বিদআত দর্পণ বিদআত সৃষ্টির কারণ আবদুল হামীদ ফাইযী ১০ টি

দ্বীন বিষয়ে যথার্থ পড়াশুনা না করা বা না জানা, ধর্মের আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা, সঠিক আরবী ভাষাজ্ঞান না থাকা প্রভৃতি। এসব বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকলে অবশ্যই মানুষ বিদআত ও ভ্রষ্টতায় পড়তে বাধ্য। যেমন পথ না চিনলে অবশ্যই মানুষ ভ্রান্ত পথে বিপথগামী হতে বাধ্য হয়।

শরীয়ত মুসলিমকে জ্ঞান শিক্ষার উপর ফরযরূপে উদ্বুদ্ধ করে। অজান্তে কোন কথা আন্দাজে বলতে সাবধান করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَن تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ

অর্থাৎ, বল, আমার প্রতিপালক নিষিদ্ধ (হারাম) করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা আর পাপাচারকে ও অসঙ্গত বিরোধিতাকে এবং কোন কিছুকে আল্লাহর শরীক করাকে - যার কোন দলীল তিনি অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর উপর এমন। কিছু বলাকে যে সম্বন্ধে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই। (সূরা আরাফ ৩৩ আয়াত) তিনি আরো বলেন,

وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ۚ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا

অর্থাৎ, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই সে বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় ওদের প্রত্যেকের বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করা হবে। (সুরা ইসরা ৩৬ আয়াত)

আল্লাহর রসুল (সা.) বলেন, “আল্লাহ বান্দাদের নিকট থেকে ইলম ছিনিয়ে নেওয়ার মত তুলে নেবেন না। বরং উলামা তুলে নিয়ে ইলম তুলে নেবেন। এমতাবস্থায় যখন কোন আলেম অবশিষ্ট রাখবেন না, তখন মানুষ মুখদেরকে গুরু (ও নে) রূপে বরণ করবে। ফলে তারা জিজ্ঞাসিত হলে বিনা ইমে ফতোয়া দেবে, যাতে তারা নিজে ভ্রষ্ট হবে এবং অপরকে ভ্রষ্ট করবে। (বুখারী ও মুসলিম ২৬৭৩ নং)

তিনি আরো বলেন, “আমার পূর্বে কোন উম্মতের মাঝে আল্লাহ যে কোনই নবী পাঠিয়েছেন তাঁর জন্যই তার মধ্য হতে সাহায্যকারী ও সহচরবর্গ ছিল; যারা তাঁর আদর্শের অনুসারী ছিল। অতঃপর তাদের পর এমন উত্তরসুরিদের জন্ম হয় যারা যা কাজে করে না তা মুখে বলে এবং যা করতে তারা আদিষ্ট নয় তাই করে। সুতরাং যে ব্যক্তি এমন লোকদের বিরুদ্ধে নিজ হস্ত দ্বারা জিহাদ করে সে মুমিন, যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে নিজ জিহ্বা দ্বারা জিহাদ করে সে মুমিন, যে ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে নিজ অন্তর দ্বারা জিহাদ করে সে মুমিন। আর এর পশ্চাতে এক সরিষা দানা পরিমাণও ঈমান নেই।” (মুসলিম)

সুতরাং জ্ঞান এমন আলোকবর্তিকা যার দ্বারা মুসলিম আখেরাতের পথ সুস্পষ্টরূপে দেখতে পায় এবং কর্তব্যাকর্তব্য ঐ আলোকে প্রকটিত হয়। ফলে সে নিজে ভ্রষ্ট ও ধ্বংস হয় না এবং অপরকেও ভ্রষ্ট ও ধ্বংস করে না। পক্ষান্তরে জাহেল এক অন্ধ। যে নিজে পথের দিশা পায় না, সুতরাং অপরকে তো পথের সন্ধান বলতেই পারে না। (কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর) এমন অন্ধ নিজে বিদআতী হয় এবং ভুল ফতোয়া দিয়ে, জাল ও যয়ীফ হাদীসকে ভিত্তি করে আহকাম রচনা করে ও তা প্রচার করে অপরকেও বিদআতী বানায়।

অনেকে কিসা-কাহিনী এবং স্বপ্নবৃত্তান্ত দ্বারা আমল করে এবং তাই দিয়ে দাওয়াতের কাজ করে। এরা এমন কাঠুরে যারা রাতের অন্ধকারে কাঠ কুড়ায় এবং সাপও কুড়ায়। ফলে নিজেদের ধ্বংস ডাকে এবং যারা তাদের কাঠ ক্রয় করে তাদেরও সর্বনাশ আনে। প্রয়োজন সত্ত্বেও আলো জরুরী মনে করে না। বরং ইলম ও উলামার নামে নাক সিটকায়। যেহেতু উলামারা ওদের মত কাঠুরে নন তাই। হযরত জাবের এts বলেন, একদা আমরা সফরে বের হলাম। আমাদের মধ্যে এক ব্যক্তির মাথায় পাথরের আঘাত লেগে ক্ষত ছিল। পরে তার স্বপ্নদোষ হল। লোকটি (পবিত্রতা সম্পর্কে) তার সঙ্গীদেরকে জিজ্ঞাসা করল, আমার জন্য তায়াম্মুমের অনুমতি আছে কি? তারা বলল, 'না, তোমার জন্য সে অনুমতি নেই। কারণ তুমি পানি ব্যবহার করতে সক্ষম। (এই ফতোয়া শুনে) লোকটি গোসল করল। (এবং ক্ষতস্থানে পানি পৌছে ক্ষত বর্ধিত হলে) তাতে সে মারা গেল।

অতঃপর যখন। আমরা নবী -এর নিকট ফিরে এলাম তখন ঐ লোকটির কথা জানালাম। তখন। ঘটনা শুনে তিনি বললেন, “ওরা ওকে হত্যা করেছে, আল্লাহ ওদেরকে ধ্বংস করেন, কেন তারা জিজ্ঞাসা করেনি। যদি তারা জানত না? মুখতা রোগের নিরাময় তো প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসাই। ওর জন্য তো তায়াম্মুমই যথেষ্ট ছিল।” (আবু দাউদ, ইবন মাজাহ মুঃ আহমাদ ১/৩৩০) এতো ইহকালের ধ্বংসের কথা। কিন্তু ঐ গদ্দিনশীন জাহেল মুশরিকরা তো মানুষের পরকাল মন্দ করে এবং চিরস্থায়ী সর্বনাশের মুখে ঠেলে দেয়। কিতাব ও সুন্নাহর জ্ঞানকে কিতাবী জ্ঞান বা জাহেরী ইলম বলে অপদার্থ জ্ঞান করে এবং ওদের কল্পিত বাতেনী বা গুপ্ত কলবী জ্ঞানকেই প্রকৃত জ্ঞান বলে গুপ্তভাবেই কেবল নিজেদের ভক্তদের মাঝে প্রচার করে। ফলে ঐ জ্ঞানের কৃষ্ণতমসে নিজেদেরকে ও তার সাথে মুরীদদেরকেও সর্বনাশগ্রস্ত করে। পথের দিশা দিতে গিয়ে হতের দিশা দান করে থাকে।

পক্ষান্তরে অনেকে মনে করে যে, আমলটাই আসল। কোন আলেমের নিকট অযথা সময় নষ্ট করে ইলম শিক্ষায় কোন লাভ নেই। কিন্তু তারা জানে না যে, ইলম শিক্ষা। করাও এক বড় আমল। বরং বিনা ইমে আমল সম্ভবই নয়। যাতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই অধিক হয়ে থাকে। ইন্ম মুমিনের অস্ত্র ও ঈমানের জ্যোতি, তার চিরশত্রু শয়তান তাকে এই অস্ত্র হতে দুর এবং এই জ্যোতিকে নির্বাপিত করতে সফল হলে তাকে ধ্বংস ও ভ্রষ্ট করা খুবই সহজ হয়। অন্ধকারে পথ ভুল হয়। বিদআত বেড়ে চলে।

‘আমপারা পড়ে হামবড়া করে আর দু’পাতা উর্দু পড়ে ওস্তাজী সেজে অথবা ইমামরূপে প্রত্যেক মহল্লায় ‘খাস-খাস’ ফতোয় চলে। কেউ বা মকসুদুল মুমেনীন’ অথবা ‘বেহেস্তী যেওর’কে বুখারী-মুসলিমের দর্জা দিয়ে চোখ বুজে আমল করে। কেউ বা নিম-মৌলভী অথবা শুন-মৌলভীর কথায় ঈমানদার ও পরহেযগার সাজে। সে ক্ষেত্রে কিতাব ও সুন্নাহর প্রকৃত জ্ঞানী আলেম ও মুফতিদের কোন প্রয়োজনই বোধ হয় না। ফলে ঐ সমাজের অবস্থা এই যে, কিতাব ও সুন্নাহর কোন আলেম সঠিক পথ দেখাবার চেষ্টা করলে গদ্দিনশীনরা নিজেদের গদি যাবার ভয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কাফের ফতোয়া দিয়ে নিজ ভক্তদের কানে তালা ঝুলিয়ে দেয় অথবা ‘নতুন হাদীস’ বলে নাক সিটকে দেয় ফলে সংস্কার ও সংশোধন কঠিন হয়ে পড়ে, বিদআতের অন্ধকার আরো ঘনীভূত হতে থাকে।

বিদআত জন্মের এক কারণ প্রবৃত্তি পূজা। কোনও কর্মকে উত্তম মনে করা হয়, অতঃপর শয়তান সেই কর্মকে অধিক সুন্দর ও সুশোভিতরূপে তার মনে প্রবেশ করিয়ে দেয়। মন তা পছন্দ ও বরণ করে। কখনো বা অভ্যাসগতভাবে ঐ কর্মকেই ধর্ম বলে পালন করে। যখন কারো সতর্কবাণীও গ্রাহ্য হয় না। | বিদআত ঐ প্রবৃত্তিরই বোনা জাল। যে প্রবৃত্তির কাছে কিতাব ও সুন্নাহর ততটা বা কিছুটাও মান নেই। বস্তুতঃ যারাই কিতাব ও সুন্নাহর পথ ছেড়ে অন্য পথে চলতে চায় তারাই প্রবৃত্তির পূজা করে এবং নিজ মনের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

فَإِن لَّمْ يَسْتَجِيبُوا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ ۚ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِّنَ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

