতম নাম।

একজন সূফী যদি এমন এক জামাআতের সহিত সম্বন্ধ রাখে যারা সূফ’ (পশমবস্ত্র) পরিধান করে (ফলে তাকে সুফী বলা হয়, তাহলে একজন ওয়াহহাবী’ ও ‘আল-ওয়াহাহহাব’-এর প্রতি সম্বন্ধ রেখে (গর্ব অনুভব করতে পারে)। যেহেতু আল-ওয়াহাহহাব’ (মহাদাতা) হলেন আল্লাহ। যিনি তাকে তওহীদ দান করেছেন এবং তওহীদের দাওয়াত পেশ করতে তাকে সক্ষম ও সুদৃঢ় করেছেন।

* সালাফীঃ যারা সলফে সালেহ(রসূল ও সাহাবা)র পথ অনুসরণ করেন।

** রাফেযাহঃ শিয়াহ সম্প্রদায়ের একটি ফিরকার নাম। (অনুবাদক)

শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদের (সউদী আরবের রাজধানী রিয়া থেকে প্রায় ৫০ কিমি পশ্চিমে) উয়াইনাহ শহরে ১১১৫ হিজরী সনে। জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স দশ বছর হওয়ার পূর্বেই কুরআন হিফয করেন। আপন পিতার নিকট হাম্বলী ফিকহ অধ্যয়ন করেন এবং দেশের বিভিন্ন শায়খদের নিকট হাদীস ও তফসীর পাঠ করেন। বিশেষ করে মদীনা নববিয়্যার উলামাদের নিকট (শরীয়তের জ্ঞান লাভ করেন)। কিতাব ও সুন্নাহ হতে তওহীদকে বুঝেন। অতঃপর তিনি নিজ দেশ নাজদে এবং যে সব দেশ তিনি ভ্রমণ করেন সেখানে শির্ক, কুসংস্কার, বিদআত এবং সঠিক ইসলামের পরিপন্থী কবরপূজা দেখে শঙ্কিত হলেন।

নিজ দেশের অনুঢ়া যুবতীদের। দেখলেন, তারা ষাড়া খজুর বৃক্ষের অসীলায় প্রার্থনা করছে, বলছে, 'ওহে যাড়া বনস্পতি! বছর না ঘুরতেই চাই আমি পতি!’ হিজাযে দেখলেন, সাহাবাব, আহলে বায়ত এবং রসূলের কবরসমূহ ভক্তির আতিশয্যে পবিত্ররূপে পুজিত হচ্ছে -যে ভক্তি ও উপাসনা পাওয়ার অধিকারী একমাত্র আল্লাহ। মদীনায় তিনি শুনলেন, আল্লাহর পরিবর্তে রসূল (সা.) প্লঃ-এর নিকট লোকে সাহায্য প্রার্থনা করছে; যা কুরআন ও রসূলের বাণীর পরিপন্থী। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَلَا تَدْعُ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ ۖ فَإِن فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِّنَ الظَّالِمِينَ

অর্থাৎ, এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ডেকো না; যা তোমার উপকারও। করে না এবং অপকারও করে না, কারণ এ করলে তুমি যালেম (মুশরিক)-দের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। (সূরা ইউনুস ১০৬ আয়াত)

রসূল (সা.) স্বীয় পিতৃব্য-পুত্রকে সম্বোধন করে বলেন, 'যখন কিছু চাইবে তখন আল্লাহরই নিকট চাও এবং যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহরই নিকট কর।” (তিরমিযী এবং তিনি এটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।) শায়খ একমাত্র আল্লাহকে ডাকতে এবং তওহীদ বরণ করে নিতে মানুষকে আহ্বান করতে আরম্ভ করলেন। যেহেতু আল্লাহই সর্বশক্তিমান এবং সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। আর বাকী সকল সৃষ্টি নিজের ও অপরের অমঙ্গল দূরীকরণে অক্ষম। আর যেহেতু সালেহীন (আওলিয়া)র মহব্বত তাঁদের অনুসরণ করে প্রকাশ হয়, আল্লাহ ও নিজেদের মাঝে তাদেরকে অসীলা বা মাধ্যম মেনে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তাদেরকে আহবান করে নয়।

১. বাতিলপন্থীদের বিরোধিতাঃ যে তওহীদী দাওয়াতের গুরুভার শায়খ গ্রহণ করেছিলেন তার বিরুদ্ধে বিদআতীরা প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়াল। অবশ্য এটা আশ্চর্যের কিছু নয়, যেহেতু তওহীদের দুশমনরা রসূল প্ল-এর যুগেও ঐ দাওয়াতের বিরোধিতা করেছিল। তারা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিল,

أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ

অর্থাৎ, ওকি সকল মাবুদকে একই মা'বুদ বানিয়ে নিয়েছে? এতো আশ্চর্যের ব্যাপার! (সূরা সাদ ৫ আয়াত)

শায়খের শত্রুরা তার বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব-বিগ্রহ শুরু করে দিল। তার প্রসঙ্গে মিথ্যা অপবাদ প্রচার করতে লাগল। তাকে হত্যা করে তার ঐ দাওয়াত হতে নিস্কৃতিলাভের জন্য ষড়যন্ত্র করল। কিন্তু আল্লাহ তার হিফাযত করলেন এবং তার জন্য এক সহায়ক নিযুক্ত করে দিলেন। যার ফলে হিজায ও অন্যান্য মুসলিম দেশে তওহীদী দাওয়াত প্রচার ও প্রসার লাভ করল। কিন্তু অদ্যাবধি কিছু লোক সেই মিথ্যা অপবাদ প্রচারে ব্যস্ত। ওরা বলে, তিনি পঞ্চম আরো এক নতুন মহাব প্রবর্তন করেছেন, অথচ তার মযহাব হল। হাম্বলী। ওরা আরো বলে, ওয়াহাবীরা রসূলকে ভক্তি করে না বা ভালোবাসে না ও তার উপর দরূদ পড়ে না। অথচ শায়খ রাহেমাহুল্লাহ মুখতাসারু সীরাতির রসূল (ﷺ)” নামে এক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। যা এ কথারই দলীল যে, তিনি রসূল (ﷺ)-কে ভালোবাসেন। ওা তার নামে আরো বিভিন্ন অপবাদ ও কুৎসা রটিয়ে থাকে, যে সম্পর্কে কাল কিয়ামতে ওদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। পক্ষান্তরে যদি ওরা ইনসাফের সাথে উদার মনে তাঁর কিতাবসমূহ অধ্যয়ন। করত, তবে নিশ্চয় তাতে কেবল কুরআন, হাদীস ও সাহাবাবর্গের উক্তিই দেখতে পেত।

এক সত্যবাদী ব্যক্তি আমাকে জানান যে, এক আলেম তার দর্সে লোকদেরকে ওয়াহাবী থেকে সাবধান করতেন। উপস্থিতগণের মধ্য হতে এক ব্যক্তি মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের লিখা একটি পুস্তক লেখকের নাম সহ প্রথম পৃষ্ঠা ছিড়ে তাকে পড়তে দিলেন। তিনি তা পড়ে পছন্দ করলেন। অতঃপর যখন লেখক সম্পর্কে জানলেন তখন তিনি তার প্রশংসা করতে লাগলেন।

২। হাদীসে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, “হে আল্লাহ! তুমি আমাদের শাম ও ইয়ামানে বৰ্কত (প্রাচুর্য) দান কর।” সকলে বলল, আর আমাদের নজদে?” তিনি বললেন, “ওখান হতে শয়তানের শৃঙ্গ উদিত হবে।” (বুখারী, মুসলিম)

ইবনে হাজার আস্‌কালানী প্রভূতি ওলামাগণ উল্লেখ করেন যে, হাদীসে উল্লেখিত ঐ নজদ হল ইরাকের নজদ। সুতরাং ইরাকেই যত বড় বড় ফিতনা ফাসাদের প্রাদুর্ভাব ঘটে। হুসাইন বিন আলী , ওখানেই শহীদ হন। কিন্তু এর বিপরীত, কিছু লোক মনে করে উক্ত নজদ’ বলতে হিজাযের নজদ’কে বুঝানো হয়েছে। অথচ সেখানে কোন ফিতনাহ দেখা দেয়নি যেমন ইরাকে বহু ফিতনা দেখা দিয়েছে। বরং হিজাযের নজদ থেকে তো সেই তওহীদের সংস্কার সাধন হয়েছে যার কারণে বিশ্বজগৎ রচিত এবং যার কারণে আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে রসূলগণকে প্রেরণ করেছেন।[১]