অর্থাৎ, অতঃপর ও যদি তোমার আহবানে সাড়া না দেয় তাহলে জানবে যে, ওরা তো কেবল নিজেদের খেয়াল-খুশীরই অনুসরণ করে। আর আল্লাহর পথনির্দেশ বিনা যে ব্যক্তি নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে তার চেয়ে অধিক বিভ্রান্ত আর কে? (সূরা কাসাস ৫০ আয়াত)

তিনি অন্যত্র বলেন,

إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَمَا تَهْوَى الْأَنفُسُ ۖ وَلَقَدْ جَاءَهُم مِّن رَّبِّهِمُ الْهُدَىٰ

অর্থাৎ, ওরা তো কেবল অনুমান এবং নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। অথচ ওদের নিকট ওদের প্রতিপালকের তরফ হতে পথনির্দেশ এসেছে। (সুরা নাম ২৩ আয়াত)

তিনি আরো বলেন,

أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَٰهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَىٰ عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَىٰ سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَىٰ بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَن يَهْدِيهِ مِن بَعْدِ اللَّهِ ۚ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ

অর্থাৎ, তুমি কি লক্ষ্য করেছ তাকে যে তার খেয়াল-খুশিকে নিজের উপাস্য করে নিয়েছে? আল্লাহ (তার ভ্রষ্টতা) জেনেই তাকে বিভ্রান্ত করেছেন, তার কর্ণ ও হৃদয়ে মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তার চক্ষর উপর রেখেছেন আবরণ। অতএব আল্লাহ মানুষকে বিভ্রান্ত করার পর কে তাকে পথ নির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? (সুরা জাসিয়াহ ২৩ আয়াত) সুতরাং প্রবৃত্তি পূজা এমন এক বিপজ্জনক হৃদরোগ যার কারণে পূজারী মানুষ। বিভ্রান্ত ও কুটিলতায় পড়ে সরল পথ থেকে সুদূরে অপসৃত হয়। এমন বক্রপথ অবলম্বন করে যে, সঠিক পথ-নির্দেশ সত্ত্বেও সত্য পথে প্রত্যাবর্তন করতে সম্মত। হয় না।

পর্বতসম দলীল তার কাছে পেশ করলেও তা অগ্রাহ্য করে নিজের মতের উপরই সুদৃঢ়ভাবে নির্বিচল থাকে। যেহেতু ঐ খেয়াল তার মনে এমনভাবে বদ্ধমূল হয় যে, ন্যায় শুনতে কর্ণ বধির এবং সরল ও সত্য পথ দেখতে চক্ষু অন্ধ হয়ে যায়। কখনো বা কিতাব ও সুন্নাহ থেকেই এমন দলীল বক্রতার সহিত বের করে, যা তার প্রবৃত্তি ও মতের বাহ্যতঃ অনুকূল মনে হয়। কখনো বা একটি মাত্র আয়াত বা হাদীসঅথবা তার কোন একাংশ ধরে তা নিজের মতের উপর দলীলরূপে পেশ করে নিজেকে কৃতার্থ মনে করে। কিন্তু অন্যান্য আয়াত, হাদীস বা তার পুণাংশের প্রতি ভ্রক্ষেপ করে না। এমন গোঁয়ার ও ভ্রষ্টলোকের সৃষ্ট বিদআত সবচেয়ে অধিক মারাত্মক।

বিদআত সৃষ্টির এক কারণ সন্দিহান ও রূপক (দুর্বোধ্য) আয়াত বা হাদীসের মনগড়া অর্থ ও ব্যাখ্যা করা। যাতে ব্যাখ্যাতা অসঙ্গত তাৎপর্য করে আসল উক্তির পরিবর্তন ঘটায় এবং এক উক্তির সহিত অন্য অক্তি পরস্পর-বিরোধিতা ব্যক্ত করে। কিতাবের কিছু অংশের উপর ঈমান আনে এবং কিছু অংশকে অস্বীকার। করে। ঐ সমস্ত রূপক আয়াতের মনগড়া ইলম মনে সঞ্চার করে বাতেনী ইলমের খাজানা পেয়েছে বলে দাবী করে। অথচ এরাই হচ্ছে বক্রতা ও ভ্রষ্টতার ভান্ডার। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রসূল (সা.) এই আয়াত তেলাঅত করলেন:

هُوَ الَّذِي أَنزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُّحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ ۖ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ ۗ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ ۗ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا ۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ

অর্থাৎ, তিনিই তোমার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন যার আয়াত সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন; এগুলি কিতাবের মূল অংশ। আর অন্যগুলি রূপক। যাদের মনে বক্রতা আছে তারা ফিৎনা (বিশৃঙ্খলা) সৃষ্টি ও ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে যা রূপক তার অনুসরণ করে। বস্তুতঃ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানে না। আর যারা সুবিজ্ঞ তারা বলে, আমরা এ বিশ্বাস করি, সমস্তই আমাদের প্রতিপালকের নিকট হতে আগত। বস্তুতঃ বুদ্ধিমান লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা আলে ইরান ৭ আয়াত)

অতঃপর তিনি (রসুল) বলেন, “সুতরাং যাদেরকে রূপক আয়াতের অনুসরণ করতে দেখবে আল্লাহ তাদেরকেই উদ্দেশ্য করেছেন, তাই তাদের থেকে সাবধান থেকো। (বুখারী ও মুসলিম) | রূপক আয়াত নিয়ে বিদ্যা জাহিরকারী (ভেদ প্রকাশকারী) ও বিভিন্ন সংশয় সৃষ্টিকারী এক ব্যক্তিকে উমার (রাঃ) প্রচন্ডভাবে প্রহার করে এমন শায়েস্তা করেছিলেন যে, অতঃপর আর কোন দিন তার মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক হয়নি। এমন লোক যে এ যুগে কম, তা নয়। কিন্তু সে উমার আর নেই। তাই তো এমন কেরামতবাজদের বিদআতে ভ্রষ্টতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে মুসলিম সমাজ অধঃপতনের শিকার হয়েছে।

সংশয় এক এমন ভয়ানক ব্যাধি যে, ঐ ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের নিকট আসল ও প্রকৃত বিষয় চাপা পড়ে, হক ও বাতিলের মাঝে তালগোল খেয়ে যায়। কখনো বা এমনও হয় যে, ঐ মানুষ ইসলামী গন্ডি থেকে অজান্তে বের হয়ে যায়। আবার এই ব্যাধির মাধ্যমেই ইসলাম-দুশমনরা মুসলিমদের ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে দুর্বল ঈমানের মানুষদের মনে বিপজ্জনক ঈমান-ধ্বংসী জীবাণুর অনুপ্রবেশ ঘটায়। ফলে মুসলিম নিজ ঈমানে সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করে এবং এক সময় ঈমান-হারা হয়ে যায়। তাইতো এসব বিষয়ে মুসলিমকে বড় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। বিশেষ করে যে সব বিষয়ে অধিক সন্দেহ জাগার সম্ভাবনা থাকে; (যেমন তকদীর, সিফাত প্রভৃতি) সে সব বিষয়ে ঈমান পাক্কা ও মজবুত করা উচিত।

প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহর সিফাত (গুণ) সম্বলিত আয়াতসমুহের কোনটাই রূপক (মুতাশা-বিহ) নয়। কেননা, তাঁর সিফাতের অর্থ আমাদের সুস্পষ্ট জানা, অবশ্য তার রকমত্ব ও স্বরূপ সকলের কাছে অজানা। সুতরাং সে বিষয়ে কারো কোন সংশয় হওয়ার কথা নয়।।

ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলতেন, 'আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি এবং তাঁর নিকট হতে আগত সকল বিষয়ের উপর আল্লাহর উদ্দেশ্যেরই অনুবর্তী হয়ে ঈমান। এনেছি। রসুলের উপর ঈমান এনেছি এবং তাঁর নিকট আগত সকল বিষয়ের উপর রসূলের উদ্দেশ্যেরই অনুবর্তী হয়ে ঈমান এনেছি।” (যাম্মুত তাবীল)

ইমাম মালেক (রঃ) আল্লাহর আরশে থাকার কেমনত্ব প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হলে। বলেছিলেন, আরশে থাকা বিদিত, তার কেমনত্ব অবিদিত এবং এ বিষয়ে প্রশ্ন (কৈফিয়ত) করা বিদআত।

আল্লাহ তাআলা মানুষকে শ্রেষ্ঠতম অবয়বে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর সৃষ্টজগতে অনেকের চেয়ে মানুষকেই অধিকতম শ্রেষ্টত্ব ও সম্মান প্রদান করেছেন। মানুষের দেহ সৃষ্টি-বিচিত্রে তাঁর বিস্ময়কর শক্তি এবং সীমাহীন প্রজ্ঞার অভিব্যক্তি ঘটেছে। মানুষের দেহ-বিচিত্রে মস্তিষ্ক ও বুদ্ধি আল্লাহর এক মহাদান। যার দ্বারা মানুষ ভালোকে মন্দ হতে এবং হককে বাতিল হতে পার্থক্য করতে পারে। শরীয়তের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ জ্ঞানকে কাজে লাগাতে বলা হয়েছে। এই জ্ঞান ও বিবেক যাতে বিনষ্ট হয়ে যায়, তার বিভিন্ন ব্যবস্থা করা হয়েছে।

কিন্তু মানুষ এই অমূল্য জ্ঞান-সম্পদকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন ও অবহেলার শিকার হয়েছে। কিছু মানুষ আছে যারা কোন বিষয়ে জ্ঞান খাটাতেই চায় না; বরং অন্ধভাবেই সবকিছু বিশ্বাস করে ও মেনে নেয়। এমন কি যেখানে শরীয়ত আদেশ করেছে, সেখানেও জ্ঞানকে ব্যবহার করতে কার্পণ্য বা আলস্য করে। আল্লাহ পাক বলেন,

سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنفُسِهِمْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ ۗ أَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ

অর্থাৎ, আমি ওদের জন্য আমার নিদর্শনাবলী বিশ্বজগতে ব্যক্ত করব এবং ওদের নিজেদের (দেহ) মধ্যেও; ফলে ওদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, তা সত্য। একি যথেষ্ট নয় যে, তোমার প্রতিপালক সর্ববিষয়ে সাক্ষী? (সুরা ফুসসিলাত ৫৩ আয়াত) তিনি আরো বলেন,

كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُونَ

অর্থাৎ, এভাবে আল্লাহ সকল নিদর্শন তোমাদের জন্য প্রকাশ করেন; যাতে তোমরা চিন্তা কর। (সূরা বাকারাহ ২১৯ আয়াত)

তিনি অন্যত্র বলেন,

قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الْأَعْمَىٰ وَالْبَصِيرُ ۚ أَفَلَا تَتَفَكَّرُونَ

অর্থাৎ, বল অন্ধ ও চক্ষুষ্মন কি সমান? তোমরা কি অনুধাবন কর না? (সুরা আনআম ৫০ আয়াত)

এইভাবে কুরআন মাজীদের বহু স্থানে “তোমরা কি বুঝনা? যাতে তোমরা বুঝ, যদি তোমরা বুঝ, ওরা কি জ্ঞান করে না? জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, তোমরা কি

চিন্তা কর না? যাতে তোমরা চিন্তা কর, যাতে ওরা চিন্তা করে, চিন্তাবিদদের জন্য নিদর্শন রয়েছে” প্রভৃতি বলে জ্ঞান ও চিন্তা করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু অনেকে জ্ঞান খাটায় না।

পক্ষান্তরে কতক মানুষ আছে, যারা সর্ববিষয়ে নিজের আকেলকেই প্রাধান্য দেয়, সবকিছুকেই বিবেকের নিক্তিতে ওজন করে। জ্ঞানকেই ভালো-মন্দ বুঝার উৎস। মনে করে। নিজেদের জ্ঞান যাকে সত্য বলে তারা তাকে সত্য মানে এবং যাকে অসত্য বলে তাকে তাই মানে যদিও তা কিতাব ও সুন্নাহর (প্রকৃত জ্ঞানের) প্রতিকূল হয়। যার ফলে বহু বিদআত এই আকেলের ছাঁচে সৃষ্টি হয়েছে। আর এরই জন্য ভ্রষ্টতা ও বহু সংখ্যক ফিতনা, বিশৃঙ্খলা ও হানাহানি সংঘটিত হয়েছে, কত সুন্নত উঠে গেছে, উম্মাহর মাঝে বিছিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে এবং কিতাব ও সুন্নাহর। বিভিন্ন উক্তিকে বিকৃত ও হেরফের করা হয়েছে।

অথচ শরীয়তে এমন কিছু নেই যা মানুষের জ্ঞান ও বিবেকের প্রতিকূল। অবশ্য অনেক বিষয় আছে, মানুষের সীমিত জ্ঞান যার প্রকৃতত্বের ছোঁয়া পায় না। ফলে সে তাতে বিমুঢ় ও হয়রান হয়ে যায়। কিন্তু তা বলে জ্ঞানের বাহুবলে তা অমান্য নয়। যেহেতু মানুষের জ্ঞান থাকলেও তার পরিসর সীমাবদ্ধ এবং সৃষ্টিকর্তা শরীয়তদাতার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অপরিসীম। তাঁর সকল হিকমত বুঝে ওঠা মানুষের সাধ্য নয়। সুতরাং শরীয়তের উপর জ্ঞানের চাকা সর্বক্ষেত্রে সচল নয়।

কিন্তু বিরলভাবে কতক মানুষ এই নিয়মের বিরোধিতা ও ব্যতিক্রম করে তারা নিজেদের অপরিসর জ্ঞানের বহরকে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে ঊর্ধ্বে। বাড়িয়ে থাকে, তাদের শাক-বেচা দাড়িপাল্লাতে সুবৃহৎ পর্বত ওজন করতে চায়! কেবল বিবেককেই ধর্মাধর্মের কষ্টিপাথর মনে করে। শরীয়তের বিষয়াবলীকে জ্ঞানের মিটারে মেপে থাকে। তাদের জ্ঞানে ধরে না -এমন ইলাহী খবরকে র করে দেয় এবং জ্ঞান ও রুচি থেকে হালাল ও হারাম মানে; যদিও ইলাহী কানুনে তার বিপরীত বলে ঘোষিত থাকে। এতো ভালো জিনিস, ওতে ক্ষতি কি? এটা কুসংস্কার ইত্যাদি বলে নবনব ভিত্তিহীন ইবাদত-অনুষ্ঠান রচনা করে থাকে অথবা ধ্বংস করে থাকেযার অনুমতি মাবুদ দেননি।

আকেলের ঘোড়া ছুটিয়ে বাস্তববাদীরা বহু দ্বীনী প্রকৃতত্বকে অস্বীকার ও রদ করে থাকে। বিশেষ করে অদৃশ্য ও ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য বিভিন্ন ইলাহী ও নববী খবরকে অবিশ্বাস করে; যদিও বা তা শুদ্ধভাবে প্রমাণিত। যেমন ফিরিশ্যা ও জিন-জগৎ, কবরের আযাব, যাদু-প্রতিক্রিয়া, ইমাম মাহদী ও হযরত ঈসার (আঃ) আবির্ভাব, দাজ্জালের ফিতনা, রসুলের মিরাজ, সিনাচাক, পরকালে মীযান, হাওয, পুলসীরাত প্রভৃতি গায়বী বিষয়কে তারা অবিশ্বাস করে।

পক্ষান্তরে, প্রত্যেক সুস্থ-মস্তিষ্কের মুসলিমের নিকট বিদিত যে, আল্লাহ বা তাঁর রসুল থেকে যখন কোন খবর শুদ্ধভাবে প্রমাণিত হয়, তখন তা মান্য করা অথবা রদ্দ। করাতে আকেলের কোন হাত থাকে না। বরং তাতে দৃঢ় প্রত্যয় রাখা এবং মান্য করা ওয়াজেব হয়ে যায়; চাহে অজ্ঞান ও বিবেক সেই খবরের প্রকৃতত্বের নাগাল পায় অথবা না পায়। যেহেতু জ্ঞান প্রত্যেক বিষয়েরই প্রকৃতত্ব উপলব্ধি করতে অক্ষম। হাজারে আসওয়াদকে চুম্বনকালে হযরত উমার ফারূক (রাঃ) এই তত্ত্বকেই সামনে। রেখে বলেছিলেন, 'আমি জানি যে, তুমি একটি পাথর; তুমি না কারো উপকার সাধন করতে পার, আর না-ই কারো অপকার। যদি রসুল (সা.)-কে তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না।” (বুখারী)

সুতরাং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এই যে, “যখন মুমিনদের আপোসের কোন বিষয়ের ফায়সালার জন্য তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের দিকে আহবান করা হয়, তখন তারা তো কেবল এ কথাই বলে, আমরা শ্রবণ করলাম ও মান্য করলাম। আর ব্রাই হল সফলকাম।” (সুরা নুর ৫১ আয়াত)।

(৫) ইমাম ও বুযুর্গদের অন্ধানুকরণ ও পক্ষপাতিত্ব

বিদআত প্রসারের এটি অন্যতম প্রধান কারণ। আকীদা ও আহকামে আল্লাহ ও রসুলের উক্তি এবং মীমাংসার উপর বিদআতীরা নিজেদের বুযুর্গদের কথা ও ফায়সালাকে অগ্রাধিকার দেয়। অন্ধভাবে তাই বিশ্বাস করে যা তাদের মাননীয় বুযুর্গ বলে। অতিরঞ্জনে অনেকে তাদের বুযুর্গকে ত্রুটিহীন নিস্পাপ মনে করে। মনের আসনে মান্যবর বুযুর্গ বা আলেমকে এমন স্থান দেয় যে, সে যা বলে বা যা করে, তাই। তাদের ধর্ম, কর্তব্য ও বিশ্বাস্য হয়। আর এর বিপরীত সবকিছু অধর্ম ও অমান্য হয়; যদিও বা এই বিপরীত কর্ম ও বিশ্বাস কুরআন ও সহীহ সুন্নায় বর্তমান থাকে। ব্যক্তি পূজার এই অতিরিক্ততায় অনেকে মনে করে যে, তাদের বুযুর্গ যা জানে তা আর অন্য কেউ জানে না বা জানতে পারে না।

ঠিক অনুরূপ অবস্থা বহু মযহাবের মুকাল্লেগণেরও হয়ে থাকে, তাদের ইমাম বা ফকীহ যা বলেন, অন্ধভাবে তাই তারা মান্য করে এবং প্রতিকুল সমস্ত কথা ও অভিমতকে অনায়াসে রদ করে দেয়; যদিও বা তা কুরআন ও সহীহ সুন্নায় থাকে। কেবলমাত্র ইমামের কথায় সম্পূর্ণ আস্থা ও ভরসা রাখে। বরং এখানেই শেষ নয়। ওদের অনেকে বলে থাকে যে, প্রতি সেই আয়াত ও হাদীস যা আমাদের মযহাবের বিপরীত ও বিরোধী হয়, তা ব্যাখ্যেয় অথবা রহিত (মনসুখ)!' (রেসালা কারখী) এই তাকলীদ মুসলিমদের মাঝে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। কঠিন অন্ধ পক্ষপাতিত্বের ফলে বিদআত বেড়ে চলেছে। যার কারণে কেউ আর কুরআন-হাদীস। শুনতে চায় না। ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করে অনেকে বলে, “ওসব আমাদের বুঝার ক্ষমতা নেই, তাঁরা সব বুঝে প্রকাশ করে গেছেন।

অথচ একথা বিদিত যে, ইমামগণের নিকট সকল সহীহ হাদীস পৌছেনি। পৌঁছলে নিশ্চয়ই তার বিপরীত কোন রায় তাঁরা দিতেন না। কারণ তাঁরা সকলেই কুরআন ও হাদীসেরই অনুসারী ছিলেন -এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে তাঁরা মুজতাহেদীন মানুষ ছিলেন। তাঁদেরও ভুল হতে পারে। যেমন তাঁরা সকলেই তাঁদের কারো অন্ধানুকরণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করে গেছেন এবং তাঁদের কোন কথা কোন সহীহ হাদীসের প্রতিকূল বা খেলাফ হলে হাদীসের মতকেই গ্রহণ করতে আদেশ করে গেছেন। সুতরাং মানুষ কিয়ামতে জিজ্ঞাসিত হবে যে, তারা কুরআন ও সুন্নাহর উপর আমল করেছিলেন কিনা? কোন ইমাম বা বুযুর্গের অনুসরণ করেছিল অথবা না করেছিল সে সম্পর্কে তাদেরকে কৈফিয়ত করা হবে না।

পক্ষান্তরে স্রষ্টার বিরুদ্ধাচরণ করে কোন সৃষ্টির আনুগত্য বৈধ নয়। আল্লাহ তাআলা। ভ্রষ্ট জননেতা ও তাদের অনুসারীদের প্রসঙ্গে বলেন,

يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا * وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا * رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا

অর্থাৎ, যেদিন অগ্নিতে ওদের মুখমণ্ডল উল্টে-পাল্টে দগ্ধ করা হবে সেদিন ওরা বলবে, 'হায় আমরা যদি আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য করতাম। ওরা আরো বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও গুরুদের আনুগত্য করেছিলাম এবং ওরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল; হে আমাদের প্রভু! ওদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং মহা অভিসম্পাত করুন।” (সূরা আহযাব ৬৬-৬৮, আয়াত)

ইবনে আব্বাস (রাঃ) সকলকে তামাত্তু' হজ করতে আদেশ করতেন। (যেহেতু রসূল প্লঃ সকলকে সেই আদেশই করেছিলেন।) কিন্তু এক প্রতিবাদী। বলল, 'না, তামা’ করা জরুরী না। কারণ, আবু বাকর ও উমার ও তা করতে নিষেধ করেন। (আর তারা আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞানী ও আনুগত্যের অধিক হকদার।) তা শুনে ইবনে আব্বাস ৩৬ বললেন, অবিলম্বে তোমাদের উপর। আকাশ থেকে প্রস্তর বর্ষণ হবে। আমি তোমাদেরকে বলছি, আল্লাহর রসুল ! বলেছেন আর তোমরা বলছ, আবু বকর ও উমার বলেছেন?’ (যাদুল মাআদ ২/১৯৫, ২০৬নং)

সুতরাং উদার ও অকুণ্ঠ মনে যে এই নীতিকে বুঝে নেবে তার নিকট সকল পাঁচ ও সমস্যা বন্ধন হারিয়ে সহজ হয়ে যাবে। ইসলাম ও আনুগত্যের ব্যাপারে তার মনে কোন জটিলতা জট পাকাবে না। আর মুসলিমদের মাঝেও কোন দ্বন্দ্ব অবশিষ্ট থাকবে না। বিদআত আখড়া ছেড়ে পলায়ন করবে এবং উক্ত স্থানে সুন্নাহ। শোভমান হবে।।

বিদআতীর সংসর্গ ও সাহচর্য বিদআত প্রসারে সহায়ক হয়; বিশেষ করে যদি সহচরের কোন পার্থক্য জ্ঞান না থাকে। আবার সময়-কাল দীর্ঘতার সাথে সাথে বিদআতকে লঘু জ্ঞান (বরং সুন্নাহ মনে করা হয়। ফলে সাথীর মত সাথীও ঐ বিদআতে আমল শুরু করে বসে। এই সংসর্গ প্রসংঙ্গে বহু সকর্তবাণী পুর্বেই আলোচিত হয়েছে।

(৭) উলামাদের নীরবতা ও স্বার্থান্বেষিতা

আল্লাহ পাক বলেন,

وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ ۚ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

অর্থাঃ, তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা (লোককে) কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎকার্যের নির্দেশ দেবে ও অসৎকার্য থেকে নিষেধ করবে এবং ওাই হবে সফলকাম। (সূরা আলে ইমরান ১০৪ আয়াত)

কিন্তু এই উম্মাহ যে সমস্ত বিপদ ও দুর্বলতার সম্মুখীন, তার মধ্যে উলামাদের আলস্য ও নীরবতা অন্যতম। আল্লাহর অর্পিত এই মহান দায়িত্ব পালনে উলামাগণ তোষামদ ও মনোরঞ্জনের পথ অবলম্বন করেছেন। উদরপূর্তি, অর্থ লাভ, কিছু আনন্দোপভোগ, পদ ও গদি বহাল প্রভৃতি স্বার্থলাভের খাতিরে বিদআত থেকে নিষেধ করা তো দুরের কথা বরং তাতে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। বরং তার চেয়েও বিস্মৃকর কথা এই যে, স্বার্থবশে তাতে শরীক হয়ে তার সুষ্ঠু উদ্যাপন করে থাকেন। যাদের অনেকে বেনামাযীর জানাযা পড়েন। কিন্তু তার চালশে (মীলাদ) পড়তে বা তার নামে কুরআনখানী বা শবীনা পড়তে কখনো ভুল করেন না।

অবশ্য এ কথার অর্থ এই নয় যে, কর্তব্যপরায়ণ আলেমই সমাজে নেই। এমন। আলেম তো প্রতি দেশ ও যুগে থেকেছেন ও আছেন, যাঁরা সুন্নাহ থেকে বিদআতের পার্থক্য-নির্বাচন করেন এবং ভালো-মন্দ বিচার করে ভালোর পথে চলতে সমাজকে আদেশ করেন। বিদআতকে দস্তুরমত খন্ডন করেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম। আর লোকেরাও তাদেরকে চিনতে ভুল করে।

প্রতিহত না হলে বাতিল খুব শীঘ্রই বেড়ে উঠতে থাকে। উলামাদের তরফ থেকে কোন। বাধা না পেলে বিদআত অবলীলাক্রমে বিস্তার লাভ করতে থাকে। বরং এই নীরবতা অনুমতি ও সমর্থনের লক্ষণ হয় এবং সমাজে তা সুন্নাহ বলে সুপরিচিত হতে থাকে। বর্তমানে মুসলিম জাহানের প্রতি দৃষ্টি ফিরালে দেখা যাবে যে, কত স্বনামধন্য উলামার কর্ণ ও চক্ষুর সামনে ছোট-বড় কত বিদআত ঘটছে ও বেড়ে চলেছে। অথচ তার প্রতিবাদ ও প্রতিকারে স্বল্প কয়েকজন ব্যতীত কেউ মুখ খুলেন না বা কলম ধরেন না।

বরং গদি ও পজিশন যাবার আশঙ্কায় অথবা কোন কূটনীতির খাতিরে অনেকে তাতে অংশ গ্রহণ করে থাকেন। যাতে সাধারণ মানুষের মনে এই ধারণা জন্মে যে, ‘তা বিদআত নয় বরং সুন্নাহ। তা না হলে অমুক সাহেব করবেন। কেন?” আবার কেউ যদি বাধা দিতে চান তাহলে তিনি শুনবেন, তুমি আর কতটুকু জানো? বিদআত হলে অমুক (জাদরেল) সাহেব বলে যেতেন না, বলতেন না বা করতেন না। তারা কি আলেম ছিলেন না? ওঁরা কি আলেম নন, ওঁরা কি কুরআন হাদীস জানেন না বা বুঝেন না? যত নতুন আলেম তত নতুন নতুন ফতোয়া নতুন নতুন হাদীস ইত্যাদি।

কিন্তু এ মিসকীনরা জানে না যে, সব বিষয় সবারই পক্ষে জানা বা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। যেমন, সুন্নাহর সহীহ-যয়ীফ-মওযু’র পার্থক্যজ্ঞান সকলের কাছে থাকে না। আবার সমস্যা আরো অধিক ঘোরতর হয় তখনই যখন প্রতিবাদ শুনে পূর্বোক্ত সাহেব মানহানির ভয়ে হক কবুল করতে না চান। পক্ষান্তরে যারা হক বলতে চুপ থাকে তারা বোবা শয়তান। (অবশ্য যেখানে ফিতনার ভয় থাকে সেখানকার কথা ভিন্ন।)

বলা বাহুল্য, অন্যায়ের প্রতিবাদে আলস্য সাজে না। ভয়, দুর্বলতা বা তোষামদ মানায় না। দুর্বল ঈমানের পরিচয় দিয়ে কেবলমাত্র অন্তর দ্বারা ঘৃণাই যথেষ্ট নয়। আল্লাহর দ্বীন, আল্লাহই সকলের উচিত বিচার করবেন বলে গড়িমসি চলে না, অথবা এ কাজের জন্য আমি ছাড়া আরো অনেক লোক আছে বলে কর্তব্যহীনতা প্রকাশ শোভা পায় না। আলেম হয়ে (সামর্থ্যানুযায়ী) আলেমের ভূমিকা ও কর্তব্য পালন না করলে তিনি বড় যালেম হবেন নিজের জন্য এবং সমাজের জন্যও।

অনেকে বলেন, ‘সুন্নাহ প্রচার করতে গিয়ে জামাআতের মাঝে বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্য সৃষ্টি হয়, ফলে সুন্নাহর প্রচার ফিতনার কারণ হয়; তাই চুপ থাকাই ভালো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সুন্নাহর প্রচার ফিতনার কারণ হয় না। বরং সুন্নাহর প্রতি। অজ্ঞতাই ফিতনার মূল কারণ। যেমন সহীহ সুন্নাহ প্রচার করলে যে বলে, 'এটা নতুন হাদীস’ সে এই কথা দ্বারা এই দাবী করে যে, সে যাবতীয় হাদীস শুনে ফেলেছে এবং দ্বীনের সমস্ত আহকাম জেনে ফেলেছে, তাই এই সুন্নাহ তাকে নতুন লেগেছে।

অথচ বাস্তবপক্ষে সুন্নাহ নতুন হয় না। সুন্নাহ তো সেই চৌদ্দ শতাব্দীর পুরাতন। অবশ্য সুন্নাহর প্রচার নতুন হতে পারে। কিন্তু ঐ মিসকীন ‘নতুন’ বলে না জেনে তা রদ করতে চায়। অথচ তার উচিত কেবল মান্য করা এবং নিজের অজ্ঞতার উপর। আক্ষেপ করা। মোট কথা, বিদআত ও কুসংস্কারাদি দেখে আলেমের নির্বাক থাকা মোটেই উচিত নয়। হিকমত ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে নিজের ইলম প্রয়োগ করা উচিত। যে জ্ঞান আল্লাহ তাকে দান করেছেন তা গোপন করা আদৌ বৈধ নয়। মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَىٰ مِن بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ ۙ أُولَٰئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ

অর্থাৎ, আমি যে সব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথনির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, মানুষের জন্য খোলাখুলিভাবে আমি কিতাবে ব্যক্ত করার পরও যারা ঐ সকল গোপন রাখে, আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ করেন এবং অভিশাপকারীরাও তাদেরকে অভিশাপ করে। (সূরা বাকারা ১৫৯ আয়াত)