৩। কিছু ন্যায়পরায়ণ উলামা উল্লেখ করেন যে, শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব হলেন হিজরী দ্বাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ (ইসলামী সংস্কারক)। অনেকে তার প্রসঙ্গে বহু বই-পুস্তকও রচনা করেন। ঐ লেখকদের মধ্যে শায়খ আলী ত্বত্বাবী অন্যতম, যিনি ঐতিহাসিক আদর্শ ও প্রতিভাবান মহাপুরুষদের প্রসঙ্গে এক ধারাবাহিক পুস্তক রচনা করেছেন। যাদের মধ্যে তিনি শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব এবং আহমদ বিন ইরফানের নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি ঐ পুস্তকে ঐ কথাও উল্লেখ করেন যে, ভারতে তওহীদের আকীদা পৌছে মুসলিম হাজীগণের মাধ্যমে যারা মক্কায় হজ্জ করতে এসে ঐ আকীদায় প্রভাবান্বিত হয়ে দেশে ফিরেন।

পরে ইংরেজ ও ইসলাম-দুশমনরা ঐ আকীদার বিরুদ্ধে বাধ সাধে। কারণ ঐ আকীদায় তাদের বিরুদ্ধে সমস্ত মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করেছিল। তাই অর্থলোভী স্বার্থপর (মুসলিম)দের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে তাদের বদনাম করতে প্রয়াস চালায়। ফলে তওহীদের প্রতি আহবানকারী প্রত্যেক তওহীদবাদীর নাম (তুচ্ছভাবে) ওয়াহাবী রাখে[২] এবং এইরূপ বলে কোন অভিনব দ্বীন প্রবর্তক (বিদআতী) রূপে তাকে চিহ্নিত করতে চায়। যাতে মুসলিমরা তাদের মূল তওহীদের আকীদা থেকে ফিরে আসে, যে আকীদা তাদেরকে কেবল এক আল্লাহকে ডাকার প্রতি আহবান করে। কিন্তু সে নির্বোধরা একথা বুঝতে পারেনি যে, ওয়াহাবী” শব্দটি ‘আল-ওয়াহহাব’এর সহিত সম্বদ্ধ; যা আল্লাহর পবিত্র নামাবলীর অন্যতম নাম। (যার অর্থ মহাদা) যিনি তাকে (ওয়াহাবীকে) তওহীদ দান করেছেন এবং তার বিনিময়ে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

[১]. এখন যদি বিশুদ্ধ তওহীদের দাওয়াতকে কেউ ফিতনা মনে করে তবে ন্যায় পরায়ণ জ্ঞানীর নিকট ফিতনাবা কে তা সহজে অনুমেয়। (অনুবাদক)

[২]. যা ইতিহাসে ওয়াহাবী আন্দোলন’ বলে সুপরিচিত ও প্রসিদ্ধ। (অনুবাদক)

১। তওহীদের সহিত শির্কের সংঘর্ষ প্রাচীন। এ সংঘর্ষ প্রথম শুরু হয় সেই রসূল (সা.) নুহ 21-এর যুগে যখন তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করার এবং মূর্তিপূজা বর্জন করার প্রতি আহবান করেন। তাদের মাঝে সাড়ে নয়শত বছর অবস্থান করে তওহীদের দাওয়াত দিতে থাকলেন। কিন্তু তাদের প্রতিবিধান ছিল -যেমন কুরআন উল্লেখ করে,

وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا * وَقَدْ أَضَلُّوا كَثِيرًا

অর্থাৎ, ওরা বলল, তোমরা তোমাদের দেব-দেবীকে পরিত্যাগ করো না; অদ, সুয়া, য়্যাগুস, য়্যাউক ও নাকে । ওরা অনেককে বিভ্রান্ত করেছে। (সূরা নূহ ২৩-২৪ আয়াত)

ইমাম বুখারী ইবনে আব্বাস এই আয়াতের ব্যাখ্যা বর্ণনা করেন যে, এগুলি নুহ সম্প্রদায়ের (৫টি) নেক লোকের নাম ছিল। যখন তারা পরলোক গমন করলেন, তখন শয়তান তাদের সম্প্রদায়কে কুমন্ত্রণা দিয়ে উদ্বুদ্ধ করল যে, ওঁরা যে মজলিসে উপবেশন করতেন সে মজলিসে ওঁদের মুর্তি নির্মাণ করে সংস্থাপন কর এবং ওঁদের নাম অনুসারে প্রত্যেকের নাম রেখে দাও।” লোকেরা তাই করল। তখন তাদের পূজা করা হত না। কিন্তু যখন ঐ লোকেরা মারা গেল এবং ঐশী-জ্ঞান বিস্মৃত হল তখন ঐ মূর্তিসমূহের পূজা শুরু হয়ে গেল।

২। অতঃপর নূহ (আঃ)-এর পর আরো বহু রসূল এলেন। তারা স্ব-স্ব সম্প্রদায়কে একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করতে এবং বাতিল মাবুদসমূহের ইবাদত বর্জন করতে আহবান করলেন যারা ইবাদতের যোগ্য ছিল না। শুনুন কুরআন কি বলছে। সে আপনাকে খবর দেবে--

وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا ۗ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ ۚ أَفَلَا تَتَّقُونَ

অর্থাৎ, এবং আদ জাতির নিকট ওদের ভ্রাতা হূদকে প্রেরণ করেছিলাম। সে। বলেছিল, 'হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য অন্য কোন মাবুদ নেই। তোমরা কি সাবধান হবে না ?” (সূরা আ’রাফ ৬৫ আয়াত)

وَإِلَىٰ ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا ۚ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ

অর্থাৎ, এবং সামূদ জাতির প্রতি তাদের ভ্রাতা সালেহকে প্রেরণ করেছিলাম। সে বলেছিল, 'হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর; তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য অন্য কোন উপাস্য নেই।” (সূরা হূদ ৬১ আয়াত)

وَإِلَىٰ مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا ۚ قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ

অর্থাৎ, এবং মাদয়্যানবাসীদের নিকট তাদের ভ্রাতা শুআইবকে প্রেরণ করেছিলাম। সে বলেছিল, 'হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য অন্য কোন মাবুদ নেই।” (সূরা ৮৪ আয়াত)

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِي بَرَاءٌ مِّمَّا تَعْبُدُونَ * إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُ سَيَهْدِينِ

অর্থাৎ, স্মরণ কর, ইব্রাহীম তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বলেছিল, 'তোমরা যাদের পূজা কর তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই; সম্পর্ক আছে শুধু তারই সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনিই আমাকে সৎপথ প্রদর্শন। করবেন।' (সূরা যুখরুফ ২৬-২৭ আয়াত)

কিন্তু যুগে যুগে মুশরিকরা দ্বন্দ্ব, প্রতিবাদ এবং সর্বপ্রকার শক্তি ও সামর্থ ব্যয় করে সংঘর্ষ দ্বারা সকল আম্বিয়াগণকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে।

৩। আমাদের প্রিয় রসূল (সা.) যিনি নবুয়তের পূর্বে আরবের নিকট সত্যবাদী বিশ্বস্ত বলে সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু যখন তিনি তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদত ও তওহীদ বরণ এবং পিতৃপুরুষদের পূজ্যমান উপাস্যসমূহ বর্জন করতে আহবান করলেন, তখন সকলে তার সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততাকে ভুলে বসল। বরং উল্টো তাকে ‘যাদুকর মিথুক’ বলে অভিহিত করল। কুরআন তাদের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে বলে,

وَعَجِبُوا أَن جَاءَهُم مُّنذِرٌ مِّنْهُمْ ۖ وَقَالَ الْكَافِرُونَ هَٰذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ * أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ

অর্থাৎ, এরা আশ্চর্যান্বিত যে, এদেরই মধ্য হতে এদের নিকট একজন সতর্ককারী এল! এবং কাফেররা বলল, এ তো এক যাদুকর, মিথ্যাবাদী। এ কি বহু উপাস্যের পরিবর্তে একটি মাত্র উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে? এ তো এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার!’ (সূরা স্বাদ ৪-৫ আয়াত)।

كَذَٰلِكَ مَا أَتَى الَّذِينَ مِن قَبْلِهِم مِّن رَّسُولٍ إِلَّا قَالُوا سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ * أَتَوَاصَوْا بِهِ ۚ بَلْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُونَ

অর্থাৎ, এরূপে এদের পূর্ববর্তীদের নিকট যখনই কোন রসূল (সা.) এসেছে, তখনই ওরা তাকে বলেছে, (তুমি তো) এক যাদুকর অথবা পাগল। ওরা কি একে অপরকে এ মন্ত্রণাই দিয়ে এসেছে? বস্তুতঃ ওরা এক সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়। (সূরা যারিয়াত ৫২-৫৩ আয়াত)

এই তো তওহীদের দাওয়াতের ক্ষেত্রে সকল রসূলের ভূমিকা এবং অপর পক্ষে তাদের মিথ্যায়নকারী ও অপবাদ আরোপকারী সম্প্রদায়দের এই ভূমিকা!