তিনি আরো বলেন,

وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُونَهُ فَنَبَذُوهُ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ وَاشْتَرَوْا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا ۖ فَبِئْسَ مَا يَشْتَرُونَ

অর্থাৎ, (স্মরণ কর) যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল আল্লাহ তাদের নিকট প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে, তোমরা উহা স্পষ্টভাবে মানুষের নিকট প্রকাশ করবে এবং উহা গোপন করবে না। এরপরও তারা উহা পৃষ্ঠপিছে নিক্ষেপ করে (অগ্রাহ্য করে) ও স্বল্প মূল্যে বিক্রয় করে। সুতরাং তারা যা ক্রয় করে তা কত নিকৃষ্ট! (সূরা আলে ইমরান ১৮৭ আয়াত)।

প্রিয় রসুল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি জানা কোন ইলম (দ্বীনী জ্ঞান) সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে তা গোপন করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তার মুখে আগুনের লাগাম দেবেন। (সহীহহুল জামে’ ৬৫১৭নং)

বিজাতির অনুকরণ করেও মুসলিম নিজের পরিবেশে বিদআত সৃষ্টি করে থাকে। অমুসলিমের কর্মকে পছন্দ করে তা নিজের করণীয় ধর্ম ভেবে বসে। যেমন সাহাবী আবু ওয়াকেদ আল-লাইষী বলেন, রসূল (সা.) এর সহিত আমরা হুনাইনের পথে বের হলাম। তখন আমরা সদ্য নও মুসলিম ছিলাম। মুশরিকদের একটি কুল গাছ ছিল; যার নিকটে ওরা ধ্যানমগ্ন হত এবং (বর্কতের আশায়) তাদের অস্ত্র-শস্ত্রকে তাতে ঝুলিয়ে রাখত; যাকে যা-তে আনওয়াত্ব’ বলা হত। সুতরাং একদা আমরা এক কুল গাছের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম। (তা দেখে) আমরা বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের জন্য একটি ‘যা-তে আনওয়াত্ব’ করে দিন যেমন ওদের রয়েছ। (তা শুনে) তিনি বললেন, 'আল্লাহু আকবার! এটাই তো পথরাজি! যার হাতে আমার জীবন আছে তাঁর কসম! তোমরা সেই কথাই বললে যে কথা বানী ইস্রাঈল মুসাকে বলেছিল, আমাদের জন্য এক দেবতা গড়ে দিন যেমন ওদের অনেক দেবতা রয়েছে!’ মুসা বলেছিলেন, 'তোমরা মূর্খ জাতি। অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী (জাতির) পথ অনুসরণ করবে।” (তিরমিযী ২ ১৮০, মুসনাদ আহমাদ ৫/২ ১৮ নং)

অতএব উক্ত হাদীসে স্পষ্ট হয় যে, কাফেরদের অনুকরণই বানী ইসরাঈল এবং কিছু নও মুসলিম সহাবীকে এমন নিকৃষ্ট আবেদনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আর সে আবেদন ছিল এমন মাবুদ গড়া বা নির্দিষ্ট করা যেমন কাফেরদের ছিল; যার নিকট তারা ধ্যানমগ্ন হত, বর্কতের আশায় তার উপর অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখত এবং আল্লাহকে ছেড়ে তার আরাধনা করত।

বস্তুতঃ এই পরিস্থিতিই বর্তমান কালেও বিরাজমান। যেহেতু অধিকাংশ মুসলিম দলই কাফেরদের অনুকরণ করে বিদআত, শির্ক, কুসংস্কার যেমন; দুর্গাপূজা, কবরের উপর পুষ্পার্ঘ-দান, জন্মদিন, বার্থ ডে, নবী দিবস পালন, নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট খাদ্য ভক্ষণ, ইসলামী কোন ঐতিহাসিক দিনকে কেন্দ্র করে উৎসব পালন, স্মারক দিবস উদযাপন, স্মারক মূর্তি প্রতিষ্ঠাকরণ, শোক দিবস পালন, জানাযার বিভিন্ন বিদআত রচনা, সমাধির উপর মাযার নির্মাণ প্রভৃতি কর্ম ধর্ম ও নাজাতের অসীলা ভেবে আবিষ্কার করেছে; যার কোন দলীল আল্লাহ অবতীর্ণ করেন নি।

আল্লাহর রসুল (সা.) সত্যই বলেছেন, “অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির পথ অনুসরণ করবে বিঘত বিঘত এবং হাত হাত পরিমাণ (সম্পূর্ণরূপে)। এমনকি তারা যদি সান্ডার (গোসাপ জাতীয় একপ্রকার হালাল জন্তুর) গর্তে প্রবেশ করে তবে তোমরাও তাদের অনুসরণ করবে (এবং তাদের কেউ যদি রাস্তার উপর (প্রকাশ্যে) স্ত্রী-সংগম করে তবে তোমরাও তা করবে)!” সাহাবাগণ বললেন, আল্লাহর রসূল ইয়াহুদ ও খ্রীষ্টানরা?” তিনি বললেন “তবে আবার কারা?” (বুখারী, মুসলিম ও হাকেম)

আর সাহাবী হুযাইফাহ বিন আল-ইয়ামানও সঠিকই বলেছেন, 'তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির পথের অনুসরণ করবে জুতার পরিমাপের মত (পুরাপুরি খাপে-খাপে), তোমরা পথ ভুল করবে না এবং তারাও তোমাদেরকে (সঙ্গে করতে) ভুল করবে না। এমনকি তারা যদি শুষ্ক অথবা নরম পায়খানা খায় তাহলে তোমরাও তা (তাদের অনুসরণে ‘নিউ ফ্যাশন মনে করে) খাবে!’ (আল-বিদাউ অন্‌নাহয়্যু আনহা, ইবনে অযযাহ্ ৭১পৃঃ, তানবীহ উলিল আবসার ১৭২ পৃঃ)

এক শ্রেণীর পীর, দরবেশ, ফকীর বা সুফীদের দাবী যে, তাদের নিকট নাকি বহু বিষয়ে আল্লাহর তরফ থেকে কাশ্য হয়; যেমন আল্লাহর নবীর প্রতি অহী হতো। আবার অনেকে স্বপ্নে বা জাগ্রতাবস্থায় আল্লাহ অথবা তাঁর সহিত সাক্ষাৎ করে সরাসরি দ্বীনী ও নাজাতের জ্ঞান এবং পথ অর্জন করে থাকে। আর এর হাওয়ালায় নতুন-নতুন দ্বীনী আচার-অনুষ্ঠান আবিষ্কার করে থাকে। শুধু তাই নয় বরং তারা এই নিয়ে গর্বও করে, তাদের ঐ জ্ঞান (?)কে কিতাব ও সুন্নাহর জ্ঞানের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেয়, কিতাব ও সুন্নাহর আলেমের প্রতি কুটি হেনে বলে, তোমাদের সনদ (বর্ণনা সুত্র) তো এক মৃত ব্যক্তি হতে অপর এক মৃত ব্যক্তি। কিন্তু আমরা সরাসরি আল্লাহ। রব্বল আলামীনের নিকট হতে ইলম গ্রহণ করে থাকি। তাই তাদের সনদে তারা বলে, আমার প্রভু হতে আমার হৃদয় আমাকে বয়ান করেছে যে,

বলে, তোমাদের কিতাবী ইম, আর আমাদের কালবী ইম; কলবে কলবে বাতেনী ইলম! মৌলভীরা তো পানারি পাতার মত পানির (ইলমের) উপর ভেসে বেড়ায়, আমরা পানির (ইলমে) গভীরে প্রবেশ করি ---- ইত্যাদি বুলি আওড়ে কিতাব ও সুন্নাহ ছেড়ে দ্বীনী বিধানের তৃতীয় উৎসরূপে তাদের মনের মানস কল্পনা ও ভাবাবেগকে শ্রেষ্ঠ কারামত বলে জাহির করে এবং বহু অজ্ঞ তাদের সেই কাল্পনিক কথার অনুসরণ করে নিজেদেরকে কৃতার্থ মনে করে অথচ তারাই সর্বনাশগ্রস্ত বিদআতী।

(১০) যয়ীফ ও জাল হাদীসের উপর ভিত্তিকরণ

অধিকাংশ বিদআতীরা দুর্বল হাদীসের উপর ভিত্তি করে বিদআত (আমল) করে থাকে। এই ধরনের হাদীস ব্যাপকভাবে প্রচার করে থাকে। এর দ্বারা তাদের লিখিত কিতাবের কলেবরও বৃদ্ধি করে থাকে অথচ ঠিক একই সময়ে বহু সংখ্যক সহীহ হাদীসকে রদ করে থাকে। তার উপর আমল করতে অজুহাত পেশ করে বলে, 'ঐ হাদীস অসূলের খেলাফ’, অথবা ওটা খবরে ওয়াহেদ ইত্যাদি। আর এই ধরনের খোঁড়া ওজরে কত সুন্নত বরং ওয়াজেব ত্যাগ করে বসে।।

আবার প্রতিবাদ করে যদি ওদেরকে বলা হয় যে, যে হাদীসের উপর ভিত্তি করে আমল করছেন তা তো যয়ীফ অথবা মওযু'। তখন ওরা তার প্রত্যুত্তরে এমন কথা বলে যা অর্থহীন। যেমন বলে যে, 'ফাযায়েলে আমালে যয়ীফ হাদীসের উপর আমল চলবে’ ইত্যাদি। অথচ এ কথা শর্তহীন নয়। (দেখুনঃ তানবীহু উলিল আবসার)। “মুহাদ্দেসীন ও অসুলিইয়্যীনদেন নিকট যথাস্থানে নির্দিষ্ট শর্তাবলীর সহিত ফাযায়েলে আমালে যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল করা যায়।” এই কথার উপর দুটি আপত্তিমূলক টিপ্পনী রয়েছে।

(১) এই উক্তি হতে অনেকেই সাধারণ’ বা ‘ব্যাপক অর্থ বুঝে থাকে। মনে করে যে, উক্ত আমলে উলামাদের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই। অথচ এ রকমটা নয় বরং তাতে বিদিত মতভেদ বর্তমান যা বিভিন্ন হাদীসের পারিভাষিক (অসূলেহাদীসের) গ্রন্থ মূহে বিশদভাবে আলোচিত। যেমন আল্লামা শায়খ জামালুদ্দীন কাসেমী (রঃ) তার গ্রন্থ (কাওয়ায়েদুল হাদীসে) আলোচনা করেছেন। তিনি ১১৩ পৃষ্ঠায় ইমামগণের এক জামাআত থেকে নকল করেন যে, তাঁরা আদপে যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল করা ঠিক মনে করতেন না। যেমন, ইবনে মাঈন, বুখারী, মুসলিম, আবু বাকর ইবনুল আরাবী প্রভৃতিগণ। এঁদের মধ্যে ইবনে হাযম অন্যতম; তিনি তার গ্রন্থ আল-মিলাল অনিহাল’ এ বলেন, '(সেই হাদীস দ্বারা আমল সিদ্ধ হবে) যে হাদীসকে পূর্ব ও পশ্চিমের লোকেরা (অর্থাৎ, বহু সংখ্যক লোক) কিংবা সকলেই সকল হতে কিংবা বিশ্বস্ত বিশ্বস্ত হতে নবী প্ল থেকে বর্ণনা করেছে। কিন্তু যে হাদীসের বর্ণনা-সুত্রে কোন মিথ্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তি, কিংবা কোন অমনোযোগী গাফেল ব্যক্তি কিংবা কোন পরিচয়হীন অজ্ঞাত ব্যক্তি থাকে, তাহলে সেই হাদীস (যয়ীফ হওয়া সত্ত্বেও তার) দ্বারা কতক মুসলিম বলে থাকে (আমল করে থাকে)। অবশ্য আমাদের নিকট এমন হাদীস দ্বারা কিছু বলা (বা আমল করা), তা সত্য জানা এবং তার কিছু অংশ গ্রহণ করাও অবৈধ।

হাফেয ইবনে রজব তিরমিযীর ব্যাখ্যা-গ্রন্থে (২/১১২)তে বলেন, 'ইমাম মুসলিম তার সহীহ গ্রন্থের ভূমিকায় যা উল্লেখ করেছেন তার প্রকাশ্য অর্থ এই বুঝায় যে, তরগীব ও তরহীবে (অনুপ্রেরণাদায়ক ও ভীতি সঞ্চারক)এর হাদীসও তার নিকট হতেই বর্ণনা করা হবে, যার নিকট হতে আহকাম (কর্মাকর্ম সম্পর্কিত)এর হাদীস বর্ণনা করা হয়। (অর্থাৎ যয়ীফ রাবী হতে যেমন আহকামের হাদীস বর্ণনা করা হয়। না, তেমনিই সেই রাবী হতে তরগীব ও তরহীবের হাদীসও বর্ণনা করা হবে না।)

এ যুগে অদ্বিতীয় মুহাদ্দেস আল্লামা আলবানী (রহঃ) বলেন, 'এই অভিমত ও বিশ্বাস রেখেই আমি আল্লাহর আনুগত্য করি এবং এই অভিমতের প্রতিই মানুষকে আহবান করি যে, যয়ীফ হাদীস দ্বারা আদপে আমল করা যাবে না, না ফাযায়েল ও মুস্তাহাব আমলে আর না অন্য কিছুতে। কারণ, যয়ীফ হাদীস কোন বিষয়ে অনিশ্চিত ধারণা জন্মায় মাত্র (যা নিশ্চিতরূপে রসুল প্লঃ-এর বাণী নাও হতে পারে।)* এবং আমার জানা মতে, উলামাদের নিকট এটা অবিসংবাদিত। অতএব যদি তাই হয়, তবে কিরূপে ঐ হাদীস দ্বারা আমল করার কথা বৈধ বলা যায়? অথচ আল্লাহ অজাল্লা তাঁর কিতাবে একাধিক স্থানে ধারণার নিন্দাবাদ করেছেন; তিনি বলেন,

وَمَا لَهُم بِهِ مِنْ عِلْمٍ ۖ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ ۖ وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا

অর্থাৎ, ওদের এ ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই, ওরা অনুমানের অনুসরণ করে অথচ সত্যের বিরুদ্ধে অনুমানের (ধারণার) কোন মূল্য নেই। (সূরা নাজ্‌ম ২৮ আয়াত)

আর আল্লাহর রসুল (সা.) বলেন, “তোমরা অনুমান (ধারণা) করা হতে বাঁচ। অবশ্যই অনুমান সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা।” (বুখারী ও মুসলিম)

জেনে রাখুন যে, আমি যে রায় এখতিয়ার করেছি তার প্রতিপক্ষের নিকট এই রায়ের বিপক্ষে) কিতাব ও সুন্নাহ থেকে কোন দলীল নেই। অবশ্য পরবর্তীযুগের কোন আলেম তার গ্রন্থ আল-আজবিবাতুল ফাযেলাহ’ তে এই মাসআলার উপর নির্দিষ্ট পরিচ্ছেদে (৩৬-৫৯পৃঃ) ওঁদের সমর্থনে (ও আমাদের এই অভিমতের বিরুদ্ধে) দলীল পেশ করার প্রচেষ্টা করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের সপক্ষে অন্ততঃপক্ষে একটিও এমন দলীল উল্লেখ করতে সক্ষম হননি, যা হুজতের। উপযুক্ত! হ্যাঁ, তবে কিছু এমন উক্তি তাঁদের কারো কারো নিকট হতে নকল করেছেন, যেগুলি উক্ত বিতর্ক ও সমীক্ষার বাজারে অচল।

এতদসত্ত্বেও ঐ সমস্ত উক্তির কিছু কিছুতে পরস্পর-বিরোধিতাও বিদ্যমান। যেমন, ৪১ পৃষ্ঠায় ইবনুল হুমাম হতে নকুল করেন, “গড়া নয় এমন যয়ীফ হাদীস দ্বারা ইস্তিহবাব প্রমাণিত হবে।” অতঃপর ৫৫-৫৬ পৃষ্ঠায় জালালুদ্দীন দাওয়ানী হতে নকল করেন, তিনি বলেছেন, এ কথা সর্বসম্মত যে, যয়ীফ হাদীস দ্বারা শরীয়তের আহকামে খামসাহ’ (অর্থাৎ ওয়াজেব, মুস্তাহাব, মুবাহ, মকরূহ ও হারাম) প্রমাণিত হবে না এবং ওর মধ্যে ইস্তিহবাবও।

আমি (আলবানী) বলি, এ কথাটাই সঠিক। যেহেতু অনুমান দ্বারা আমল নিষিদ্ধ এবং যয়ীফ হাদীস অনিশ্চিত অনুমান বা ধারণা সৃষ্টি করে, যেমন পূর্বে আলোচিত

মোট কথা, ফাযায়েলে আমাল বলতে এমন আমল যার ফযীলত আছে, তা যয়ীফ হাদীসের উপর ভিত্তি করে করা যাবে না। করলে তা বিদআত বলে গণ্য। হবে। যেহেতু যয়ীফ হাদীস দ্বারা কোন আহকাম বা আমল (অনুরূপ কোন আকীদাও) সাব্যস্ত হয় না। তবে এমন আমল যা সহীহ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে তার ফযীলত বর্ণনায় আমল করা যায়, তবে তারও শর্ত আছে যা পরে বলা হবে।

উদাহরণস্বরূপ, চারে নামায সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। মুসলিম) কিন্তু তার ফযীলত প্রসঙ্গে এক হাদীসে বলা হয়েছে যে, “যে ব্যক্তি ঐ নামায পড়বে তার পাপ সমুদ্রের ফেনার সমান হলেও ক্ষমা করে দেওয়া হবে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)

অন্য এক হাদীসে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি নিয়মিত বারো রাকআত চাশ্বের নামায পড়ে, তার জন্য আল্লাহ পাক বেহেস্তে এক সোনার মহল তৈরী করেন।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)

আর এ দুটি হাদীসই যয়ীফ। চাশ্বের নামাযের এই ফযীলত বিশ্বাসে (ওঁদের মতে) তা ব্যবহার করা যায়। অনুরূপভাবে কুরবানী করা ও তার মর্যাদা কুরআন ও সুন্নাহতে প্রমাণিত তার ফযীলত বর্ণনায় (ওঁদের মতে কিছু শর্তের সাথে) কুরবানীর পশুর প্রত্যেক লোমের পরিবর্তে এক একটা নেকী--” এই হাদীস ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।।

এ বিষয়ে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রঃ) বলেন, “শরীয়তে যয়ীফ হাদীসকে ভিত্তি করা বৈধ নয়, যা সহীহ বা হাসান নয়। কিন্তু ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল প্রভৃতি উলামাগণ ফাযায়েলে আমালে সাবেত (প্রমাণসিদ্ধ) বলে জানা না যায় এমন হাদীস বর্ণনা করাকে জায়েয বলেছেন, যদি তা (ঐ যয়ীফ হাদীস) মিথ্যা বলে জানা না যায় তবে।

অর্থাৎ, যখন জানা যাবে যে, আমল শরয়ী (সহীহ) দলীল দ্বারা বিধেয় এবং তার ফযীলতে এমন হাদীস বর্ণিত হয় যা মিথ্যা (মওযু’) বলে জানা যায় না, তাহলে (হাদীসে বর্ণিত) সওয়াব সত্য হতে পারে (এই বিশ্বাস করা যায়)। কিন্তু ইমামগণের কেউই এ কথা বলেননি যে, যয়ীফ হাদীস দ্বারা কোন কিছুকে ওয়াজেব অথবা মুস্তাহাব করা যাবে। আর যে এ কথা বলে সে ইজমা’ (সর্ববাদীসম্মতি)র বিরোধিতা

করে। তদনুরূপ, কোন শরয়ী (সহীহ) দলীল ছাড়া কোন কিছুকে হারাম করাও অবৈধ। কিন্তু যদি (কোন সহীহ হাদীস দ্বারা) তার হারাম হওয়ার কথা বিদিত হয়। এবং ঐ কাজের কর্তার জন্য শাস্তি বা তিরস্কারের কথা কোন এমন (দুর্বল) হাদীসে বর্ণিত হয় - যা মিথ্যা বলে জানা না যায় - তবে তা (ঐ শাস্তির বিশ্বসে) বর্ণনা করা বৈধ। অনুরূপভাবে তরগীব ও তরহীবে ঐরূপ হাদীস বর্ণনা করা বৈধ হবে; যদি তা মিথ্যা (গড়া) বলে পরিচিত না হয়। কিন্তু এ কথা জানা জরুরী হবে যে, আল্লাহ এ বিষয়ে এই অজ্ঞাতপরিচয় হাদীস ছাড়া অন্য কোন দ্বিতীয় (সহীহ) দলীলে তরগীব বর্ণনা করেছেন।