৪। আমাদের বর্তমান যুগে মুসলমান যদি মানুষকে সদাচরণ, সত্যবাদিতা ও আমানতদারী প্রভৃতির প্রতি দাওয়াত দেয়, তাহলে তার কোন বিরোধী দৃষ্ট হয়। কিন্তু যখন সে সেই তওহীদের প্রতি আহবান করে; যে তওহীদের প্রতি রসূলগণ আহবান করে গেছেন -আর তা হল একমাত্র আল্লাহকে ডাকা এবং তিনি ছাড়া আম্বিয়া, আওলিয়া যারা আল্লাহরই দাস তাদেরকে না ডাকা -তখন লোকে তার বিরোধিতা শুরু করে দেয়, তার নামে মিথ্যা অপবাদ রটায় এবং বলে, ও তো ওয়াহাবী!! আর এই বলে তার দাওয়াত থেকে মানুষকে বাধা। দান করে। এমন কি ওদের নিকট কোন এমন আয়াত পাঠ করা হয় যাতে তওহীদের উল্লেখ আছে, তবে তা শুনে ওদের কেউ কেউ বলে, 'এটা ওয়াহাবী আয়াত!!

অনুরূপ ওদের নিকট “যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে, তখন আল্লাহরই নিকট কর” এই হাদীস উপস্থাপন করা হয় তখন কিছু লোক বলে, 'এটা ওয়াহাবী হাদীস!’ নামাযী যদি নামাযে তার হাত দুটিকে বুকের উপর রাখে অথবা তাশাহহুদে তর্জনী হিলায় -যেমন রসূলুল্লাহ (সা.) করেছেন -তাহলে লোকে তাকে দেখে (নাক সিটকে) বলবে, এতে ওয়াহাবী!’ সুতরাং ওয়াহাবী’ সেই তওহীদবাদী মুসলিমের এক প্রতীকরূপে পরিচিত হয়ে পড়েছে, যে কেবলমাত্র তার প্রভু ও প্রতিপালককেই ডাকে এবং তার নবী (সা.)র সুন্নাহর পূর্ণ অনুসরণ করে। পরন্তু ওয়াহাবী’ ‘আল-ওয়াহহাব’ (মহাদাতা)-এর প্রতি সম্বদ্ধ; যা আল্লাহর পবিত্র নামাবলীর অন্যতম নাম। যিনি তওহীদবাদীকে তওহীদ দান করেছেন, যা আল্লাহর তরফ হতে তওহীদবাদীদের জন্য বৃহত্তম অনুগ্রহ ও দান।

৫। তওহীদের দাওয়াত পেশকারীদের জন্য জরুরী, ধৈর্যধারণ করা এবং আল্লাহর রসূলের কথা স্মরণ করে মনকে প্রবোধ দান করা, যাকে আল্লাহ বলেছিলেন,

وَاصْبِرْ عَلَىٰ مَا يَقُولُونَ وَاهْجُرْهُمْ هَجْرًا جَمِيلًا

অর্থাৎ, ওরা যা বলে, তার উপর তুমি ধৈর্য ধারণ কর এবং সৌজন্য সহকারে ওদেরকে উপেক্ষা করে চল। (সূরা মুযযাম্মিল ১০ আয়াত)

فَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ وَلَا تُطِعْ مِنْهُمْ آثِمًا أَوْ كَفُورًا

অর্থাৎ, তোমার প্রতিপালকের ফায়সালার জন্য ধৈর্য ধারণ কর এবং ওদের মধ্যে পাপাচারী ও কাফেরদের আনুগত্য করো না। (সূরা দাহর ২৪ আয়াত)।

৬। সকল মুসলিমের উপর ওয়াজেব, তারা যেন তওহীদের দাওয়াতকে সাদরে গ্রহণ করে এবং তওহীদের প্রতি আহবানকারীকে ভালোবাসে। যেহেতু তওহীদ সাধারণভাবে সমস্ত রসূল (সা.)গণের এবং (বিশেষভাবে) আমাদের রসূল (সা.) মুহাম্মাদ এক-এর দাওয়াত। সুতরাং যে ব্যক্তি রসূল (সা.)-কে ভালোবাসে, সে । তওহীদের দাওয়াতকে ভালোবাসে এবং যে তওহীদকে ঘৃণা বাসে, সে আসলে রসূল (সা.)-কেও ঘৃণা বাসে।।

দেখানো হচ্ছেঃ ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৫৭ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 পরের পাতা »