অনুরূপভাবে ইসরাঈলিয়াতও তরগীব ও তরহীবে বর্ণনা করা যায়, যদি তা মিথ্যা বলে বিদিত না হয় এবং যখন জানা যায় যে, ঐ বিষয়ে আল্লাহ পাক আমাদের শরীয়তে আদেশ দান করেছেন অথবা নিষেধ করেছেন। কিন্তু কেবলমাত্র অপ্রমাণিত (অশুদ্ধ) ইসরাঈলিয়াত দ্বারা আমাদের শরীয়ত প্রমাণ করা হবে -এ কথা কোন। আলেম বলেন না। বরং ইমামগণ এই ধরণের কোন হাদীসকেই শরীয়তের বুনিয়াদ করেন না। আহমাদ বিন হাম্বল এবং তার মত কোন ইমামই শরীয়তে ঐ ধরনের হাদীসের উপর নির্ভর (ভিত্তি) করতেন না। যে ব্যক্তি নকল করে যে, আহমাদ। যয়ীফ হাদীসকে হুজ্জত (বা দলীল) করতেন; যে হাদীস সহীহ বা হাসান নয়, তবে নিশ্চয় সে তার সম্পর্কে ভুল বলে।” (আল কায়েন্নাতুল জালীয়াহ ৮২ পৃঃ, মজমুত্ম ফাতাওয়া ১/২৫ ১ নং)।

আল্লামা আহমাদ শাকের আল-বায়েষুল হাষীষ’ গ্রন্থে (১০১ পৃষ্ঠায়) বলেন, ‘আহমাদ বিন হাম্বল, আব্দুর রাহমান বিন মাহদী এবং আব্দুল্লাহ বিন মুবারক (রঃ) এর উক্তি, যখন আমরা হালাল ও হারামে (আহকামে) হাদীস বর্ণনা করি, তখন কড়াকড়ি করি এবং যখন ফাযায়েল ইত্যাদিতে বর্ণনা করি তখন শৈথিল্য করি-- আমার মতে -অল্লাহ আ’লাম- তাঁদের বলার উদ্দেশ্য এই যে, শৈথিল্য কেবল হাসান হাদীস গ্রহণে করতেন যা সহীহ’ এর দর্জায় পৌছে না। কারণ সহীহ ও হাসানের মাঝে পার্থক্যরূপ পরিভাষা তাঁদের যুগে স্পষ্ট স্থিত ছিল না। বরং অধিকাংশ পূর্ববর্তীগণ হাদীসকে কেবল সহীহ অথবা যয়ীফ (এই দুই প্রকার) বলেই মনে করতেন।

সুতরাং তাঁদের ঐ শৈথিল্য যয়ীফ হাদীস বর্ণনায় নয়, হাসান হাদীস বর্ণনায়।) আল্লামা আলবানী বলেন, 'আমার নিকট এর দ্বিতীয় ব্যাখ্যা রয়েছে, তাদের ঐ উল্লেখিত শৈথিল্য ইসনাদ (বর্ণনা সূত্র)সহ যয়ীফ হাদীস রেওয়ায়াত করার উপর মানা যায় - যেমন তাদের বর্ণনার ধারা ও প্রকৃতি; যে ইসনাদ সমূহের মাধ্যমে হাদীসের দুর্বলতা জানা সম্ভব হয়। সুতরাং কেবলমাত্র সনদ উল্লেখ করাই যথেষ্ট হয় এবং যয়ীফ’ বলে বিবৃত করার প্রয়োজন আর থাকে না। কিন্তু ঐ ধরণের হাদীস বিনা সনদে বর্ণনা করা যেমন পরবর্তীকালে উলামাগণের ধারা ও প্রকতি এবং তার। দুর্বলতা বর্ণনা না করা যেমন ওঁদের অধিকাংশের রীতি - এমন পদ্ধতি অবলম্বন। করা থেকে তাঁরা (ইমাম আহমাদ প্রভৃতিগণ) বহু ঊর্ধে এবং এ বিষয়ে তাঁরা আল্লাহকে অধিক ভয় করতেন। আর আল্লাহই অধিক জানেন।

(২) যে ব্যক্তি এ ধরণের কোন গ্রন্থ লিখেন যাতে চোখ বুজে সহীহ-যয়ীফ সবই সংকলন করেন এবং মনে করেন যে, কিছু শর্তের সাথে যয়ীফ হাদীস দ্বারা ফাযায়েলে আ’মালে আমল করা যায় তাঁর উচিত, গ্রন্থের ভূমিকায় সে বিষয়ে (সাধারণকে) সতর্ক করা এবং ঐ শর্তাবলী উল্লেখ করে (সেই অনু্যায়ী) আমল করতে সাবধান করা। যাতে পাঠকও অজান্তে গ্রন্থে উল্লেখিত প্রত্যেক হাদীসের উপর আমল এবং মুবাল্লেগও ঐ গ্রন্থ শুনিয়ে সকলকে আমল করার তাকীদ না করে বসে। ফলে সকলের অজান্তেই সকলে রসুলের বিরোধিতায় লিপ্ত না হয়ে পড়ে। সুতরাং ঐ শর্তগুলিকে জানা একান্ত জরুরী; বিশেষ করে তাদের জন্য যারা ফাযায়েলে যয়ীফকে ব্যবহার করে থাকে। যাতে যে কেউ ধংস হবে সে যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট জানার পর ধ্বংস হয় এবং যে জীবিত থাকবে সে যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট জানার পর জীবিত থাকে। হাফেয সাখাবী ‘আল-কওলুল বাদী’ (১৯৫ পৃঃ)তে তার ওস্তাদ হাফেয ইবনে হাজার থেকে ঐ শর্তগুলি নকল করেছেন এবং তা নিম্নরূপঃ

(ক) হাদীস যেন খুব বেশী যয়ীফ না হয়। অথবা তার বর্ণনা সুত্রে যেন কোন মিথ্যাবাদী, মিথ্যায় কলঙ্কিত বা অভিযুক্ত এবং মারাত্মক ত্রুটি করে এমন ব্যক্তি না থাকে।

(খ) তা যেন (শরীয়তের) সাধারণ ভিত্তির অন্তর্ভুক্ত হয়। অর্থাৎ একেবারে ভিত্তিহীন গড়া বা জাল হাদীস না হয়। (গ) এ হাদীস দ্বারা আমল করার সময় যেন তা প্রমাণিত (বা শুদ্ধ) হাদীস বলে। বিশ্বাস না রাখা হয়। যাতে নবী ধ্রু-এর সহিত সেই সম্পর্ক না জোড়া হয়; যা তিনি বলেননি। অতঃপর তিনি বলেন শেষোক্ত শর্ত দুটি ইবনে আব্দুস সালাম ও ইবনে দাক্বীকুল ঈদ হতে বর্ণিত এবং প্রথমোক্তের জন্য আলাঙ্গ বলেন, ‘তা সর্বদিসম্মত।

ইবনে হাজার (রঃ) তাঁর পুস্তিকা তাবয়ীনুল আজব’ এ বলেন, 'আহলে ইলমগণ ফাযায়েলে যয়ীফ হাদীস ব্যবহার করতে অনুমতি দিয়েছেন; যদি তা গড়া না হয় বা খুব বেশী যয়ীফ না হয় -এ কথাটি প্রসিদ্ধ। কিন্তু এর সহিত এই শর্তও আরোপ করা উচিত যে, আমলকারী যেন ঐ হাদীসটিকে যয়ীফ বলেই বিশ্বাস রাখে (শুদ্ধ মনে না করে) এবং তা যেন প্রচার না করে। যাতে কেউ যেন যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল করে যা শরীয়ত নয় তাকে শরীয়ত করে না বসে অথবা কোন জাহেল তাকে আমল করতে দেখে তা সহীহ সুন্নাত মনে না করে বসে।

এ বিষয়ে আবু মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুস সালাম প্রভৃতি উলামাগণ বিবৃতি দিয়েছেন। যাতে মানুষ আল্লাহর রসূল ধ্রু-এর সেই বাণীর পর্যায়ভুক্ত না হয়ে পড়ে যাতে তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি আমার তরফ থেকে কোন এমন হাদীস বর্ণনা করে যার বিষয়ে সে মনে করে যে তা মিথ্যা, তাহলে সে (বর্ণনাকারী) মিথ্যাবাদীদের একজন।” (মুসলিম, সহীহুল জামে’৬১৯৯নং)

সুতরাং যে আমল করবে তার অবস্থা কি? আহকাম অথবা ফাযায়েলে (যয়ীফ) হাদীস দ্বারা আমল করায় কোন পার্থক্য নেই। (অর্থাৎ যদি যয়ীফ হাদীস দ্বারা আহকাম বা হালাল ও হারামে আমল না চলে তবে ফাযায়েলেও চলবে না। কারণ, (উভয়ের) সবটাই শরীয়ত।

আল্লামা আলবানী (রঃ) বলেন, 'এই সমস্ত শর্তাবলী খুবই সুন্ন ও গুরুত্বপুর্ণ। যদি যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমলকারীরা এর অনুগামী হয়, তাহলে তার ফল এই হবে যে, যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমলের সীমা সংকীর্ণ হবে অথবা মূলেই আমল প্রতিহত হবে। এর বিররণ তিনভাবে দেওয়া যায়ঃ| প্রথমতঃ প্রথম শর্তটি নির্দেশ করে যে, যে হাদীসকে ভিত্তি করে আমল করার ইচ্ছা হবে সেই হাদীসটির প্রকৃত অবস্থা জানা ওয়াজেব। যাতে বেশী যয়ীফ হলে। তার দ্বারা আমল করা থেকে দূরে থাকা সম্ভব হবে। কিন্তু প্রত্যেক হাদীসের উপর এই জ্ঞান লাভ জনসাধারণের পক্ষে খুবই কষ্টসাধ্য। যেহেতু হাদীসশাস্ত্রবিদ উলামার সংখ্যা নেহাতই কম, বিশেষ করে বর্তমান যুগে। অর্থাৎ, (সেই উলামার সংখ্যা নগণ্য যাঁরা তথ্যানুসন্ধানকারী (সমস্ত হাদীসের সত্যাসত্য যাচাইকারী) গবেষণা ও সমীক্ষাকারী হাদীস বিশারদ, যাঁরা রসুল প্ল হতে শুদ্ধ প্রতিপাদিত হাদীস ব্যতীত লোকদের জন্য অন্য কোন হাদীস পরিবেশন ও বর্ণনা করেন না এবং যয়ীফ (তথা তার নিম্নমানের) হাদীসের উপর সকলকে সতর্ক ও সাবধান করে থাকেন। বরং এই গ্রুপের উলামা অল্পের চেয়ে কম। সুতরাং আল্লাহই সাহায্যস্থল।

এরই কারণে দেখেবেন, যারা হাদীস দ্বারা আমলে আপদগ্রস্ত হয়েছে তারা এই শর্তের স্পষ্ট বিরোধিতা করে। তাদের কেউ যদিও বা সে অহাদীসের আলেম হয় - ফাযায়েলে আমালে কোন হাদীস জানা মাত্রই তা অধিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত কিনা। তা না জেনেই তার উপর আমল করায় ত্বরান্বিত হয়। এরপর যদি কেউ তাকে ঐ হাদীসের দুর্বলতার উপর সতর্ক করে, তবে শীঘ্র ঐ তথাকথিত কায়দার’ শরণাপন্ন হয়; “ফাযায়েলে আমালে যয়ীফ হাদীস ব্যবহার করা যায়।” পুনশ্চ যখন এই শর্তের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, তখন উত্তর না দিয়ে চুপ থেকে যায়। এ বিষয়ে আল্লামা দুটি উদাহরণ পেশ করেন? (১) “সর্বোৎকৃষ্ট দিন আরাফার দিন; যদি জুমআর দিনের মুতাবেক হয় তবে তা সত্তর হজ্জ অপেক্ষা উত্তম।” (রাযীন)

এ হাদীসটির প্রসঙ্গে আল্লামা শায়খ আলী আল-ক্বারী বলেন, কিছু মুহাদ্দেসীন বলেন যে, এই হাদীসের ইসনাদটি যয়ীফ, তা সঠিক মানা গেলেও উদ্দেশ্যে কোন ক্ষতি হয় না। যেহেতু যয়ীফ হাদীস ফাযায়েলে আমালে গ্রহণীয় এবং আল্লামা আবুল হাসানাত লখনবী এই কথা নকল করে বহাল করেছেন। (আল আজৰিবাতুল ফাযেলাহ ৩৭ পৃঃ) কিন্তু ভাবার বিষয় যে, কিরূপে এই শ্রদ্ধাভাজন আলেমদ্বয় উপযুক্ত শর্ত লংঘন করেছেন। অথবা নিশ্চয় তাঁরা এই হাদীসের সনদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। থাকলে অবশ্যই তা বিবৃত করেন এবং তার পরিবর্তে বিতর্ক ছলে ‘তা মানা গেলেও এই কথা বলতেন না। অথচ আল্লামা ইবনুল কাইয়েম ঐ হাদীস প্রসঙ্গে মন্তব্য করে বলেন, 'বাতিল, রসূলুল্লাহ প্লঃ হতে ওর কোন ভিত্তি নেই, আর না কোন সাহাবী বা তাবেয়ী হতে।” (যাদুল মাআদ ১/১৭) (২) “যখন তোমরা হাদীস লিখবে, তখন তোমরা তার সনদ সহ লিখ। যদি তা সত্য হয়, তাহলে তোমরা সওয়াবের অংশীদার হবে। আর যদি তা বাতিল হয়, তাহলে তার পাপ তার (বর্ণনাকারীর) হবে।” (আল আজৰিবাতুল ফাযেলাহঃ ২৬পৃঃ)

এই হাদীসটি মওযু’ (গড়া হাদীস)। (দেখুন ও সিলসিলাতু আহাদীসিয যয়ীফাহ অল মওযুআহ ৮২২নং) এতদসত্ত্বেও শ্রদ্ধেয় লখনবী সাহেব এর উপর চুপ থেকেছেন। কারণ, এটাও ফাযায়েলে আমাল তাই! অথচ এটি এমন একটি হাদীস যা যয়ীফ ও জাল হাদীস প্রচার করতে ও তার উপর আমল করতে সকলকে অনুপ্রাণিত করে। যার মর্মার্থ হচ্ছে নকলকারীর কোন পাপ নেই। অথচ এমন ধারণা আহলে ইলমদের নীতির পরিপন্থী। যেহেতু তাঁদের নীতি এই যে, গড়ার কথা বিবৃত না করে কোন গড়া হাদীস বর্ণনা করাই জায়েয নয়। তদনুরূপ যথার্থতা যাচাইকারী সংস্কারক উলামা; যেমন ইবনে হিব্বান প্রভৃতিগণের নিকট যয়ীফ হাদীসও (তার দুর্বলতা উল্লেখ না করে বর্ণনা বৈধ নয়)।

আল্লামা আহমাদ শাকের উপযুক্ত তিনটি শর্তাবলী উল্লেখ করা সর্বাবস্থায় ওয়াজেব। কারণ, তা উল্লেখ না করলে পাঠক অথবা শ্রোতার ধারণা হয় যে, তা সহীহ বিশেষ করে, নকলকারী অথবা বর্ণনাকারী যদি উলামায়ে হাদীসের মধ্যে কেউ হন (অথবা দ্বীনের বুযুর্গ হন ও সমাজে মান্য হন); যাঁর প্রতি সকলে হাদীস বিষয়ে রুজু করে। যেহেতু যয়ীফ হাদীস গ্রহণ না করায় আহকামে ও ফাযায়েলে আমাল ইত্যাদির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বরং সহীহ বা হাসান - যা রসুল থেকে শুদ্ধরূপে প্রমাণিত হয়েছে - তা ব্যতীত কোন কিছুতে কারো হুজ্জত বা দলীল নেই।' (মুখতাসার আল-বায়েষুল হাষীষ ১০ ১পৃঃ)

আল্লামা আলবানী বলেন, 'সার কথা এই যে, এই শর্তের পালন কার্যতঃ যে হাদীস (শুদ্ধ বা সহীহ বলে) প্রতিপাদিত নয়, সেই হাদীস দ্বারা আমল ত্যাগ করতে বাধ্য করে। কারণ, সাধারণ মানুষের পক্ষে (যয়ীফ বা দুর্বল হাদীসের) অধিক দুর্বলতা জানা (ও চিহ্নিত করা) কঠিন। ফলতঃ এই শর্তারোপ করার অর্থ ও উদ্দেশ্যের সহিত যা আমরা এখতিয়ার করেছি তার প্রায় মিল রয়েছে এবং সেটাই উদ্দিষ্ট। দ্বিতীয়তঃ দ্বিতীয় শর্ত থেকে একথাই বুঝা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে আমল যয়ীফ হাদীস দ্বারা নয়, বরং সাধারণ ভিত্তি না থাকলে (কুরআন বা সহীহ সুন্নাহ হতে ঐ আমলের মূল বুনিয়াদ না থাকলে) যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল হয় না। অতএব এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, এই শর্তের সহিত যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল করা আপাতদৃষ্ট, বস্তুতঃ নয়। আর সেটাই অভীষ্ট।

তৃতীয়তঃ তৃতীয় শর্তটি হাদীসের দুর্বলতা জানা জরুরী হওয়ার ব্যাপারে প্রথম শর্তেরই অনুরূপ। যাতে আমলকারী তা (সহীহ) প্রমাণিত বলে বিশ্বাস না করে বসে। অথচ বিদিত যে, যারা ফাযায়েলে যয়ীফ হাদীসকে ভিত্তি করে আমল করে তাদের অধিকাংশই হাদীসের দুর্বলতা চেনে না। আর এটা উদ্দেশ্যের বিপরীত।

পরিশেষে স্থূল কথা এই যে, আমরা প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মুসলিম জন সাধারণকে উপদেশ করি যে, তাঁরা যেন যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল করা আদপেই ত্যাগ করেন এবং নবী প্ল থেকে প্রমাণিত (সহীহ বা হাসান) হাদীস দ্বারা আমল করতে উদ্যোগী হন। যেহেতু তাতেই যা আছে যয়ীফ হাদীস থেকে অমুখাপেক্ষী করে। (আমলের জন্য তাই যথেষ্ট।) আর ওটাই রসুল প্ল-এর উপর মিথ্যা বলায় আপতিত হওয়া (ও নিজের ঠিকানা জাহান্নাম করে নেওয়া) থেকে বাঁচার পথ। কারণ, আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় জানি যে, যারা এ বিষয়ে বিরুদ্ধাচরণ করে তারা উক্ত মিথ্যাবাদিতায়। সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। যেহেতু তারা প্রত্যেক সবল-দুর্বল (এবং জাল ও গড়া) হাদীস (এবং অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কেচ্ছা-কাহিনীকে হাদীস ধারণা করে তার দ্বারা) আমল করে থাকে। অথচ নবী প্লঃ (এর প্রতি ইঙ্গিত করে) বলেন, “মানুষের মিথ্যাবাদিতার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (অনুরূপভাবে যা পড়ে) তার সবটাই বর্ণনা করে।” (মুসলিম)।

আর এর উপরেই বলি মানুষের ভ্রষ্টতার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে (বা পড়ে) তার সবটার উপরই (বিচার-বিবেক না করে) আমল করে। (যেহেতু চকচক করলেই সোনা হয় না।) (দ্রষ্টব্যঃ সহীহহুল জামেইস সাগীর, ভূমিকা ৪৯-৫৬পৃঃ, তামামুল মিন্নাহ ভূমিকা)

(*) অনেকে বলে থাকে যে, কসম করে বলতে পারবে যে, যয়ীফ হাদীস রসুলের উক্তি নয়! উত্তরে বলা যায় যে, তা বলা যাবে না ঠিক। কিন্তু কসম করে এও বলতে পারা যাবে না যে, যয়ীফ হাদীস তাঁর উক্তি। সুতরাং সন্দিহান বিদ্যমান, যা ত্যাগ করাই উত্তম এবং পূর্ব সতর্কতামূলক কর্ম।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১০ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে